জাতীয়

অসুস্থ নই, সরকারকে ভুল বোঝানো হয়েছে- দেশ ছাড়ার প্রাক্কালে প্রধান বিচারপতি

By Daily Satkhira

October 14, 2017

অস্ট্রেলিয়ার পথে ঢাকা ছাড়লেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। তার স্ত্রী সুষমা সিনহা বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন বিভাগ পর্যন্ত এগিয়ে দেন।

গত রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের একটি বিমানে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্যাগ করেন তিনি। রাত ৯টা ৫৬ মিনিটে হেয়ার রোডের বাসা থেকে বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা দেন প্রধান বিচারপতি। রাত সাড়ে ১০টায় তিনি ভিআইপি লাউঞ্জ দিয়ে বিমানবন্দরে প্রবেশ করেন। দেশ ত্যাগ করার আগে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমি অসুস্থ নয়। আমি চলে যাচ্ছি। আমি পালিয়েও যাচ্ছি না। আমি আবার ফিরে আসব। আমি একটু বিব্রত। আমি বিচার বিভাগের অভিভাবক। বিচার বিভাগের স্বার্থে, বিচার বিভাগটা যাতে কলুষিত না হয়, এ কারণেই আমি সাময়িকভাবে যাচ্ছি। আমার কারও প্রতি কোনো বিরাগ  নেই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সরকারকে ভুল বোঝানো হয়েছে। এই আমার বক্তব্য আর কিছু বলব না। আমি লিখিত বক্তব্য দিয়েছি। এই হলো আমার লিখিত বক্তব্য। ’ রাত সাড়ে ৯টায় বোর্ডিং পাসও সংগ্রহ করা হয়। ঢাকা থেকে রওনা হয়ে ফ্লাইট এসকিউ-৪৪৭ স্থানীয় সময় আজ ভোর ৬টায় সিঙ্গাপুর পৌঁছবে। সেখানে ৪৫ মিনিট যাত্রাবিরতি করে রওনা হবে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশ্যে। সিঙ্গাপুর থেকে অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছতে প্রায় সাত ঘণ্টা লাগে। প্রধান বিচারপতি উঠবেন তার বড় মেয়ের বাসায়। তার ভিসায় অস্ট্রেলিয়ার পাশাপাশি কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ভ্রমণেরও সুযোগ রয়েছে। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় এসকে সিনহা গণমাধ্যমের উদ্দেশ্যে একটি লিখিত বিবৃৃতি দেন। সুপ্রিম কোর্টের প্যাডে বাংলায় স্বাক্ষর করা বিবৃতিতে এস কে সিনহা লিখেছেন, ‘আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আছি। কিন্তু ইদানীং একটা রায় নিয়ে রাজনৈতিক মহল, আইনজীবী বিশেষভাবে সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে ব্যক্তিগতভাবে যেভাবে সমালোচনা করেছেন, এতে আমি সত্যিই বিব্রত। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সরকারের একটা মহল আমার রায়কে ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করে পরিবেশন করায় প্রধানমন্ত্রী আমার প্রতি অভিমান করেছেন। যা অচিরেই দূরীভূত হবে বলে আমার বিশ্বাস। সেই সঙ্গে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে আমি একটু শংকিতও বটে। কারণ, গতকাল প্রধান বিচারপতি কার্যভার পালনরত দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রবীণতম বিচারপতির উদ্ধৃতি দিয়ে মাননীয় আইনমন্ত্রী প্রকাশ করেছেন, দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি অচিরেই সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনে পরিবর্তন আনবেন। প্রধান বিচারপতির প্রশাসনে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কিংবা সরকারের হস্তক্ষেপ করার কোনো রেওয়াজ নেই। তিনি শুধু রুটিনমাফিক দৈনন্দিন কাজ করবেন। এটিই হয়ে আসছে। প্রধান বিচারপতির প্রশাসনে হস্তক্ষেপ করলে এটি সহজেই অনুমেয় যে, সরকার উচ্চ আদালতে হস্তক্ষেপ করছে এবং এর দ্বারা বিচার বিভাগ ও সরকারের মধ্যে সম্পর্কের আরও অবনতি হবে। এটি রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না। ’ এদিকে, হাই কোর্টের প্রটোকল অফিসার মোহাম্মদ আবদুল ওয়ারেস সন্ধ্যা ৭টায় প্রধান বিচারপতির বাসায় যান। এস কে সিনহার মালামাল বিমানবন্দরে পৌঁছে দেন। তার আগে প্রধান বিচারপতির প্রটোকল ও ব্যক্তিগত গাড়ি এবং তার একান্ত সচিব মো. আনিসুর রহমান দুই দফায় হেয়ার রোডে প্রধান বিচারপতির বাসায় প্রবেশ করেন। আত্মীয়স্বজনরাও দিনে প্রধান বিচারপতি সিনহার সঙ্গে দেখা করেন। তারা হলেন প্রধান বিচারপতির ভাই ড. এন কে সিনহা, মেয়ে সীমা সিনহা, শ্যালিকা শীলা সিনহা, ভাতিজি জামাই রাজমনো সিংহ, সুজিত সিংহ, রামকান্ত সিংহ প্রমুখ। এ ছাড়া ৫টা ৫২ মিনিট ও ৬টা ৩ মিনিটে প্রধান বিচারপতির বাসায় দুটি প্রটোকলের গাড়ি প্রবেশ করে। ৬টা ১৭ মিনিটে প্রধান বিচারপতির একান্ত সচিব আনিসুর রহমান বাসায় যান। সন্ধ্যার পরপরই গণমাধ্যম কর্মীরা ভিড় জমায় এস কে সিনহার বাসভবনের সামনে। আগস্টের শুরুতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও সিনিয়র নেতা তার সমালোচনা করেন। রায় নিয়ে আলোচনা হয় সংসদেও। বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফেরাতে আনা হয়েছিল সংবিধানের ওই সংশোধনী। তা বাতিল করে জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফিরিয়ে আনে সুপ্রিম  কোর্ট।

বিদেশ যাওয়ার বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করে বিচারপতি সিনহার দেওয়া চিঠির বরাতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, প্রধান বিচারপতি চারটি দেশে যেতে চান। প্রধান বিচারপতির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৩ অক্টোবর থেকে ১ নভেম্বর পর্যন্ত ৩০ দিনের ছুটি মঞ্জুর করেছিলেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু বিচারপতি সিনহা যেহেতু আরও বেশি দিন বিদেশে থাকবেন, সেহেতু রাষ্ট্রপতি বৃহস্পতিবার নতুন আদেশ দিয়েছেন। আইন মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বর্ধিত ছুটিতে প্রধান বিচারপতির বিদেশে অবস্থানের সময়, অর্থাৎ ২ নভেম্বর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত, অথবা তিনি দায়িত্বে না ফেরা পর্যন্ত বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা প্রধান বিচারপতির কার্যভার সম্পাদন করবেন। সাত বিচারপতির ঐকমত্যের ভিত্তিতে দেওয়া ৭৯৯ পৃষ্ঠার এ রায়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা নিজের পর্যবেক্ষণের অংশে দেশের রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি, সুশাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনা করেন।   আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিচারপতি সিনহার স্বাক্ষরে রাষ্ট্রপতিকে পাঠানো ছুটির চিঠি ৪ অক্টোবর সাংবাদিকদের দেখান। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রধান বিচারপতি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে এর আগেও দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন এবং বেশ কিছু দিন ধরে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন। এ কারণে বিশ্রামের জন্য তিনি ছুটিতে যেতে চান। ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পাওয়া বিচারপতি সিনহার চাকরির মেয়াদ রয়েছে আগামী ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত। সুপ্রিম কোর্টের অবকাশ শুরুর আগে গত ২৪ আগস্ট তিনি শেষ অফিস করেন এবং অবকাশ শেষে ৩ অক্টোবর আদালত খোলার দিন  থেকে তিনি ছুটিতে রয়েছেন। গতকাল সকাল থেকেই তার বিদেশে যাওয়ার বিষয়টি বেশ আলোচনায় ছিল। বৃহস্পতিবার বিচারপতি সিনহার ছুটির বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকেই এর সূত্রপাত। কখন যাচ্ছেন প্রধান বিচারপতি? সবাই নিশ্চিত, যে কোনো সময় প্রধান বিচারপতি উড়াল দিচ্ছেন অস্ট্রেলিয়ায়। গতকাল রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা, সাংবাদিক ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের ভিড় বাড়তে থাকে। জানা যায়, অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থানরত মেয়ে সূচনা সিনহার কাছেই থাকবেন এস কে সিনহা। তার যাওয়ার জন্য গতকাল সকাল থেকেই রাজধানীর হেয়ার রোডের বাড়িতে প্রস্তুতি চলছিল সিনহা দম্পতির। দীর্ঘদিন পর মেয়ের কাছে যেতে তাদের ব্যাগ ও লাগেজে ছিল বিরাট আয়োজন। এদিকে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ওয়ার্ল্ড ইজ ওয়ান নিউজকে টেলিফোনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধান বিচারপতি সিনহা বলেছেন, বাংলাদেশের বিচার বিভাগ খুবই শক্তিশালী। তিনি আইনের শাসনের প্রতি আস্থাশীল। বৃহস্পতিবার সংবাদমাধ্যমটি ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সংবাদ মাধ্যমটি প্রধান বিচারপতির অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়া নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলে। তবে ঠিক কত দিনের জন্য যাচ্ছেন সে বিষয়ে কোনো জবাব দেননি বিচারপতি এস কে সিনহা। তিনি বলেন, ‘আমি বলতে পারব না। কোনো মিডিয়াকে সাক্ষাৎকার দেব না। আগে আমি দেশকে চাই। বাংলাদেশের বিচার বিভাগ খুবই শক্তিশালী। আমাদের বিচার বিভাগ স্বাধীন। আমি আত্মবিশ্বাসী যে, আমার দেশের কিছু হবে না। সরকার গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমি আইনের শাসনে আস্থাশীল। বৃহস্পতিবার ‘বাংলাদেশ চিফ জাস্টিস কনফাইনড?’ অর্থাৎ ‘বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি কি অবরুদ্ধ?’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে ওয়ার্ল্ড ইজ ওয়ান নিউজ নামের ওই সংবাদমাধ্যমটি। সেখানে বলা হয়, অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে প্রধান বিচারপতি অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছেন। তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তিনি এখন অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থান করছেন কিনা। জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি অস্ট্রেলিয়ায় নেই। আমি বাংলাদেশে আছি। ’