অনলাইন ডেস্ক : পুলিশ বাহিনীতে বেড়েই চলছে নতুন ইউনিট। বর্তমানে ৩৬টি স্বতন্ত্র ইউনিট থাকলেও খুব শিগগিরই এই বহরে যুক্ত হচ্ছে গাজীপুর মহানগর, রংপুর মহানগরসহ আরও চারটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। অভিযোগ রয়েছে, যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে এবং অপরাধের বহুমাত্রিকতা মোকাবিলায় নতুন নতুন ইউনিট যাত্রা শুরু করলেও ভোক্তারা কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছে না। ইউনিটগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে সেবার মান বরং কমছে। একই ঘটনা নিয়ে দুটি ইউনিটের মধ্যে টানাহেঁচড়ার ঘটনাও ঘটছে। আবার নতুন ইউনিট গঠন করায় পুরনো ইউনিটের কার্যক্রমই শূন্যের কোটায় চলে গেছে। নতুন বেশ কয়েকটি ইউনিটের কার্যক্রম শুধু কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছে, গত আট বছরে পুলিশ বাহিনীতে নতুন ছয়টি বিশেষায়িত ইউনিট গঠন করা হয়। কিন্তু বেশিরভাই চলছে খুঁড়িয়ে। অনেক ইউনিটে চাহিদার অর্ধেকেরও কম জনবল দিয়ে চলছে তাদের কার্যক্রম। আবার বেশিরভাগ ইউনিটেরই নেই নিজস্ব ভবন। আবাসিক এলাকার ভাড়া বাড়িতে চলছে তাদের কার্যক্রম। পিআইবি গঠন করায় অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির কাজ নেই বললেই চলে। আসামি গ্রেফতার বা মামলার তদন্ত নিয়ে পুলিশ ও র্যাবের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ পায়। অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, সেবা নিশ্চিত করতে মনিটরিং ও জবাবদিহিতার খুব প্রয়োজন। এজন্য সাধারণ মানুষের অভিযোগগুলো আমলে নিয়ে এর সমাধান বের করতে হবে। একইসঙ্গে বাহিনীর সদস্যদের মটিভেশন এবং আধুনিক প্রশিক্ষণের খুব প্রয়োজন রয়েছে। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ বলেন, শুধু ইউনিট বাড়িয়ে লাভ নেই। কোয়ালিটি নিশ্চিত করা দরকার। এজন্য সুপারভিশন এবং জবাবদিহিতা বাড়ানো খুব প্রয়োজন। আবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও সেবা নিশ্চিত করতে পুলিশ সদস্যদের যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সেবা বাড়ানোর জন্য বর্তমান সরকারের দুই মেয়াদে টানা আট বছরে পুলিশ বিভাগে ছয়টি বিশেষায়িত নতুন ইউনিট গঠন করা হয়েছে। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট এতদিন ঢাকা মহানগর পুলিশের অধীনে কাজ করলেও সম্প্রতি পুলিশ সদর দফতরের স্বতন্ত্র ইউনিট হিসেবে এন্টিটেররিজম ইউনিট হিসেবে যাত্রা শুরু করে। হলি আর্টিজান হামলার পর এই ইউনিটটি জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। অন্যদিকে, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ ভিভিআইপিদের নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদারের লক্ষ্যে সিকিউরিটি অ্যান্ড প্রটেকশন ব্যাটালিয়ন (এসপিবিএন), তদন্তের গুণগতমান বৃদ্ধির জন্য পৃথক তদন্ত ইউনিট পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), দেশের শিল্প এলাকার নিরাপত্তা জোরদার ও শিল্পবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ, নৌ-পুলিশ ও ট্যুরিস্ট পুলিশ গঠন করা হয়। পুলিশি সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে রংপুর রেঞ্জ, রংপুর রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্স (আরআরএফ) এবং ২৯টি নতুন থানা ও ৪৭টি তদন্ত কেন্দ্র করা হয়। বিমানবন্দরের নিরাপত্তার জন্য এপিবিএনের একটি শাখাও গঠন করা হয় বর্তমান সরকারের আমলে। রংপুর মহানগর পুলিশ গঠন করা হলেও তা যাত্রার অপেক্ষায় রয়েছে। তবে পুলিশ বাহিনীর পুরাতন রেলওয়ে পুলিশের কার্যক্রম নিয়ে অনেক অভিযোগ রয়েছে। চোরাচালানের একটি বড় অংশ রেলের সেই মান্ধাতা আমলের সরঞ্জাম নিয়ে চলছে তাদের কার্যক্রম। যদিও সম্প্রতি রেলওয়ে রেঞ্জের প্রধান ডিআইজি থেকে একজন অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক করা হয়েছে।
রেল পুলিশ প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি আবুল কাশেম বলেন, আমাদের যা আছে পর্যাপ্ত। এর বাইরে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছি না। পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত ডিআইজি (প্রশিক্ষণ) ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন বলেন, যথার্থ প্রশিক্ষণ হচ্ছে না, এটা ঠিক নয়। প্রতিটি ইউনিটকে মৌলিক এবং বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। মানব সম্পদ উন্নয়নের জন্য গত বছরও ৭৮ থেকে ৮২ হাজার সদস্য প্রশিক্ষণ নিয়েছে। এটা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।
তিনি আরও বলেন, প্রত্যেকটি নতুন ইউনিটের সদস্যদের বিদেশে উচ্চতর প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে যাতে তারা কাঙ্ক্ষিত সেবাটা নিশ্চিত করতে পারে। খুব শিগগিরই সিআরটি (ক্রাইসিস রেসপন্স টিম) প্রশিক্ষণের জন্য ২৪ জনের তিনটি দলকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হবে। কিছুদিন আগে ট্যুরিস্ট পুলিশের ২০ সদস্যদের একটি দলকে থাইল্যান্ডের ক্যাসোসেট বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে আনা হয়েছে। নৌ পুলিশকে বিদেশে প্রশিক্ষণ দিয়ে আনা হয়েছে। খুব শিগগিরই দেশে আরও চারটি পিটিসি (পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার) যুক্ত হচ্ছে পুলিশ বাহিনীতে।
নৌ পুলিশ প্রধান ডিআইজি শেখ মারুফ হাসান বলেন, মাত্র আমি যোগ দিয়েছি। সব কিছু আমি এখনো বুঝে নিতে পারিনি। তাই কোনো মন্তব্য করতে পারব না। তবে পুলিশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, বর্তমান সরকারের আট বছরে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে পুলিশ বাহিনীতে। এসেছে নতুন নতুন অস্ত্র, সরঞ্জাম। বেড়েছে জনবল। বেতন-ভাতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ঝুঁকিভাতা পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের মনোবল চাঙ্গা করেছে। পুলিশের মহাপরিদর্শক ছাড়াও ইন্সপেক্টর ও সাব-ইন্সপেক্টর পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পদমর্যাদা বৃদ্ধি করায় এ বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে রয়েছে সন্তুষ্টি। গত সাত বছরে নতুন নতুন থানা ভবন নির্মাণসহ আবাসন সমস্যা সমাধানে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। নতুন নতুন যানবাহনসহ পুলিশ বাহিনীকে আধুনিক করে গড়ে তুলতে নানামুখী পদক্ষেপও নিয়েছে বর্তমান সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত আট বছরে পুলিশের বার্ষিক বাজেট বেড়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে পুলিশ বাহিনীর জন্য বার্ষিক বাজেট ছিল ২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা। চলতি ২০১৭-১৮ বছরে জননিরাপত্তার জন্য ১৯ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর বেশিরভাগই বরাদ্দ রাখা হয়েছে পুলিশ বাহিনীর জন্য। তবে পুলিশ বাহিনীর জন্য অনুন্নয়ন বাজেট ধরা হয়েছে ৩০৩ কোটি টাকা। পুলিশ সদর দফতর বলেছে, বর্তমান সরকারের সময়ে পুলিশ বিভাগে সবচেয়ে বড় পাওয়া স্বাধীনতা পুরস্কার-২০১১। এর মাধ্যমে দীর্ঘদিন পর হলেও স্বাধীনতা যুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর অবদানের বিষয়টি সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেছে। এ ছাড়াও বর্তমান সরকারের আমলেই পুলিশ মহাপরিদর্শকের পদকে সিনিয়র সচিব পদমর্যাদায় উন্নীত করা করা হয়েছে। ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত র্যাংক ব্যাজ (থ্রি-স্টার জেনারেল)। পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, কর্তব্যরত অবস্থায় কোনো পুলিশ সদস্য নিহত হলে পরিবারকে দেয় অনুদান ৩ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৫ লাখ টাকা এবং আহত হলে ৫০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১ লাখ টাকা করা হয়েছে বর্তমান সরকারের আমলে। দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষিত ইন্সপেক্টর পদকে দ্বিতীয় থেকে প্রথম শ্রেণির নন-ক্যাডারে এবং এসআই ও সার্জেন্ট পদকে তৃতীয় থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করা হয়েছে। পুলিশে রেশনের বৈষম্য নিরসনসহ সর্বশেষ ৩০ ভাগ ঝুঁকিভাতা ঘোষণা করায় নতুনভাবে উজ্জীবিত পুরো পুলিশ বাহিনী। পুলিশ সদর দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ভাষায়, গত সাত বছরে পুলিশ বাহিনীতে যে পরিমাণ উন্নয়ন হয়েছে তা স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও হয়নি। তবে তথ্য বলছে, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ, ট্যুরিস্ট পুলিশ, পিবিআই, এসপিবিএন, নৌপুলিশ গঠন করা হলেও তাদের কার্যক্রম চলছে ভাড়া বাড়িতে। সিএমপি, এসএমপি, আরএমপি, কেএমপি চলছে ভাড়া করা ভবনে। ঢাকায় এপিবিএন-১ এর নিজস্ব জমি থাকলেও ইউনিট-২ চলছে ভাড়া করা ভবনে। আরআরএফের জমি বরাদ্দ পেয়েছে র্যাব। এপিবিএন মহিলা ইউনিটেরও নিজস্ব কিছু নেই। এসব বাহিনীতে কর্মরত সদস্যরা বলেছেন, পুলিশের ট্রেনিং নিয়ে চাকরিতে যোগদানের পর অন্য ইউনিটে বদলি করার পর তাদের কাজ করতে অনেক বেগ পেতে হয়। জনবল বাড়ানো হলেও স্থান সংকটে বিশেষায়িত ইউনিটের জন্য কোনো পৃথক ট্রেনিং সেন্টার নেই। ফলে সব ধরনের ট্রেনিং পাচ্ছে না মাঠ পুলিশ। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, নৌ-পুলিশের যানবাহন ও জনবল সংকট রয়েছে। এই দুই সমস্যা মেটাতে পারলে ইউনিটের কার্যক্রমের দ্রুত বিস্তার ঘটবে। আগামী বছরের শুরুতে এই ইউনিটে আরও ১০০ জনবল বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নৌ-পুলিশের স্থায়ী দফতরের জন্য কেরানীগঞ্জে জায়গা বরাদ্দের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ৫ একর জমি বরাদ্দ পাওয়া যাবে। ওই জমিতে কোস্টগার্ডের আদলে নৌ-পুলিশ ইউনিটের জন্য অফিস নির্মাণ করা হবে। পুলিশের ডিআইজি (প্রশাসন) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমাদের সবকটি ইউনিটই ভালো কাজ করছে। শিল্প পুলিশ গঠন করার পর বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে। নিজস্ব স্থাপনা এসব চলমান প্রক্রিয়া। সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন।