আন্তর্জাতিক

হারিয়ে যাওয়া ৭০০ রোহিঙ্গা শিশুর মা-বাবাকে খুঁজে দিল কামাল

By Daily Satkhira

October 22, 2017

গত ২৫শে আগস্ট থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে শুরু হয় সেনাবাহিনীর সহিংসতা। এর পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ছয়লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রাণে বাঁচতে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। পালিয়ে আসতে গিয়ে অনেকেই তাদের পরিবার, মা-বাবা ও প্রিয়জনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন।

তেমন মানুষদের স্ব-উদ্যোগে সহায়তা করছেন কামাল হোসেন নামের আরেকজন রোহিঙ্গা শরণার্থী। প্রায় বিশ বছর ধরে তিনি নিজেই উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পের বাসিন্দা।

আগস্টের ২৭ তারিখ থেকে এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে সাতশো পরিবারকে তাদের ছেলেমেয়েদের সাথে পুনরায় মিলিত হতে সহায়তা করেছেন তিনি।

কামাল হোসেন জানান, তিনি যখন বাংলাদেশে এসেছিলেন তখন তার বয়স ছিল নয়। ১৯৯৮ সালে তিনি মিয়ানমার থেকে শরণার্থী হয়ে চলে এসেছিলেন বাংলাদেশে। তিনি এসেছিলেন একাই, বাবামাকে না জানিয়ে এবং ক্যাম্পে থাকার জন্য নথিবদ্ধ হয়েছিলেন।

আন্তর্জাতিক একটি ত্রাণ সংস্থায় গার্ডের কাজ করেন কামাল হোসেন। বলছিলেন এত লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রথমবারের মত বাংলাদেশে এসে দিশেহারা হয়ে পড়ছেন। ‘এরা আসতেছে- কিন্তু গ্রাম চিনে না – পথঘাট চিনে না। তারা কখনও বাংলাদেশে আসে নাই। এদিক ওদিক যেতে গিয়ে অনেক শিশুর থেকে মা হারিয়ে যাচ্ছে, কারও আত্মীয় স্বজন হারিয়ে যাচ্ছে। খুঁজে পাইতেসে না। ‘

পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য বড় সমস্যা পরিবার থেকে শিশুরা যেন বিচ্ছিন্ন না হয়ে পড়ে। কামাল হোসেন বলছিলেন সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢল বাংলাদেশে ঢোকার পর একদিন তিনি দেখেন তার অফিস গেটের সামনে দাঁড়িয়ে এক নারী কাঁদছেন। ‘একটা মহিলা আমার গেটের সামনে আসি কান্নাকাটি করতেসে। আমি জিজ্ঞাসা করার পর উনি বলতেসে আমার একটা ছেলে আজকে দুদিন ধরে হারিয়ে গেছে, আমি খুঁজে পাইতেসি না। ‘

‘সারাদিন ডিউটি করার সময় চিন্তা করি করি আমার মনে হল অনেক মানুষ রোহিঙ্গাদের ত্রাণ দিতেছে, টাকাপয়সা, জিনিসপত্র দিতেছে, আমার তো ওইধরনের কোন সম্পদ নাই। আমি তো কিছু করতে পারতেসি না। তালে আমি যদি মাইকিং করে যাদের বাচ্চাগুলো হারিয়ে যায়,তাদের মা-বাপেরে যদি খুঁজে দিতে পারি, তাহলে যারা ত্রাণ দিতেসে, ওদের মত ওইধরনের সোয়াবগুলো আমি পাব। ”

২৭শে সেপ্টেম্বর কামাল হারিয়ে যাওয়া পরিবারগুলোকে আবার মিলিয়ে দেবার কাজ প্রথম শুরু করেন। তিনি বলছিলেন তার নিজের পকেট থেকে তার বেতনের ৩০০০ টাকা দিয়ে তিনি চার দিনের জন্য একটা মাইক ভাড়া করেছিলেন মাইকিং করার জন্যে।

“চারদিন পর যখন সময় চলে গেছে, আমি মাইক ফেরত দেবার জন্য যাচ্ছি, তখন ইউএনএইচসিআর আমার সঙ্গে কথা বলল- বলল আপনি তো নিজের টাকা খরচ করি মাইকিংটা করতেছেন। এখন আপনার তো সময় চলে গেছে- আপনি তো মাইকগুলো ব্যাক দিতে চান। তালে আমরা মাইকগুলার ভাড়া দেব, কিন্তু আপনি একটু হেল্প করতে পাবেন কীনা?”

এরপর রাজি হয়ে তিনি সেখানে একটা বোর্ড তৈরি করে টাঙালেন হারানো পরিবারদের মিলিয়ে দেবার জন্য। সেখান থেকেই তিনি শুরু করলেন মাইকিং করতে।

তিনি বলছিলেন কোনো ছেলে হারিয়ে গেলে তিনি তাকে তার গ্রামের নাম জিজ্ঞেস করেন, তার নাম, তার আব্বা-আম্মার নাম,তার বয়স এসব নানা বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে তারপর মাইকিং করতে থাকেন। ২৭শে সেপ্টেম্বর থেকে মাইকিং করে এ পর্যন্ত ৭৩৭জন হারিয়ে যাওয়া বাচ্চাকে তিনি বাবা-মার হাতে তুলে দিয়েছেন।

কঠোর যাচাই-বাছাইয়ের পর তবেই তিনি বাচ্চাদের ফিরিয়ে দেন সঠিক বাবা-মায়ের কাছে। “যখন একটা ছেলে হারিয়ে যায়, তখন মাইকিং করার পরে আব্বা আম্মা যখন ফিরে আসে আমার কাছে, তখন তাদের কত আনন্দ হয়, ওই সময় আমারও আনন্দ লাগে। ”

কামাল হোসেন জানান, হারিয়ে যাওয়া বাচ্চাটাকে সঠিক বাবা-মায়ের কাছে তিনি যে ফিরিয়ে দিতে পারছেন এটা তার জন্য একটা বিরাট আনন্দের অনুভূতি। তিনি যখন খুবই ছোট তখন নাসাকা বাহিনী তাকে দিয়ে কুলির কাজ করানোর চেষ্টা করলে তিনি পালিয়ে চলে এসেছিলেন বাংলাদেশে- জানান কামাল।

এর কয়েক বছর পর তার বাবা-মা বাংলাদেশে পালিয়ে এলেও বহুদিন বাবা-মায়ের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন তিনি। তিনি মানুষ হয়েছিলেন আরেকজনের আশ্রয়ে। পরে বাবা-মাকে খুঁজে পান কামাল। তাই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কষ্ট তিনি জানেন আর ব্যক্তিগত সেই অভিজ্ঞতা থেকেই এখন হারিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গা শিশুদের বাবা-মায়ের হাতে তুলে দেওয়ার কাজ কাঁধে তুলে নিয়েছেন বলে জানান কামাল হোসেন।