গত জানুয়ারিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন তখন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক মিত্র আশায় বুক বেঁধেছিল যে তিনি তার পূর্বসূরির চেয়ে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাবেন। মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ওবামা উদাসীনতা দেখিয়ে তাদের ত্যাগ করেছেন বলে মিত্রদের মনে ধারণা তৈরি হয়। ওবামার দৃষ্টি ছিল এশিয়ায়। ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি চীনের ক্রমবর্ধমান উত্থান ঠেকাতে প্রশান্ত অঞ্চলে মার্কিন উপস্থিতি জোরদার করেন।
ওবামা আরব বসন্তের সময় যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র মিসরের স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের ওপর থেকে সমর্থন তুলে দেশটির জনগণের পক্ষ নেন। সিরিয়ায় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়াতে তার অনীহা এবং ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তির ফলে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের মধ্যে অস্বস্তি বাড়তে থাকে।
মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর যুক্তরাষ্ট্রবিষয়ক গবেষক জেন কিনিনমন্ট সিএনএনকে বলেন, ‘অনেক বছর থেকে এখন পর্যন্ত উপসাগরীয় অঞ্চলে একটি ধারণা তৈরি হয়েছে যে, ইরাকের আগ্রাসনের মুখে কুয়েতকে মুক্ত করার মতো ঘটনায় উপসাগরীয় দেশগুলোর প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের যে অঙ্গীকার ছিল সেখান থেকে এখন পিছু হটেছে (ওয়াশিংটন)।’
তিনি বলেন, ওবামা এটা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে তিনি আরবের রাজাদের তেমন পছন্দ করেন না। এখন ট্রাম্প এসে তাদের আলিঙ্গন করেছেন। তিনি অস্ত্র বিক্রির অঙ্গীকার করছেন। তবে তার ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির কারণে এখনও এই ধারণা রয়েছে যে, ওয়াশিংটন উপসাগরীয় অঞ্চলে শুধু ততক্ষণই থাকবে যতক্ষণ তার নিজের স্বার্থে দরকার।
এটি সত্য যে, কাতার ও অন্য উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যকার বিরোধ মেটাতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকট নিরসনে উদ্যোগী হয়েছেন ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনার।
তবে টিলারসন ক্ষমতায় আসার পর অভিজ্ঞ কূটনীতিকদের গণহারে পদত্যাগের পর সেসব পদে নিয়োগ চলছে ধীরগতিতে। অভিজ্ঞ কূটনীতিক পাওয়াটাও দুষ্কর হয়ে পড়েছে। কিনিনমন্ট বলছেন, উপসাগরীয় দেশগুলো বুঝতে পারছে তাদের মিত্র দরকার। আর তখনই দৃশ্যপটে হাজির রাশিয়া। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক গবেষক মোহাম্মদ বাজি বলেন, তারা এখন মস্কোর দিকে ঝুঁকছে।
অক্টোবরে সৌদি বাদশা সালমানের রাশিয়া সফর এর একটা জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত। এটা নিয়ে বাড়িয়ে বলার কিছু নেই। এই প্রথম কোনো সৌদি বাদশা মস্কো সফর করলেন। অথচ মাত্র দু’দশক আগেও আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে উৎখাত করতে তারা টাকা ঢেলেছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে এই সফর তেমন গুরুত্ব পায়নি।
সৌদি আরব মার্কিন আনুগত্য ত্যাগ করেছে, বিষয়টি তেমন নয়। তবে এটা তাদের এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের চৌকস বিদেশনীতি। মধ্যপ্রাচ্য সংকটে তিনি এখন ত্রাণকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। গত মাসে তুরস্ক সফর করেছেন পুতিন। ইরানের সঙ্গেও তার সদ্ভাব রয়েছে। ট্রাম্পের চেয়ে তিনি মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল।
যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতিতে অনেক বিশ্ব নেতা নতুন সম্পর্কের দিকে ঝুঁকছেন। অনেকে আবার যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নাখোশ। যেমন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তুরস্কের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে।
চলতি মাসের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্র তুর্কি পর্যটক, শিক্ষার্থী, কূটনীতিক ও সাংবাদিকদের ভিসা দেয়া বন্ধ করে দিলে আঙ্কারাও পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে একই ঘোষণা দেয়।
প্রেসিডেন্ট ওবামা তুরস্কের নেতা রিসেপ তায়েপ এরদোগানকে রাজনৈতিক সংস্কারক বলে মনে করতেন। তিনি প্রথম সফরে তুরস্ক গিয়েছিলেন। কিন্তু তুরস্কে গত বছরের অভ্যুত্থানের পরপরই এরদোগানের পাশে দাঁড়ান পুতিন। ইরান তাকে সমর্থন দেয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের প্রতিক্রিয়া ছিল সে তুলনায় নগণ্য।
এরপর থেকেই রাশিয়া ও ইরান সম্পর্কে এরদোগানের ইতিবাচক ধারণা আরও বেড়েছে। প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের সময় থেকেই যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য থেকে পিছু হটতে শুরু করে। তবে ওবামার আমলে তা পূর্ণোদ্যমে চলে।
ওবামা বলেছিলেন, মধ্যপ্রাচ্যের অনেক বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ করা ঠিক নয়। ইরানের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে ইস্যুগুলো ভাগাভাগি করা উচিত সৌদির। সিরিয়া, ইরাক ও ইয়েমেন নিয়ে ইরান ও সৌদি আরবের প্রক্সিযুদ্ধের অবসানের জন্য উভয়ের একটি কার্যকর পন্থা বের করা দরকার। ওবামা স্পষ্ট করে দেন যে এ সংকটে যুক্তরাষ্ট্র কারও পক্ষ নেবে না।