জাতীয়

খালেদার গাড়িবহরে হামলা : একটি ফোন রেকর্ড নিয়ে তোলপাড়

By Daily Satkhira

October 31, 2017

ফেনীতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার ঘটনা ঘিরে বড় দুই দলে দোষাদুষি এখন চরমে উঠেছে। আর উত্তেজনায় নতুন রং ছড়িয়েছে এক ‘টেলিফোন আলাপচারিতার রেকর্ড’। একপক্ষে বলা হচ্ছে, চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেনই ফোনে অন্য একজনকে হামলার নির্দেশনা দিচ্ছেন। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে গতকাল সোমবার সংবাদ সম্মেলন করেছেন ডা. শাহাদাত হোসেন। তিনি দাবি করেন, অডিও টেপের কণ্ঠটি তাঁর নয়, এটি ফেনীর ধর্মপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা শাহাদাত হোসেন শাকার। এদিকে রাজধানীতে পৃথক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ নেতা হানিফ এবং ড. হাছান মাহমুদ উপস্থিত সবাইকে অভিও রেকর্ডটি বাজিয়ে শোনান এবং হামলার ঘটনাটিকে বিএনপির সাজানো বলে দাবি করেন। ফেনীর ইউপি চেয়ারম্যান শাকাও অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছিলেন। গতকাল রাতে কালের কণ্ঠ থেকে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, কণ্ঠটি তাঁর নয়, আর এমন নির্দেশনা দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

কী আছে অডিওতে ফেসবুক ও ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়া অডিওটি আমাদের হাতেও এসেছে। তবে ফোনের অন্য প্রান্তে থাকা নির্দেশদাতার গলার স্বর ততটা স্পষ্ট নয়। কলের শুরুতেই নির্দেশদাতা বলছেন : ‘হ্যালো মোবারক (অস্পষ্ট) ওইডা কি হইসে?’ এই প্রান্তে নোয়াখালীর আঞ্চলিক উচ্চারণে একজন বলেন, ‘একদম সব ঠিকঠাক করে দিসি। আপনি কুনু টেনশান করিয়েন না। সব রেডি করে দিসি। সব বুঝাইটোঝাই দিসি পোলাপাইনরে। ’ ওপ্রান্ত থেকে এবার বলা হয়, ‘ম্যাডামের গাড়িতে আবার ঢিলটিল মারিস না। ’ উত্তর দেওয়া হয়: ‘না না, ম্যাডামের গাড়িতে কোনো ঢিলমিল পইড়ত না। সাংবাদিকগোরে মাইরতে অইব। সুন্দর করে বুঝাইটোঝাই দিসি’। তখন ওই প্রান্তে শোনা যায়, ‘খেয়াল রাখিস। দুই-একটা চ্যানেলের গাড়ি কিন্তু ভাঙিস। ’ এদিক থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়, ‘হ্যা, চ্যানেলের গাড়ির মধ্যেই মাইরব। কোনো টেনশন করিয়েন না। দলের কোনো গাড়ির মধ্যে ঢিলমিল মাইরত না। কইয়া দিসি। ’ তখন নির্দেশদাতা বলেন, ‘আর শোন। ছাত্রলীগের পোলাপান ভাড়া কইরা লইস। ’ নির্দেশগ্রহীতা বলেন, ‘হ্যাঁ। এদিকে লোকাল দুই-তিনডারে কইয়ে রাখসি। টেহাপইসা দিয়ে দিসি জায়গামতন। কোনো টেনশন করিয়েন না। ’ ওরা যেন সামনে সামনে থাকে—এমন নির্দেশের জবাবে বলা হয়, সবাই সামনে থাকবে, এলাকার পোলাপাইন, কোনো সমস্যা নাই। ‘ওরা তো ছবিটবি তুলব। ওগো দোষ ওগো ঘাড়ে যেন আহে’—নির্দেশদাতার এই কথার উত্তরে বলা হয়, ‘একদম ঠিক কইরা আমি বুঝাইয়া কইসি। একটু পরে যামু। আবার সবটিরে বুঝাইয়া কমু। ’ নির্দেশগ্রহীতা কথা শেষ করেন, ‘লিডার, আসসালামু আলাইকুম’ বলে, শুরুতেই তিনি লিডার সম্বোধন করে সালাম দিয়েছিলেন।

‘আমি সেই শাহাদাত না’ বিভিন্ন সূত্র মতে, রবিবার রাতে অডিওটি প্রথম ছাড়ে একেবারেই অপরিচিত একটি নিউজপোর্টালে। এতে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির নেতা সভাপতিকে নির্দেশদাতা হিসেবে দেখানো হয়। এর প্রতিবাদে গতকাল দুপুর ১টায় চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন ডাকেন ডা. শাহাদাত হোসেন। তিনি লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘আমার ৩০ বছর রাজনৈতিক জীবনে কাউকে মারা দূরের কথা, থাপ্পড় মারারও নির্দেশ দিয়েছি—এমন কেউ বলতে পারবে না। আমি সব সময় সুস্থ রাজনীতির ধারায় বিশ্বাসী এবং পরিচ্ছন্ন রাজনীতি করে এসেছি। এ ছাড়া আমার কণ্ঠ দেশবাসী চেনে ও জানে, কারণ বিভিন্ন টক শো মিডিয়াতে আমি সব সময় কথা বলে আসছি। ’ একটি অপরিচিত নিউজ পোর্টালের নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই অনলাইনে গতকাল (রবিবার) রাত আনুমানিক দেড়টায় ছাড়া প্রতিবেদনে আমার কণ্ঠ উল্লেখ করে যে অডিও প্রচার করা হয়েছে তা মিথ্যা, ভিক্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। অডিও প্রচারকারী ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় এনে শাস্তির জোর দাবি জানাচ্ছি। ’ তিনি বলেন, কাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ভুয়া অডিও ছাড়া হলো তারও তদন্ত হওয়া উচিত। যে হামলার নির্দেশ দিয়েছে তদন্ত করে তাকে গ্রেপ্তার ও বিচারের আওতায় আনা উচিত।

ডা. শাহাদাত আরো বলেন, ‘ওই আলাপের শব্দ, কণ্ঠ, একসেন্ট কোনোটারই মিল নেই। যেখানকার ঘটনা সেখানকার আঞ্চলিকতা রয়েছে কথায়। গণমাধ্যমে এসেছে ওই হামলার মূল দায়িত্বে ছিলেন ফেনীর শর্শদী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জানে আলম ভূঁইয়া এবং ধর্মপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন শাকা। ওই শাহাদাতকে আমি শাহাদাত বলে চালিয়ে দিল। ’ বিএনপি চেয়ারপারসনের কক্সবাজার সফর বিষয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের দেওয়া সাম্প্রতিক বিভিন্ন বক্তব্যকে ‘হাস্যকর’ বলে দাবি করেন ডা. শাহাদাত হোসেন। তিনি বলেন, কোনো তদন্ত ছাড়াই ওবায়দুল কাদের হামলাকারীরা ছাত্রদল, যুবদল বলে দাবি করেছেন; ফেনীতে দলীয় চেয়ারপারসনের গাড়িবহরে হামলার ঘটনায় দায়ীরা ছাত্রলীগ ও যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।

‘অডিওটি বিএনপি নেতার’ গতকাল সকালে ঢাকায় ‘এনাম-আনার জনকল্যাণ ফাউন্ডেশন’ আয়োজিত বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানে অনলাইনে পাওয়া টেলিফোনের অডিও রেকর্ডটি বাজিয়ে শুনিয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, ‘বিএনপি সব সময় চক্রান্ত করে, এবারও তা-ই করেছে। সরকার এসব দুষ্কৃতকারীদের (খালেদার বহরে হামলাকারী) খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনবে। কারা এর সঙ্গে জড়িত, তা আমরা দেখতে চাই। ’

একইভাবে আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ সকালে রাজধানীতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ স্বাধীনতা পরিষদের অনুষ্ঠানে সমবেতদের অডিওটি বাজিয়ে শোনান এবং হামলার নির্দেশদাতা হিসেবে বিএনপিকে অভিযুক্ত করেন। পরে সন্ধ্যায় ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের পক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘বিএনপি নেত্রীর বক্তব্যের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় এটা তাঁদের পরিকল্পিত হামলা। বহরে হামলার ঘটনায় একজন বিএনপি নেতার গাড়িরও ক্ষয়ক্ষতি বা কোনো নেতার গায়ে আঁচড়ও লাগেনি, এটা আসলেই রহস্যজনক। ’ ফেনীর স্থানীয় একটি ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হামলার সঙ্গে জড়িত—বিএনপির এমন বক্তব্যের জবাবে হাছান মাহমুদ বলেন, ‘ছবি এডিট করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিএনপি অপপ্রচার চালাচ্ছে। ’ বিএনপির প্রতি প্রশ্ন রেখে ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘বেগম জিয়া কী কারণে যানজট সৃষ্টি করে পরীক্ষার্থীদের অসুবিধা করে সড়কপথে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার গেলেন? কেনই বা খালেদা জিয়ার নিজের এলাকায় তাঁদের গাড়িবহরে হামলা হলো? কী কারণে অসুস্থতার কথা বলেও এত দূরের পথ তিনি সড়কপথে গেলেন? আর গাড়িবহরে কেন কোনো ত্রাণ ছিল না। কী কারণে দেশে আসার প্রায় ১০ দিন পর রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে গেলেন? আগে কেন এলেন না?’

পরে রাতে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে হাছান মাহমুদ জানান, রোহিঙ্গাদের ত্রাণ দেওয়াকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে খালেদা জিয়া রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করছেন। তাঁর গাড়িবহরে তারাই পরিকল্পিতভাবে হামলা করেছে। এর প্রমাণ ফাঁস হওয়া অডিওতে আছে। তিনি বলেন, এই রকম নোংরা রাজনীতি বিএনপিই করে।

এর আগে রবিবার আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নিজ মন্ত্রণালয়ে বলেন, ‘আমার কাছে খবর আছে, ছাত্রদল ও যুবদল এ ঘটনা ঘটিয়েছে। পরিকল্পিতভাবে ছাত্রদল ও যুবদলকে দিয়ে এ ঘটনা ঘটিয়ে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ওপর দোষ চাপানোর এটি একটি মতলব, সেই মতলবটি এখন পরিষ্কার। ’

গত শনিবার বিকেলে ফেনী অতিক্রম করার সময় খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার ঘটনা ঘটে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও সম্প্রচারিত একটি ছবিতে কয়েক ব্যক্তিকে হামলা করতে দেখা গেছে। স্থানীয় বিএনপি নেতাদের দাবি, হামলাকারীদের একজন ফেনী সদর উপজেলার শর্শদী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ওসমান গণি ওরফে রিয়েল। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গণমাধ্যমে প্রচারিত ওই ছবি সম্পাদনা করা হয়েছে।