অনলাইন ডেস্ক : রাজধানীর কাকরাইলে করিম টাওয়ারে মা ও তাঁর ছেলেকে গলা কেটে হত্যা করেছে অজ্ঞাতপরিচয় দুর্বৃত্তরা। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় এই জোড়া হত্যাকাণ্ডের পর রাতে লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। নিহতরা হলেন ওই ভবনের মালিক আবদুল করিমের স্ত্রী শামসুন্নাহার (৪৪) ও সন্তান সাজ্জাদুল করিম শাওন (২০)। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গৃহকর্তা, গৃহকর্মী ও দারোয়ানসহ চারজনকে আটক করা হয়েছে।
গতকাল রাতে কাকরাইলে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম রোডে ৭৯/১ হোল্ডিংয়ের ছয়তলা ভবনের পঞ্চম তলার নিজ ফ্ল্যাটের একটি কক্ষ থেকে শামসুন্নাহার করিমের লাশ উদ্ধার করা হয়। আর চারতলার সিঁড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় তাঁর ছেলে শাওনের লাশ। সিঁড়িতে লাশের পাশে একটি রক্তমাখা ছুরি পড়ে ছিল। নিহতদের শরীরে ধারালো অস্ত্রের একাধিক আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। সিঁড়ি ও বেডরুমে দেখা গেছে জমাট বাঁধা চাপ চাপ রক্ত। পঞ্চম তলা থেকে নিচতলা পর্যন্ত সিঁড়ির বিভিন্ন স্থানে রক্তের ছোপ রয়েছে। বাসার ভেতর থেকে কোনো মালামাল লুট করা হয়নি।
জানা গেছে, আবদুল করিম আমদানি-রপ্তানি (মুদি মালামাল) ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জে। রাজধানীর শ্যামবাজারে তাঁর একটি আড়ত রয়েছে। চলচ্চিত্র প্রযোজনা ব্যবসায়ও যুক্ত তিনি। তাঁর তিন ছেলের মধ্যে শাওন সবার ছোট। শাওন উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজে ‘ও’ লেভেলে পড়তেন। বড় দুই ছেলের মধ্যে মুন্না ইংল্যান্ডে ও অনিক কানাডায় থাকেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা থানার ওসি কাজী মাঈনুল হক বলেন, সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। হত্যাকাণ্ডের আলামত সংগ্রহ করতে সিআইডির ক্রাইম সিনের সদস্যরা ঘটনাস্থলে আসেন। খবর পেয়ে উত্সুক লোকজনও বাসার সামনে ভিড় জমায়। পুলিশ ও র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা চালাচ্ছেন। আলামত সংগ্রহ করার পর রাত পৌনে ১১টার দিকে লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে।
পুলিশ ওই বাসার গৃহকর্মী রাশেদা বেগম, দারোয়ান আবদুল নোমান ও ভবনটির নিচতলায় গার্মেন্ট অ্যাসোসিয়েট কম্পানির কর্মচারী স্বপনকে আটক করেছে। রাত সাড়ে ৯টার দিকে ডিবি পুলিশের একটি টিম গৃহকর্তা আবদুল করিমকে নিয়ে যায়। আটক সবাইকে ডিবি কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
আটক গৃহকর্মী রাশেদা বেগম সাংবাদিকদের বলেন, ‘মাগরিবের নামাজের পরপরই বাসায় এসে রান্না করছিলাম। খালাম্মা নামাজ পড়ছিলেন। হঠাৎই বাইরে থেকে কিচেনের দরজা আটকে দেওয়া হয়। এ সময় আমি চিত্কার করে বলতে থাকি—খালাম্মা, দরজা বন্ধ করলেন কেন, দরজা খোলেন! কিন্তু কারো কোনো সাড়া পাইনি, কেউ দরজাও খুলে দেয়নি। একপর্যায়ে খালাম্মার চিত্কার শুনতে পাই। শাওন আরেকটি কক্ষে ছিল। সে মায়ের চিত্কার শুনে এগিয়ে এলে খালাম্মা তাকে পালিয়ে যেতে বলেন। মিনিট দশেক পর দারোয়ান নোমান বাসায় এসে দরজার ছিটকিনি খুলে আমাকে কক্ষ থেকে মুক্ত করে। ’
আটক স্বপন জানান, সন্ধ্যার পর তিনি অফিসে কাজ করছিলেন। এ সময় দারোয়ান এসে দরজায় নক করে। দরজা খুললে সে বলে—স্বপন ভাই, ওপরে চলেন; পাঁচতলায় খুন হইছে। তখন তাঁরা ওপরে গিয়ে দেখেন, চতুর্থ তলার সিঁড়িতে শাওনের গলাকাটা লাশ পড়ে আছে। হাতেও ধারালো অস্ত্রের কোপের আঘাত রয়েছে। পাঁচতলার ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখেন শাওনের মা একটি কক্ষে বেডের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছেন। তাঁরও গলা কাটা। পাশে জায়নামাজ বিছানো। রুমের মেঝে রক্তাক্ত।
দারোয়ান নোমান বলেন, ‘ঘটনা দেখে আমরা শাওনের বাবা আবদুল করিমের মোবাইল ফোনে কল করে সব জানাই। তিনি আশপাশেই কোনো একটি অফিসে ছিলেন। তাড়াতাড়ি বাসায় ছুটে আসেন তিনি। পরে থানায় ফোন করলে পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করে। ’
নোমান জানান, সন্ধ্যার পর এক যুবক ওপর থেকে চিত্কার করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছিল। নিচে নেমে সে তাঁকে বলে—ওপরে ঝগড়া বাধছে, তাড়াতাড়ি ওপরে যান। তিনি পাঁচতলায় যাওয়ার পথে চারতলার সিঁড়িতে শাওনের গলাকাটা লাশ এবং রুমে গিয়ে তাঁর মায়ের লাশ পড়ে থাকতে দেখেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিচে নেমে ওই যুবককে না পেয়ে বিষয়টি গার্মেন্ট অ্যাসোসিয়েট কম্পানির কর্মচারী স্বপনকে জানান। ঘটনার সময় ওই বাসার কাজের মেয়েকে রান্নাঘরে আটকে রাখা হয়েছিল। পরে দরজা খুলে তাঁকে বের করা হয়।
ডিএমপির জয়েন্ট কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, ‘কয়েকটি বিষয় সামনে রেখে ইতিমধ্যে তদন্ত শুরু হয়েছে। বাড়ির মালিক আবদুল করিমের ব্যবসায়িক লেনদেন নিয়ে কারো সঙ্গে কোনো বিরোধ ছিল কি না খতিয়ে দেখা হচ্ছে। চাঞ্চল্যকর অন্য মামলাগুলোর মতোই এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য শিগগির উদ্ঘাটন করা সম্ভব হবে বলে আশা করছি। ’
ডিএমপির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আটক চারজনকে গত রাত ১২টার দিকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় পর্যন্ত তাদের কাছ থেকে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়নি। আলামত ও হত্যার ধরন দেখে মনে হচ্ছে পরিকল্পিতভাবেই মা ও ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। বাসার দরজা ও গেট কেন খোলা ছিল তা নিয়েও রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। শামসুন্নাহার ব্যবসায়ী করিমের প্রথম স্ত্রী। বছরখানেক আগে করিম আরেকটি বিয়ে করেছেন। সেই স্ত্রীকে নিয়ে তিনি অন্যত্র থাকেন। মাঝেমধ্যে এই বাসায় আসেন। দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে পারিবারিক কোনো ঝামেলার কারণে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে কি না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ) মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘কয়েকটি বিষয় সামনে রেখে ইতিমধ্যে তদন্ত শুরু হয়েছে। পারিবারিক কলহ নাকি বাইরের কেউ অন্য কোনো কারণে দুজনকে হত্যা করেছে তা জানার চেষ্টা চলছে। গৃহকর্তা আবদুল করিমসহ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ’
আবদুল করিমের দূর সম্পর্কের আত্মীয় আবদুল বাসেত বলেন, ‘আমার জানামতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনো বিরোধ ছিল না। করিম অনেক সম্পত্তির মালিক। শামসুন্নাহার খুবই ধার্মিক ছিলেন। আত্মীয়-স্বজন ছাড়া বাইরের কারো সঙ্গে তিনি তেমন একটা কথা বলতেন না। আর শাওন ছিল শান্ত প্রকৃতির ছেলে। ’
তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ‘শামসুন্নাহার এ বছরই পবিত্র হজব্রত পালন করেছেন। তাঁর বাসায় মাঝেমধ্যে বোরকা পরিহিত মহিলারা আসতেন। অন্য পাশের খালি ফ্ল্যাটে তাঁরা থাকতেন বলেও আমরা তথ্য পেয়েছি। খুনিদের শনাক্ত করতে আশপাশের ভবন, অফিস ও রাস্তার ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হচ্ছে। ’
পেছনের ছয়তলা ভবনটির মালিকও আবদুল করিম। ওই ভবনের নিচতলায় ফেরদৌস টেইলার্সের কারখানা রয়েছে। আর ভবনের ছাদের চারটি কক্ষ ‘ব্যাচেলর’দের কাছে ভাড়া দেওয়া। ওই টেইলার্সের কয়েকজন কর্মচারী বলেন, ‘আমাদের কারখানায় প্রায় বিশজন কর্মচারী কাজ করেন। ঘটনার সময় তাঁরা কাজে ব্যস্ত ছিলেন। পরে আমরা ঘটনা জানতে পারি। বাসায় প্রবেশের গলির মুখে বেশ কয়েকটি চায়ের দোকান রয়েছে। নির্মাণাধীন ভবনও রয়েছে। কিন্তু ঘটনাটি কেউই আঁচ করতে পারেনি। ’ পেছনের ভবনের এক বাসিন্দা জানান, এই দুটি ভবনের কলাপসিবল গেট সকাল ৮টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সারাক্ষণ খোলা থাকে। নোমানই একমাত্র দারোয়ান।