জাতীয়

দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস: কমছে সঞ্চয়, বাড়ছে ঋণ

By Daily Satkhira

November 05, 2017

অনলাইন ডেস্ক : খরচের চাপ বেড়ে যাওয়ায় বাকিতে কেনাকাটা বাড়ছে পাড়া বা মহল্লার মুদি দোকানগুলোতে। ডিপার্টমেন্ট স্টোরেও ক্রেডিট কার্ডে কেনাকাটা বেড়েছে। স্বল্প আয় দিয়ে কোনো রকমে মাস পার করতে পারলেও অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা মোকাবেলার খরচ মেটানো বা সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য কিছু টাকা সঞ্চয়ের কথা ভাবতেও পারছে না সীমিত আয়ের লোকজন। ক্রেতারা বলছে, সব কিছুর দাম বেশি, খরচ বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। তা ছাড়া নতুন নতুন খরচের খাতও তৈরি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অথচ আয় বাড়ছে না এক টাকাও। এই পরিস্থিতিতে সঞ্চয় করা তো দূরের কথা, জমানো টাকাই ভেঙে খেতে হচ্ছে অনেককে। মোটা বা চিকন সব ধরনের চালের দাম বাড়তি কয়েক মাস ধরে। সরকারের পক্ষ থেকে খোলাবাজারে (ওএমএস) চাল বিক্রি করা হয়ে থাকে কোথাও কোথাও। তবে সাধারণ চালের বদলে শুধু আতপ চাল বিক্রি করা হচ্ছে বলে উদ্যোগটি জনপ্রিয় হচ্ছে না। পেঁয়াজের দামও প্রায় তিন-চার মাস ধরে ৬০ থেকে ৮০ টাকায় ওঠানামা করছে। বেশির ভাগ সবজি ও তরিতরকারি ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হচ্ছে। কাঁচা মরিচ ১২০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত উঠে যাচ্ছে যখন তখন, নানা অজুহাতে। সয়াবিন তেলের দামও কিছুদিন ধরে বাড়তি। গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ছে। জানুয়ারি মাস আসার আগেই বাসাভাড়া বাড়ানোর আলাপ পেড়ে রাখছেন কোনো কোনো বাড়িওয়ালা। খরচের চাপে যে বেসামাল স্বল্প আয়ের লোকজন—এটা শহরের পাড়া বা মহল্লার মুদি দোকানগুলোতে কথা বললে যে কেউ বুঝতে পারবে। রাজধানীর গুলশান থানার ঘনবসতি এলাকা নদ্দা-কালাচাঁদপুরে স্বল্প আয়ের ক্রেতাদের জন্য গড়ে উঠেছে কাঁচাবাজারসহ ছোট-বড় বেশ কিছু বিপণিবিতান। পাড়া বা মহল্লার অলিগলিতে রয়েছে ছোট-বড় মুদি দোকান। নদ্দার মুদি দোকান বিসমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আরিফ হোসেন বলেন, গত কয়েক মাসে তাঁর দোকানে বাকি কেনাবেচা বেড়েছে দ্বিগুণের চেয়েও বেশি। তা ছাড়া নগদ কেনাবেচাও কমে গেছে তাঁর দোকানে। ওই দোকানি বলেন, “আগে যে ক্রেতা মাসে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা বাকি নিত এখন নিচ্ছে তিন থেকে চার হাজার টাকা। সময়মতো টাকা পরিশোধও করছে না। টাকা চাইলে বলে, ‘ভাই, কী করব, টাকা নাই। ’” ওই দোকানি আরো বলেন, ‘বেচাকেনা কমে যাওয়ায় আমার দোকানের মুনাফাও কমে গেছে। আগে যে ক্রেতা একবারে দুই কেজি করে পেঁয়াজ নিত এখন সে নিচ্ছে এক কেজি করে।’ বারিধারায় বিদেশি একটি কম্পানির কর্মকর্তাদের আনা-নেওয়ার কাজে ব্যবহৃত একটি মাইক্রোবাস চালান মো. আলফত আলী। জাপানি একটি সংস্থার কার্যালয়েও একটি গাড়ি ভাড়ায় খাটাতেন তিনি। কিন্তু গত বছর জঙ্গি হামলায় জাপানের নাগরিক কুনিও হোশি মারা যাওয়ার পর থেকে ওই প্রতিষ্ঠানে আর গাড়ি ভাড়ায় খাটাতে পারছেন না তিনি। তা ছাড়া বর্তমানে যে অফিসের কর্মকর্তাদের আনা-নেওয়া করছেন সেখান থেকেও আগের মতো আয় আসছে না তাঁর। একই সঙ্গে আয় কমে যাওয়া এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় উভয় সংকটে পড়েছেন কর্মজীবী মানুষটি। আলফত আলী জানান, তাঁর একটি মাত্র মেয়েকে গত বছর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়েছেন। যাওয়া-আসার জন্য মেয়েকে রিকশাভাড়া দিতে হয় প্রতিদিন ১০০ টাকা করে। দুপুরের খাবারের জন্য আলাদা করে কিছু টাকাও দিতে হয় তাঁকে। এসব খরচের পাশাপাশি বর্তমানে সংসারে বাড়তি খরচের চাপ সৃষ্টি করছে তরিতরকারি, চাল, ডালসহ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। গত বৃহস্পতিবার দিলকুশায় একটি ব্যাংক শাখায় মাসিক সঞ্চয়ী স্কিম ডিপিএস ভাঙাতে আসেন আদর আলী। আড়াই বছর ধরে ৫০০ টাকা করে প্রতি মাসে জমা করেছেন তিনি। আদর আলী বলেন, ‘তিন বছর মেয়াদে জমা করতে পারলে ভালো মুনাফা পেতাম। কিন্তু টাকার টানাটানিতে মেয়াদপূর্তি হওয়ার আগেই ডিপিএসটা ভাঙিয়ে ফেলতে হলো আমাকে।’ ব্যাংকগুলো ঘুরে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, এই গ্রাহকের মতো অনেকেই এখন ডিপিএস ভাঙাচ্ছে। এর ফলে দেশের ব্যাংকগুলোতে ডিপিএসসহ অন্যান্য মেয়াদি আমানত আগের মতো আর বাড়ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত আগস্ট মাস শেষে দেশের ব্যাংকগুলোতে মেয়াদি আমানতের স্থিতি ছিল সাত লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা। এক বছর আগে অর্থাৎ ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে এর পরিমাণ ছিল সাত লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকগুলোর মেয়াদি আমানত বেড়েছে মাত্র ৮.৭৩ শতাংশ। ২০১৬ সালের আগস্টে এই হার ছিল ১২.০৮ শতাংশ। এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে মেয়াদি আমানত বৃদ্ধির হার কিভাবে কমছে। কেবল মেয়াদি আমানতই নয়, তলবি বা যেকোনো সময় তুলে নেওয়ার আমানত বৃদ্ধির হারও কমছে। গত আগস্টে তলবি আমানত বৃদ্ধির হার ছিল ১০.৮০ শতাংশ। অথচ এক বছর আগে (আগস্ট ২০১৬) তলবি আমানত বৃদ্ধির হার ছিল ২৩.৮২ শতাংশ। ব্যাংকে সঞ্চয় প্রবণতা কমে যাওয়ার অন্য একটি কারণ হলো আমানতের সুদহার কমে যাওয়া। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমানতের বিপরীতে ৬ থেকে ৭ শতাংশ সুদ পাওয়া গেলেও চলতি বা সঞ্চয়ী হিসাবের সুদহার মাত্র ৩ থেকে সাড়ে ৩ শতাংশ। দুই-তিন বছর ধরেই এই ধারা অব্যাহত রয়েছে। যে কারণে অনেকেই এখন ব্যাংকে আমানত রাখতে চাচ্ছে না। যাদের আগে থেকেই মোটামুটি একটি সঞ্চয় রয়েছে তাদের অনেকেই এখন ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নিয়ে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করছে। এতে ব্যক্তি বিনিয়োগের পথ সংকুচিত হচ্ছে, বেসরকারি খাতের উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে, কর্মসংস্থান কমে যাচ্ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি জনগণের প্রকৃত আয় কমিয়ে দিয়ে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়িয়ে তোলে এবং সঞ্চয় কমিয়ে ফেলে, যেটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। বন্যার পর থেকে চালের দামটা বেড়ে গেছে। তবে এর জন্য আমি সরকারের ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতাকেই দায়ী করব। কেননা সরকারের গুদামে যখন চাল না থাকে তখন ব্যবসায়ীরা এটা নিয়ে বড় ধরনের ব্যবসায় মেতে ওঠে। কিন্তু সরকারের গুদামে চাল থাকলে মূল্যস্ফীতির সময়ও চালের দাম বাড়ে না। ২০১০ সালে আমরা দেখেছি তখন মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের বেশি থাকলেও চালের দাম কম ছিল। কারণ সরকারের গুদামে পর্যাপ্ত চাল মজুদ ছিল। ’

এদিকে মুদি দোকানের মতো সুপারশপগুলোতে বাকিতে কেনাকাটা বাড়ছে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে। গত আগস্টে স্থানীয় ডিপার্টমেন্ট স্টোর, সুপারশপসহ বিভিন্ন ধরনের বিপণিবিতানের পয়েন্ট অব সেল বা পস মেশিনে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে দুই কোটি ২১ লাখ ৯২ হাজার ৬২০টি বিল পরিশোধ করা হয়েছে। টাকার পরিমাণ ছিল মোট ৬৩৬ কোটি টাকা। অথচ জুলাই মাসেও ক্রেডিট কার্ডে এত টাকা বাকিতে কেনাকাটা করা হয়নি। ওই মাসে কেনাকাটা হয় ৫৫০ কোটি টাকার মতো। তা ছাড়া লেনদেনের সংখ্যা ছিল খুবই কম, মাত্র আট লাখ ৭০ হাজার ২৬৭টি। অর্থাৎ জুলাই মাসে যে লেনদেনগুলো হয়েছিল সেগুলো মূলত বড় অঙ্কের কেনাকাটা। আজকাল অনেকেই ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে আসবাব, টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটরসহ বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করে। তবে এখন অনেকেই সুপারশপ বা চেইনশপগুলো থেকে মুদিপণ্য কিনছে। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আগস্টে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেনের সংখ্যা বেশি হলেও টাকার পরিমাণ সেই তুলনায় খুব বেশি নয়। একটি লেনদেনে গড় টাকার পরিমাণ ২৮৭ টাকা। দেশের সবচেয়ে বড় সুপারশপ স্বপ্নের (এসিআই লজিসটিকস লি.) হেড অব মার্কেটিং আফতাবুল করিম তানিম বলেন, ‘ক্রেডিট কার্ডে স্বপ্নের কেনাকাটার বিল পরিশোধ হচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। এটা ধীরে ধীরে বাড়ছে। ’ দেশে সরকারি সঞ্চয় বরাবরই ঋণাত্মক। ক্রমবর্ধমান বাজেট ঘাটতির কারণে দেশকে ঋণ করে চলতে হচ্ছে। এ অবস্থায় দেশজ সঞ্চয়ের অন্যতম জোগানদার হলো বেসরকারি খাত। কিন্তু আয় কম হওয়ার ফলে বেসরকারি খাতের সঞ্চয়ও কম। তবে বলিষ্ঠ রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধির প্রভাবে ২০০৪-০৫ অর্থবছর থেকে জাতীয় সঞ্চয় হার উৎসাহব্যঞ্জক গতিধারা বজায় রেখে চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের আবাসন খাতে ব্যাংকগুলোর অতিমাত্রায় বিনিয়োগের ফলে ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর-পরবর্তী সময়ে সৃষ্ট আর্থিক সংকট এবং আন্তর্জাতিক শেয়ারবাজারে দরপতন থেকে শুরু হওয়া বিশ্বমন্দায় উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রাথমিক অবস্থায় গুরুতর ধাক্কা না খেলেও পরবর্তী সময়ে নানা ধরনের সংকটে পড়ে। বাংলাদেশ বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর অনেকখানি নির্ভরশীল। ২০০৯, ২০১০ সময়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বৈশ্বিক আর্থিক মন্দার ঢেউ লাগতে শুরু করলেও বাংলাদেশ ছিল এর প্রভাব থেকে অনেকটাই মুক্ত। গবেষকরা বলছেন, উচ্চ রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধির কারণে ওই সময় দেশের অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় ভালো অবস্থানে ছিল, যা দেশটির সামষ্টিক অর্থনৈতিক সক্ষমতাকে বেগবান করে। ব্যক্তিপর্যায়ে আর্থিক সংকট মোকাবেলার সক্ষমতা থাকায় ওই বার মন্দার হাত থেকে বেঁচে যায় গোটা অর্থনীতি। অবশ্য কিছুটা হোঁচট খেয়েছিল রপ্তানি খাত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সময়োপযোগী পদক্ষেপে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো অনুৎপাদনশীল খাতে ঋণ গুটিয়ে নেওয়ায় মূল্যস্ফীতি ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণেও চলে এসেছিল।