মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর চালানো হত্যা-নির্যাতনের ঘটনাকে গণহত্যা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের (সিপিএ) ৬৩তম সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধিরা। তাঁরা দেশে ফিরে গিয়ে তাঁদের জাতীয় ও প্রাদেশিক পার্লামেন্টে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা উত্থাপনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একই সঙ্গে চলমান রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে সিপিএ সম্মেলনে বিশেষ রেজুলেশন (সিদ্ধান্ত প্রস্তাব) গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন। বিষয়টি বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছেন সিপিএ চেয়ারপারসন ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঢাকায় অনুষ্ঠেয় সিপিএ সম্মেলনে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কোনো এজেন্ডা না থাকলেও প্রতিনিধিদের বিশেষ আগ্রহের পরিপ্রেক্ষিতে সিপিএর পক্ষ থেকে এ বিষয়ে একটি ব্রিফিংয়ের আয়োজন করা হয়। গতকাল রবিবার বিকেলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সিপিএ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধিদের উদ্দেশে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ব্রিফ করেন। এ সময় জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট মো. ফজলে রাব্বী মিয়া, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমসহ সংসদ সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
ব্রিফিংয়ে উপস্থিত একাধিক সংসদ সদস্য জানান, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্রিফিং শেষে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী এ বিষয়ে সিপিএভুক্ত দেশগুলোর জাতীয় ও আঞ্চলিক পরিষদে আলোচনা এবং মিয়ানমারের ওপর কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টির আহ্বান জানান। এ সময় বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের প্রধান ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট মো. ফজলে রাব্বী মিয়া রোহিঙ্গা ইস্যুতে ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) মতো সিপিএ সম্মেলনে একটি রেজুলেশন গ্রহণের অনুরোধ জানান। এরপর আলোচনায় অংশগ্রহণকারী ১৮ দেশের প্রতিনিধি সিপিএ চেয়ারপারসনের প্রস্তাব অনুযায়ী রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে নিজ নিজ দেশের পার্লামেন্টে আলোচনার প্রতিশ্রুতি দেন। তাঁরা বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের প্রধানের দেওয়া প্রস্তাবের আলোকে সিপিএ সম্মেলনে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের রেজুলেশন গ্রহণের পক্ষে ঐকমত্য প্রকাশ করেন। এ সময় সিপিএ চেয়ারপারসন প্রস্তাবটি বিবেচনার আশ্বাস দেন। তিনি এ বিষয়ে নির্বাহী কমিটিতে আলোচনা সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত নেবেন বলে প্রতিনিধিদের জানান। ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, ‘যেকোনো বিরোধ নিষ্পত্তিতে বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ সমাধানে বিশ্বাসী। রোহিঙ্গা সংকট মিয়ানমারের সৃষ্টি। তাদেরই এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। মিয়ানমারের কারণে আজ আমরা সংকটের মুখোমুখি। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীদের কারণে আমাদের কঠিন চাপে পড়তে হয়েছে। এ সংকট নিরসনে আমরা আপনাদের সহযোগিতা চাই। ’ এ সময় অস্ট্রেলিয়ার লেবার পার্টির এমপি মার্গারেট কোয়ার্ক রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের নিন্দা জানানোর পাশাপাশি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে জানতে চান, প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে ভারত ও চীন কিভাবে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করছে? জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরের সময় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বাংলাদেশের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। চীন ইতিমধ্যে সহায়তা পাঠিয়েছে।
ব্রিফিং শেষে আলাপকালে বিভিন্ন দেশের পার্লামেন্ট সদস্যরা বাংলাদেশের পক্ষে তাঁদের অবস্থানের কথা জোরালোভাবে তুলে ধরেন। মালদ্বীপের স্পিকার আব্দুল্লাহ মাসেহ মোহাম্মদ বলেন, ‘আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে মিয়ানমারে এ ধরনের নির্যাতন হচ্ছে, যা জঘন্যতম মানবাধিকার লঙ্ঘন। এটা গণহত্যা। এটা বন্ধ করতে হবে। এ জন্য মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে সিপিএ সম্মেলনে আমাদের প্রস্তাব পাস করতে হবে। ’
যুক্তরাজ্যের হাউস অব লর্ডসের সদস্য জন ফকস বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ যা করছে তা প্রশংসার যোগ্য। মিয়ানমার যা করেছে তা যে গণহত্যা, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এই সম্মেলনে কোনো একটা প্রস্তাব না এনে বাংলাদেশ ত্যাগ করাটা বাংলাদেশের ওপর অবিচার করা হবে। সম্মেলনে অংশ নেওয়া প্রতিনিধিরা কক্সবাজারে গিয়ে রোহিঙ্গাদের দুরবস্থা দেখে আসতে পারেন বলে তিনি প্রস্তাব দেন। আগামী ২৩ নভেম্বর হাউস অব লর্ডসে তিনি বিষয়টি তুলবেন বলেও শ্রতিশ্রুতি দেন।
পাকিস্তানের পার্লামেন্ট সদস্য নাফিজা শাহ বলেন, ‘পাকিস্তানের পার্লামেন্ট ইতিমধ্যে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার খর্বের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের প্রতি আমরা আমাদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করি। বাংলাদেশ একটি কঠিন সময় অতিক্রম করছে, এ বিষয়ে গুরুত্ব দিতে চাই। আমরা চাই মিয়ানমার সরকার দ্রুত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়াসহ সব অধিকার নিশ্চিত করবে। ’
সাউথ ওয়েলসের পার্লামেন্ট সদস্য মো. আজগর বলেন, ‘রোহিঙ্গা সমস্যাটি আমি বুঝি। বাংলাদেশের ওপর যে চাপ এখন চলছে সেটাও সহজে অনুমান করা যায়। এ বিষয়টি নিয়ে সম্মেলনে একটি প্রস্তাব আনা হোক। কমনওয়েলথ একটি বড় প্ল্যাটফর্ম, যেখান থেকে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা যেতে পারে। ’
কানাডার সিনেটর সালমা আতাউল্লাহজান বলেন, ‘মিয়ানমারে যা হয়েছে তা গণহত্যা। আমরা চাই, এ সমস্যার সমাধান হোক। বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়া হোক। ’ তিনি বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের ব্যাপক প্রশংসা করেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার ডেপুটি স্পিকার লেসা সেলোনি বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রতি আমরা একাত্মতা প্রকাশ করি। রাখাইনের ঘটনার নিন্দা জানাই। ’ চলমান সংকট নিরসনে মিয়ানমারের প্রতি চাপ অব্যাহত রাখতে তিনি সব দেশের প্রতি আহ্বান জানান।
মালয়েশিয়ার পার্লামেন্ট সদস্য ড. মো. হাতা রামলি বলেন, ‘আমরা মিয়ানমারে প্রতিনিধিদল পাঠাতে পারি। সেখানে আমাদের বার্তা পৌঁছাতে পারি, যাতে তারা তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেয়। তাদের নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করে এবং সব ধরনের নির্যাতন বন্ধ করে। ’
ক্যামেরুনের এমপি নোয়াম তেবো জন বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রতি আমরা আন্তরিক সহমর্মিতা জানাই। নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ মহানুভবতা দেখিয়েছে। তবে বাংলাদেশের পক্ষে একা এই চাপ সহ্য করা কঠিন হবে। দ্রুত সংকট নিরসন হবে বলে আমি আশাবাদী। ’
এদিকে গতকাল দিনের কার্যসূচি শেষে বিআইসিসি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর ব্রিফিংয়ে রোহিঙ্গাদের ইতিহাস তুলে ধরেছেন। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের সে দেশের নাগরিক বলে অস্বীকার করলেও রোহিঙ্গারা যে সেখানে পার্লামেন্ট সদস্য ছিল তার তথ্য-প্রমাণ তুলে ধরেছে। জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া পাঁচ দফা প্রস্তাবের আলোকে তিনি রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে সিপিএ প্রতিনিধিদের সহযোগিতা কামনা করেন। বলেন, প্রতিনিধিদের সবাই এ ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাঁরা রাখাইনে হত্যা-নির্যাতনের ঘটনাকে গণহত্যা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি তাঁরা এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেওয়া পদক্ষেপের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কাজী নাবিল বলেন, ‘ইতিমধ্যে সিপিএ প্রতিনিধিদের অনেকেই কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন। তার পরও যাঁরা ক্যাম্প পরিদর্শনে যেতে চান, তাঁদের জন্য জাতীয় সংসদের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ সংকট নিরসনে ইতিমধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও সে দেশ সফর করেছেন। আমরা আশা করছি, দ্রুত এ সংকট নিরসন হবে। ’
সংবাদ সম্মেলনে সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ, ফজিলাতুন নেসা বাপ্পি, তানভীর ইমাম ও পংকজ দেবনাথ উপস্থিত ছিলেন।
এশিয়া গ্রুপের বৈঠক : সম্মেলন চলাকালে গতকাল বিকেলে এশিয়া গ্রুপের একটি রিজিওনাল বৈঠকেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরা হয়। এ সময় বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের প্রধান ডেপুটি স্পিকার মো. ফজলে রাব্বী মিয়া বলেন, এ সমস্যা মিয়ানমারের সৃষ্টি, তাই তাদেরই এর সমাধান করতে হবে। পূর্ণ নাগরিকের মর্যাদা দিয়ে নিঃশর্তভাবে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য তিনি মিয়ানমার সরকারের প্রতি চাপ বাড়াতে এশিয়াভুক্ত দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যুটি রেজুলেশন আকারে গ্রহণের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়।