জাতীয়

পাচারকারীদের চোখ রোহিঙ্গা শিশুদের দিকে

By Daily Satkhira

November 09, 2017

ঝড় থেমে গেলে যেমন সবকিছু শান্ত হয়ে আসে, ঠিক তেমনি অবস্থা বিরাজ করছে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে সেনাবাহিনীর নির্যাতন-হামলা-ধর্ষণের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে উপকূলবর্তী বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া বাসিন্দাদের। কিন্তু নূর আলমের চোখে-মুখে সেই স্বস্তি নেই; কারণ গত দুদিন ধরে তিনি তাঁর ছয় বছরের মেয়েটিকে খুঁজে পাচ্ছেন না।

নূর আলমের মেয়ে ফাতিমা পাহাড়ের পাদদেশে ঘরের কাছেই ল্যাট্রিনের কাছে বসে খেলাধুলা করছিল, সর্বশেষ তাকে সেখানেই দেখা গেছে। কিন্তু তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।

প্রচণ্ড রোদের মধ্যে খুঁজতে খুঁজতে হাঁপিয়ে ওঠা নূর আলম ক্রোধের স্বরেই বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলছিলেন, ‘কেউ আমার মেয়েটার কোনো খবর দিতে পারছে না।’ এ সময় নূর আলমের পাশে বসে ছিলেন বাকরুদ্ধ, ক্লান্ত তাঁর স্ত্রী।

‘আমার খুব ভয় হচ্ছে, কেউ যদি আমার মেয়েকে বিক্রি করে দেয়, অন্য কোথাও নিয়ে যায়। অনেকেই আমাকে বলেছে, এখানে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে’, যোগ করেন নূর আলম।

নূর আলমের এই ভয় অমূলক নয়।

নতুন করে সহিংসতা শুরুর পর রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে বিপদসংকুল নদী ও সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে গত দুই মাসে ছয় লাখের অধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, যারা কক্সবাজারের বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। এই শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া বিপন্ন জনগোষ্ঠীর ওপর নারী ও শিশু পাচারকারীদের লোলুপ দৃষ্টি রয়েছে বলে সতর্ক করেছে জাতিসংঘ।

রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) মিয়ানমারের সেনা ও পুলিশ ক্যাম্পে হামলার জের ধরে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের খড়গ নেমে আসে। সেখান থেকে পালিয়ে রোহিঙ্গারা অভিযোগ করেছেন, গ্রামের পুরুষদের ধরে নিয়ে হত্যা করছে সেনাবাহিনী আর নারীরা প্রতিনিয়ত ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। সেনাবাহিনী সেখানে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে। সেনাবাহিনীর সঙ্গে রয়েছে বৌদ্ধ মগরাও।

বলপূর্বক বাস্তুচ্যুতির এই ঘটনা রোহিঙ্গাদের বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘দেশহীন জনগোষ্ঠীতে’ পরিণত করেছে। জাতিসংঘ এই ঘটনাকে ‘জাতিগত নিধনের ধ্রুপদী’ উদাহরণ হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করেছে।

মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে যেসব রোহিঙ্গারা আসছেন তাদের প্রতি ১০ জনের ছয়জনই নারী ও শিশু। এই সুযোগটিকেই কাজে লাগানোর জন্য ওত পেতে বসে আছে পাচারকারীরা। নারী ও শিশুদের গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োগের প্রলোভন দিচ্ছে। এর মধ্যে আবার হাজারো শিশু রয়েছে, যারা রাখাইনের সংঘাতপূর্ণ অবস্থার মধ্যে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একাকী জনস্রোতে ভেসে বাংলাদেশে এসেছে। এদের অনেকেরই বাবা-মা মারা গেছে, অনেকে আবার পরিবারকে হারিয়ে ফেলেছে।

জাতিসংঘের শিশু অধিকার রক্ষাবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের প্রধান জেন লিবি বলেন, ‘এটি মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ একটি অবস্থা। যে কোনো তরুণী পাচারকারীদের ফাঁদে পা দিয়ে ফেলতে পারেন।’

পাচারকারীরা

রোহিঙ্গা যুবক নাজির আহমেদ দুই মাস আগে শরণার্থী ক্যাম্পের ভেতর একটি তথ্যকেন্দ্র স্থাপন করেন। তাঁর কাজ হচ্ছে হারিয়ে যাওয়া শিশুদের খুঁজে বের করে বাবা-মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া। এখন পর্যন্ত এমন এক হাজার ৮০০ হারিয়ে যাওয়া শিশুকে বাবা-মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন নাজির।

নাজিরের তথ্যকেন্দ্রের সম্বল হচ্ছে একটি কাঠের টেবিল আর একটি মাইক। তিনি বলছিলেন, ‘রোহিঙ্গারা এখানে নতুন এসেছে। তাদের জন্য এই জায়গাটা নতুন। অনেক বাচ্চাই নিজেদের ঘর থকে একটু দূরে গেলেই পথ হারিয়ে ফেলে। আর ফিরে আসতে পারে না।’

একদিন সকালে রয়টার্সের প্রতিবেদক তথ্যকেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়ে দেখতে পান সেখানে নাজির আহমেদের চেয়ারের পাশে হারিয়ে যাওয়া দুটি বাচ্চা বসে আছে। মাইকে নাজির বলছেন, ‘রোহিঙ্গা ভাইদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে, হারিয়ে যাওয়া দুটি শিশু পাওয়া গেছে, তারা এখন আমাদের কাছে আছে।’

শিশুদের বর্ণনা দিতে গিয়ে নাজির অব্যাহতভাবে মাইকে বলছিলেন, ‘তাদের গায়ে লাল ও হলুদ টি-শার্ট রয়েছে। একজনের পরনে প্যান্ট নেই, আরেকজনের হাতে একটি খেলনা রয়েছে। কেউ যদি শিশু দুটিকে শনাক্ত করতে পারেন তাহলে তাদেরকে নিয়ে যেতে পারবেন।’

সতর্কতা অবলম্বনের জন্য নাজির শিশুদের নাম বলছিলেন না। কারণ, এটা হচ্ছে শিশুদের পাচারকারীদের হাত থেকে বাঁচানোর কৌশল। বাবা-মাকে এসে শিশুটিকে শনাক্ত করার জন্য ঠিকমতো নাম বলতে হয়, পাশাপাশি শিশুটিকেও আচরণের মধ্য দিয়ে নিশ্চিত করতে হয় যে, আগতরা তার বাবা কিংবা মা।

শুধু হারিয়ে যাওয়া বাচ্চাদের খুঁজে দেওয়াই নয়, নাজির আহমেদ ক্যাম্পের বাসিন্দাদের নারী ও শিশু পাচারকারীদের সম্পর্কেও সচেতন করছেন। এই তো একদিন আগেই সকালবেলা ফুটপাত থেকে একটি শিশুকে চুরির চেষ্টা করছিল। বাচ্চার আচরণে বোঝা যাচ্ছিল ওই ব্যক্তি তার পরিবারের না। পাশের দোকানে বাচ্চাটির আত্মীয় কেনাকাটা করছিল, নাজির সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে তাকে বিষয়টি জানান।

নাজির বলছিলেন, ‘আমরা সব বাবা-মাকেই সতর্ক করে দিয়ে বলছি, এখানে পাচারকারী আছে, তারা যেন তাদের বাচ্চাদের প্রতিমুহূর্ত দেখে রাখে।’

কিছুক্ষণ পরেই নাজিরের সেই দুটি শিশু হারানোর ঘোষণার ফল ফলতে শুরু করল। হঠাৎ করেই একজন নারী এসে নাজিরের টেবিলের সামনে দাঁড়ালেন। লাল-টি শার্টওয়ালা শিশুটি সেই নারীর দিকে দুই হাত বাড়িয়ে দিয়ে প্রথমবারের মতো অনবরত কাঁদতে শুরু করল।

শিশুটির মা দেলোয়ারা বেগম সন্তানকে পাওয়ার আবেগে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘আমার সোনামানিককে আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম। সেদিন সকালে সে তার বাবার পিছু পিছু গিয়ে হারিয়ে যায়।’

‘কেউ কেউ আমাকে বলেছে, ছেলেটি হয়তো মরে গেছে। কেউ বলেছে, হয়তো পাচারকারীদের হাতে পড়েছে। কিন্তু যখন জানতে পারলাম যে, আমার সন্তান এখানে আছে, আমি খুবই খুশি হই। মনে হচ্ছে, আমি যেন হাতে চাঁদ পেয়েছি’, যোগ করেন দেলোয়ারা।

শ্রমদাস

রোহিঙ্গা নারী ও শিশুরা যে বাংলাদেশে শুধু পাচারের ভয়ের মধ্যে আছে, তা নয়। ইউনিসেফ জানাচ্ছে, অনেক বাবা-মা তাদের সন্তানদের শ্রমদাস হিসেবে বিক্রি করে দিচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে কক্সবাজারের বিভিন্ন মাছের আড়তেই যাচ্ছে বেশির ভাগ রোহিঙ্গা শিশু। মাছের মৌসুমের নয় মাসের জন্য শিশুপ্রতি মৎস্য ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে রোহিঙ্গা অভিভাবকরা ১৮ হাজার টাকা পাচ্ছেন। অর্থাৎ প্রতি মাসের একজন শিশুর শ্রম বিক্রি করে বাবা-মা দুই হাজার টাকা কামাই করছেন।

ইউনিসেফ ২০০৬ সালে সহিংসতার মধ্যে পালিয়ে আসা এমন ৪০০ শিশুকে স্কুলে পাঠানোর পাশাপাশি তাদের পরিবারকেও ছোটখাটো ব্যবসা করার সহযোগিতা দিয়েছে। জাতিসংঘের এই সংস্থা সাম্প্রতিক সময়ে যারা এসেছে তাদেরকে এই ধরনের নগদ সাহায্য দেওয়ার পক্ষে, কিন্তু লাখ লাখ রোহিঙ্গা পানি ও ওষুধের মতো জীবনদায়ী জিনিসের জোগান দিতেই তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।

রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পকেন্দ্রিক পাচারকারীদের দৌরাত্ম্য দিন দিন বাড়তে থাকায় আতঙ্কিত ফাতেমার বাবা নূর আলম। তিনদিন টানা খোঁজাখুঁজির পর তিনি ফাতেমাকে কুতুপালংয়ের একটি রাস্তায় খুঁজে পান। তিনি আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘এই সময়ে আমার মেয়েটি সম্পর্কে কেউ কোনো তথ্য  দিতে পারেনি। মানসিকভাবে আমি খুব ভেঙে পড়েছিলাম। এখন আমি খুবই খুশি। আমি জানতেও চাই না, ফাতেমা কোথায় ছিল, কেন গিয়েছিল। আমি তাকে পেয়ে গেছি এটাই যথেষ্ট।’

(রয়টার্সের প্রতিবেদন অবলম্বনে অনুবাদ)