সাধক সংগীতশিল্পী ও নন্দিত বংশীবাদক বারী সিদ্দিকী আমাদের শিল্পভুবনে শোকের ছায়া ফেলে গেলেন সত্য। কিন্তু মাত্র ছয় দশকের স্বল্পজীবন পেয়েও আলোয় ভুবন ভরিয়ে দিয়েছেন গ্রামীণ লোকসংগীত ও আধ্যাত্মিক ঘরানার এই শিল্পী। দুই বছর ধরে বিকল কিডনির দুঃসহ যন্ত্রণা সয়েও কী মোহময়ভঙ্গিতে গান শুনিয়ে গেছেন, ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়!’ শেষ পর্যন্ত হৃদযন্ত্রের দুর্বলতার সঙ্গে পেরে না ওঠে ভক্তের মণিকোঠায় স্মৃতি হয়ে গেলেন তিনি। গভীর শোক ও প্রাণান্ত শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রিয় শিল্পী বারী সিদ্দিকী।
বারী সিদ্দিকী একনিষ্ঠ সংগীত অন্তপ্রাণ মানুষ ছিলেন। সংগীতে হাতেখড়ি পেয়েছিলেন পরিবার থেকেই। নিজের জন্মস্থান নেত্রকোনার শিল্পী ওস্তাদ গোপাল দত্তের সান্নিধ্য পান মাত্র ১২ বছর বয়সেই। তার পর একে একে ওস্তাদ আমিনুর রহমান, দবির খান, পান্নালাল ঘোষের কাছে সংগীতের মৌলিক প্রশিক্ষণ নেন। পরবর্তী সময়ে বাঁশির প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং বাঁশির ওপর উচ্চাঙ্গসংগীতে প্রশিক্ষণ নেন। ভারতের পুনের পণ্ডিত ভিজি কার্নাড ছিলেন বারী সিদ্দিকীর শিক্ষক। নব্বইয়ের দশকে পুনে থেকে দেশে ফিরে লোকসংগীতের সঙ্গে উচ্চাঙ্গসংগীতের ফিউশনে স্বল্প পরিসরে গান গাওয়া শুরু করলেও বাঁশি বাজিয়ে জয় করেন শ্রোতা ও ভক্তের মন।
ক্লাসিক্যাল মিউজিকের ওপর পড়াশোনা করা বারী সিদ্দিকী নেত্রকোনার মানুষ। ১৯৯৯ সালে নেত্রকোনার আরেক কিংবদন্তি কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের নজরে পড়েন এই শিল্পী। ওই বছর মুক্তি পাওয়া হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’-এ ছয়টি গানে কণ্ঠ দেন বারী সিদ্দিকী। সেই সিনেমায় গাওয়া ‘শুয়াচান পাখি আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি’, ‘পুবালি বাতাসে’, ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’, ‘ওলো ভাবিজান’, ‘মানুষ ধর মানুষ ভজ’ গানগুলো এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
এর আগে ১৯৯৫ সালে হুমায়ূন আহমেদ নির্মিত টিভি ম্যাগাজিন ‘রঙের বাড়ই’-তে জনসমক্ষে প্রথম সংগীত পরিবেশন করে ওই লেখকের দৃষ্টি কাড়েন অকালপ্রয়াত এই শিল্পী। এরপর আর বারী সিদ্দিকী পেছন ফিরে তাকাননি। হুমায়ূন আহমেদের হাত ধরে বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় বংশীবাদক হয়ে উঠলেন সাধারণ মানুষের প্রিয়তর শিল্পী। একে একে অন্য চলচ্চিত্রেও তিনি বেশ কিছু গান গেয়ে নিজের কণ্ঠপ্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। বেরিয়েছে বারী সিদ্দিকীর একক অ্যালবামও।
১৯৯৯ সাল বারী সিদ্দিকীর জন্য দুদিক থেকে পয়মন্ত ছিল। ওই বছর তিনি হুমায়ূন চলচ্চিত্রে যেমন ব্রেকথ্রু পান, তেমনি সে বছর জেনেভায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব বাঁশি সম্মেলনে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণ করার গৌরব অর্জন করেন।
সর্বশেষ গেল ১৩ নভেম্বর কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ৬৯তম জন্মবার্ষিকীতে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে সরাসরি অনুষ্ঠানে নিজের জনপ্রিয় গানগুলো গেয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছেন বারী সিদ্দিকী।
জীবনের শেষদিকে নিজের একটি টুপি পরে দর্শক-শ্রোতাদের সামনে হাজির হতেন এই শিল্পী। গান গাইতে গাইতে এক আধ্যাত্মিক ভাবগাম্ভীর্য রচনা করে ঐশ্বরিক বন্দনায় মেতে উঠতেন তিনি। সুরের সাধনায় মহান স্রষ্টার আরাধনা করবার ভঙ্গিমাটা বারী সিদ্দিকীর একান্ত নিজস্ব। সুর ও সংগীতের ইন্দ্রজালে নিজে কাঁদতেন আর ভক্তদেরও সমান কাঁদাতেন। মহামুণি অ্যারিস্টটলের ট্র্যাজিক বিমোক্ষণ কিংবা গ্রন্থিমোচনের সত্যিকারের স্বাদ পাওয়া যেত বারী সিদ্দিকী উপস্থাপিত মৃত্তিকাসংলগ্ন সংগীতে।
বাংলার হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া বারী সিদ্দিকী যদি তাঁর মোহন বাঁশিতেই মেতে থাকতেন, তবু শিল্পাকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়েই বিরাজ করতেন। তার ওপর তিনি এমন কিছু সুর সৃষ্টি করে গেছেন, যা তাঁকে যুগের পর যুগ সূর্যের মতোই দেদীপ্যমান রাখবে। তাঁরই উদ্দেশে আমরা গাইতে থাকব :
তুমি আমি জনম ভরা ছিলাম মাখামাখি, আজ কেন হইলে নীরব মেলো দুটি আঁখি। শুয়াচান পাখি আমার শুয়াচান পাখি আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি।
প্রত্যেক প্রাণকেই চিরায়ত ঘুমের সকাশে যাত্রা করতে হয়, এটা অবশ্যম্ভাবী। হাজার ডাকেও অনন্তরের পা রাখা সেই ঘুমকাতুরের জাগরণ হয় না। প্রেমাস্পদ জীবিত প্রাণের সঙ্গে অশেষ মাখামাখিতেও আর ঘুচে না বিচ্ছেদের বিয়োগব্যথা। শিল্পী বারী সিদ্দিকী নিজের গানেরই আজ ট্র্যাজিক নায়ক। আমাদের হৃদয় বিদীর্ণ করে দিয়ে শিল্পী নিজেই আজ শুয়াচান পাখি। স্মরণের আলোয় যাঁকে আমরা ডেকে ফিরব, কিন্তু তিনি আর বাঁশের বাঁশরি হাতে আর সাড়া দেবেন না।
কলাজ্ঞ শ্রোতার শ্রবণ কুহরে বাংলা সংগীতের যে বর্ণিল তরঙ্গ ধ্বনি দিয়ে গেলেন বারী সিদ্দিকী, তার প্রাপ্তিতেই স্বস্তি ও আনন্দ খুঁজব আমরা। বাংলা গানের সহস্র বছরের সাধনায় বারী সিদ্দিকী প্রশান্তির বারি বর্ষণ করে যাক। বাংলা শিল্প রুচির সামগ্রিক অধঃপতন ঠেকাতে বারী সংগীত হোক অনন্য অনুপ্রেরণা।
আমাদের আকাশে বাতাসে বারী সিদ্দিকীর সুর ধ্বনিত হতে থাকবে অনেক অনেক দিন। তাঁর গানের সুর-সংগীত হবে শোক ভোলানোর মন্ত্র।
লেখক : ফারদিন ফেরদৌস, সংবাদকর্মী।