কালিগঞ্জ

সাতক্ষীরা কারাগার থেকে মুক্তির পর ঠিকানা খুঁজে পেলো বরকতী ও রাশিদা

By Daily Satkhira

December 03, 2017

এস এম, আহম্মাদ উল্যাহ : বরকতী বিবি, বাবার নাম কালা হাফেজা বয়স আনুমানিক (৪৫) ঠিকানা অজ্ঞাত। অপরজন রাশিদা, বাবার নাম আলিম, বয়স আনুমানিক (৫৫) ঠিকানা অজ্ঞাত। এসব হয়তো তাদের সঠিক নাম নয়। যে কোন ভাবে পুলিশের খাতায় বা বিচারের নথীতে লেখা পড়েছে এসব নাম। রোববার দুপুরে তারা সাতক্ষীরা জেলা কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তাদের কাছে ছিল একটি করে বস্তা। বস্তার ভিতরে রয়েছে কতক আসামির রেখে যাওয়া ভালবাসার নতুন বা পুরাতন বস্ত্র। কারা কর্তৃপক্ষের কাছে তারা দু’জনেই বুদ্ধি প্রতিবন্ধি। দীর্ঘকাল কারাভোগ করার পর বাইরে আসতে পেরে তারা যার পর নেই খুশী চোখে মুখে স্বতির ছাপ। এরপর সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার তারালী ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে তাদেরকে বসবাসের ঠিকানা করে দেওয়ার খবরে তারা ফিরে পেয়েছেন নতুন জীবন। সাতক্ষীরা কারাগার সূত্রে জানা গেছে, ২০০৫ সালের ৩১ মে সাতক্ষীরার তালা থানার একটি শিশু অপহরণ মামলায় (জিআর-১২৬/২০০৫) পুলিশ বরকতী ও রাশিদাকে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠায়। এ সময় তারা তাদের নাম ও ঠিকানা সঠিক করে বলতে পারেনি। পরবর্তীতে পুলিশ ওই মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। ২০০৭ সালের ২৮ জুন সাতক্ষীরার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক তাদের প্রত্যেককে ১৪ বছর করে সশ্রম কারাদন্ডের নির্দেশ দেন। বিচারক ওই দু’ নারীর হাজতবাসের সময়কাল সাজার সঙ্গে যুক্ত করেননি। এরপর থেকে তারা কয়েদী হিসেবে সাতক্ষীরা কারাগারে ছিলেন। কালিগঞ্জের চম্পাফুল ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এনামুল হোসেন ছোট জানান, তার ইউনিয়নের দু’জন বুদ্ধি প্রতিবন্ধি একটি মামলায় দীর্ঘদিন জেল খানায় রয়েছে বলে এক মাস আগে তাকে অবহিত করেন জেলার তুহিন কান্তি খাঁন। তারা নিজেদের নাম ঠিকানা বলতে পারেন না। তাই তাদেরকে একবার দেখতে আসার জন্য তাকে বলা হয়। দু’দিন পর তিনি তার ইউনিয়নের ট্যাক্স আদায়কারি অম্মত আলী সরদারকে নিয়ে কারাফটকে আসেন। তাদেরকে তারা চিনতে পারেননি। কিন্তু এ দু’জনকে কোন উপায়ে পূর্ণবাসন করা যায় কিনা এ জন্য জেলার তার কাছে সহযোগিতা চান। কারা সুপার-ইন-টেনডেণ্ট আবু জাহেদ ও জেলার তুহিন কান্তি খান জানান, তারা চলে গেলে এদের মুক্তি পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। মুক্তি পেলেও তাদের ঠিকানা মিলবে না। এনামুল হোসেন ছোট বলেন, কারা কর্তৃপক্ষের কথা শুনে তিনি ওই দু’ নারীকে পূর্ণবাসনের দায়িত্ব দেন। কথা বলেন তার পরিষদের নারী ও পুরুষ সদস্যদের সঙ্গে। একপর্যায়ে রোববার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে তিনিসহ সংরক্ষিত নারী সদস্য সেলিনা খাতুন, ইউপি সদস্য শহীদুল ইসলাম, বাবুল আক্তার, কবীর হোসেন, ট্যাক্স আদায়কারি অম্মত আলী সরদার, দৈনিক প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিনিধি কল্যাণ ব্যানার্জী, দীপ্ত টেলিভিশনের সাতক্ষীরা প্রতিনিধি রঘুনাথ খাঁ কে সাথে নিয়ে সাতক্ষীরা কারা ফটকে আসেন। সেখানে তিনি যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তার ইউনিয়নের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের থাকার জন্য বরেয়ার গুচ্ছগ্রামের দু’টি ঘরসহ স্যানিটেশন ব্যবস্থা ও কমপক্ষে একটি বছরের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা নিশ্চিত করে সেখানে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেন। এরই অংশ হিসেবে কারা ফটকের মধ্যে তাদেরকে দু’টি নতুন শাড়ি পরানো হয়। যদিও দীর্ঘ কারাবাসের সময় শালোয়ার কামিজ পরার পর কাপড় পরার অভ্যাসটা তাদের কাছে নতুন বলে মনে হচ্ছিল। সেখানে তাদেরকে তত্ত্বাবধায়নের জন্য কয়েকজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সবকিছুর মধ্য দিয়ে তাদেরকে নিজ ঠিকানা পাইয়ে দেওয়ার জন্য সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মীসহ সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দের সহযোগিতা কামনা করা হচ্ছে। এদিকে রোববার বিকেল সাড়ে চারটার দিকে বরেয়া গুচ্ছগ্রাম থেকে পাওয়া খাবরে জানা গেছে, বরকতী ও রাশিদাকে গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দারাই তাদের রান্না খাবার খাইয়েছেন। সকলের সঙ্গে মিশতে পেরে তারা মহা খুশী। গুচ্ছগ্রামকে তারা নিজের বাড়ি হিসেবে মেনে নিয়েছে। এরপরও স্বজনদের না পাওয়ার বেদনা তাদের চোখে মুখে ফুঁটে উঠেছে। তবে কয়েকজন মানবাধিকার কর্মী জানান, ২০০৫ সালে বরকতী ও রাশিদা ভবঘুরে জীবনযাপনের সময় একটি বাচ্চাকে আদর করার সময় তাদেরকে ছেলে ধরা হিসেবে মারপিট করে পুলিশে দেওয়া হয়। মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী যদি যথাযথ দায়িত্ব পালন করতেন তাহলে ওই দু’ বুদ্ধি প্রতিবন্ধির দীর্ঘ সাড়ে ১২ বছর এভাবে কারাগারে কাটতো না। সাতক্ষীরা কারাগারের সুপার-ইন-টেনডেণ্ট আবু জাহেদ ও জেলর তুহিন কান্তি খান জানান, ১৪ বছর সাজার মধ্যে বরকতী ও রাশিদা প্রত্যেককে ৬২৭ দিন কারা আইন অনুযায়ি ছুটিসহ (রিয়াদ) ১২ বছর ছয় মাস এক দিন কারাভোগ করেছেন। বিচারের রায় ঘোষণার আগে তারা প্রায় দু’ বছর জেল হাজতে ছিলেন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে তাদের প্রত্যেককে ১৪ বছর করে কারাদন্ড দিলেও হাজতীর মেয়াদ কারাদন্ডের সঙ্গে যুক্ত (কনগ্রেড) করার কথা উলে¬খ ছিল না। তবে ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের এক আদেশে ফৌজদারি দন্ডবিধির ৩৫(এ) ধারায় কোন আসামীর সাজার মেয়াদ হাজতে থাকার কার্যকাল ও কয়েদী থাকার কার্যকাল স্বাভাবিক নিয়মেই একসঙ্গে যুক্ত হবে বলে উল্লে¬খ করায় রোববার বরকতী ও রাশিদাকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব হয়েছে। দু’জন বুদ্ধি অথবা মানসিক প্রতিবন্ধি নারীকে একটি ঠিকানা খুঁজে দিতে পেরে তারা যথেষ্ট আনন্দিত। মুক্তির সময় ওই দু’ নারীকে এক হাজার করে টাকা দেওয়া হয়েছে। ওই দু’ নারী কালিগঞ্জের বরেয়া গুচ্ছগ্রামে কিভাবে থাকছে তা তারা প্রতিনিয়ত খোঁজ খবর রাখবেন। এ নিয়ে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গেও তারা কথা বলবেন।