ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য রাজস্থানে এক মধ্যবয়সী মুসলমান ব্যক্তিকে গত বুধবার নৃশংসভাবে হত্যার পর তার ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। আরেকটি ভিডিওতে অভিযুক্ত হত্যাকারীকে হামলার স্বপক্ষে যুক্তি দিতে শোনা যায় ”মুসলিমদের হাত থেকে হিন্দুদের সম্মান রক্ষার খাতিরে এই হামলা।” বিবিসি হিন্দির সাংবাদিক দিলনাওয়াজ পাশা গিয়েছিলেন নিহত মুহম্মদ আফরাজুল রাজস্থানের যে বাড়িতে থাকতে সেখানে।
মাটির বড় উনুনটা কয়েকদিন ধরে নিভেই আছে। যে বড় পাত্রটায় রান্না হত, সেটাও ঠাণ্ডা হয়ে গেছে আগেই।
পাশেই পড়ে রয়েছে কোদাল, শাবল – ঠিক যে ভাবে বুধবার সকালে রাখা ছিল, সেভাবেই রাখা।
ছোট্ট ঘুপচি ঘরের তক্তপোষে পড়ে ছিল হিসাবের খাতাটা – যিনি হিসাব কষছিলেন, তিনি যেভাবে ছেড়ে গিয়েছিলেন, সেভাবেই খোলা পড়ে রয়েছে ওটা।
একটা পুরনো বাক্সের ওপরে টি ভি রয়েছে – সেটাও বন্ধ। পাশেই এক বস্তা আলু। অনেকের খাবার রান্না হতো এই ঘরেই।
ঘরের বাইরে একটা থালায় পড়ে ছিল দুটো মোটা মোটা রুটি। দেখে মনে হচ্ছিল কাজ থেকে ফিরে এসে কেউ রুটি খাবে, তারই অপেক্ষা।
দরজার বাইরেই বেশ কয়েক জোড়া জুতো-চপ্পল পড়ে আছে, যেন কেউ তাড়াহুড়োয় চটি পড়তে ভুলে গেছে।
এটাই মালদার সৈয়দপুর গ্রামের বাসিন্দা আফরাজুলের বাসস্থান।
এখানেই বছর পঞ্চাশেকের আফরাজুল তার ভাগ্নে ইনামুল, জামাই মুশারফ শেখ ছাড়া গ্রামের আরও কয়েকজনের সঙ্গে থাকতেন – গত বুধবার পর্যন্ত।
সেদিনই নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় আফরাজুলকে, আর গোটা হত্যাকাণ্ড ভিডিও করে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
ঘটনার পরেই ওই ঘরের অন্য বাসিন্দাদের মধ্যে কয়েকজন তো পশ্চিমবঙ্গে চলে গেছেন আফরাজুলের মরদেহ নিয়ে। আর যারা রয়ে গেছেন রাজসমুন্দে, তারাও অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন।
তাদের আর সাহস হচ্ছে না এই ঘরে ফিরে আসার।
বাড়ির মালিক পণ্ডিত খেমরাজ পালিওয়ালকে থাকতেই হচ্ছে ওই বাড়িতে। চোখের জল সামলিয়ে তিনি শুধু এটুকুই বলতে পারলেন যে এরকম নিরীহ একজন মানুষের সঙ্গে এই নৃশংসতা!!
অটোরিকশা চালক রামলাল গত নয়-দশ বছর ধরে আফরাজুল আর তার সঙ্গী-সাথীদের নিজের গাড়িতে চাপিয়ে কাজের জায়গায় পৌঁছিয়ে দিতেন।
“খুবই ভদ্র আর ভালমানুষ ছিলেন আফরাজুল। চা খেতে ভালবাসতেন। আমাকেও বারে বারে চা খাওয়াতেন।”
আফরাজুলের হত্যার ভিডিওটা সাহস করে দেখতে পারেন নি রামলাল।
রাজসমুন্দে ১২-১৩ বছর আগে এসেছিলে আফরাজুল – দিন মজুরীর কাজ করতে।
ধীরে ধীরে দিন মজুর থেকে ঠিকাদার হয়ে উঠেছিলেন তিনি। রাস্তা তৈরির ঠিকাদারি করতেন তিনি – অন্য ঠিকাদারদের থেকে কাজ নিয়ে কিছুটা কম মজুরিতে করিয়ে দিতেন তিনি।
কাজের সুবিধার জন্য একটা মোটরসাইকেল কিনেছিলেন – যার নম্বর প্লেটের শেষ তিনটে সংখ্যা ছিল ৭৮৬।
হাজার বিশেক টাকা দিয়ে সম্প্রতি একটা স্মার্ট ফোন কিনেছিলেন আফরাজুল – যেটা তার নিথর দেহের সঙ্গেই জ্বালিয়ে দিয়েছে হত্যাকারী শম্ভূলাল।
আফরাজুলের দুই বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বড় জামাই মুশারফ শেখ শ্বশুরের সঙ্গেই থাকতেন।
“মঙ্গলবার বৃষ্টি হচ্ছিল, তাই আমরা আধা-দিন কাজ করেই ফিরে এসেছিলাম। বুধবারও হাল্কা বৃষ্টি পড়ছিল, তাই কাজ শুরু করতে পারি নি আমরা। দু’জন মজদুর রান্না করেছিল, আমরা সবাই মিলে খাওয়া দাওয়া করেছিলাম। উনি চা খাওয়ার জন্য বাইরে বেরিয়েছিলেন। বেলা সাড়ে দশটার দিকে ফোন করে শ্বশুর মশাই বলেন যে হিসাব করে যেন শ্রমিকদের পাওনাগণ্ডা মিটিয়ে দিই, উনি একটু পরে ফিরছেন,” বলছিলেন মুশারফ শেখ।
তিনি আরও জানাচ্ছিলেন, “ফের সাড়ে এগারোটা নাগাদ ফোন করে বকা দিলেন যে সারাদিন শুয়ে বসে থাকলে মজুরদের পয়সা কে দেবে! তারপরে উনার সঙ্গে আর কোনও কথা হয় নি। বলেছিলেন মিনিট দশেকের মধ্যেই ফিরবেন। উনি ফেরেন নি। আমি ঘরেই শুয়েই ছিলাম।”
দুপুরবেলা মুশারফকে এক পরিচিত লোক ফোন করে জানায় যে আফরাজুলের অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। প্রথমে মুশারফ ভেবেছিলেন যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা।
কিন্তু যখন সেখানে পৌঁছলেন, তখন অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার অবস্থা তার।
“প্রথমে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না যে কী করে ওরকম হল! হাউ মাউ করে কেঁদে ফেলেছিলাম ওখানে বসেই,” বলছিলেন আফরাজুলের জামাই মুশারফ।
পরে তিনি ভিডিওটাও দেখেছেন, আর তখন থেকে মুখে কিচ্ছু তুলতে পারেন নি।
এতোটাই ভয় পেয়ে গেছেন তিনি যে বাড়ির মালিকের ভরসা সত্ত্বেও ওই ঘরে আর থাকতে পারেন নি এক মুহূর্তের জন্যও। অন্য এলাকায়, গ্রামের মানুষের সঙ্গে থাকছেন তিনি।
আফরাজুলের ভাগ্নে ইনামুল বলছিলেন, “পেটের টানে এখানে কাজ করতে আসি আমরা। পেটের জ্বালায় ঘর ছেড়ে এতদূর এসে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বড়জোর ৮-১০ হাজার টাকা রোজগার করি। ভারতের মানুষ দেশের যে কোনও জায়গায় গিয়েই তো কাজ করতে পারে। কিন্তু সরকার যদি এরকম ঘটনা বন্ধ না করতে পারে, তাহলে কিসের ভরসায় মানুষ কাজ করতে অন্য জায়গায় যাবে?”
এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের প্রশ্নে ইনামুল বলেছেন, “আমাদের শরীর মন অবশ হয়ে গেছে ওটা দেখে। আমরা কীভাবে বিচার করবো? গরীব, কমজোর মানুষ আমরা। বিচার করা তো সরকারের দায়িত্ব। যদি ওই লোকটাকে ফাঁসি দিতে পারে সরকার, তাহলেই আমরা ভরসা পাব, নিরাপদ মনে হবে নিজেদের। আর যদি সে জামিন পেয়ে যায়, কী করব আমরা? গ্রামে ফিরে যাব!”
আফরাজুলকে যে কেন হত্যা করা হল, তা এখনও বুঝে উঠতে পারছেন না মুশারফ, ইনামুল বা বরকত আলিরা।
‘লাভ জিহাদ’ শব্দটাও তারা নতুন শুনছেন।
বরকত আলি মালদায় আফরাজুলের গ্রামের কাছেই থাকেন আর তার সঙ্গে মজদুরি করতেই রাজস্থানে গেছেন। বলেন, “আমরা দু’বেলা দুটো খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার জন্য বাড়ি ছেড়ে হাজার কিলোমিটার দূরে থাকি। এখানে কে প্রেম করতে আসে আর কে-ই বা জেহাদ করতে আসে! পেটের খিদের থেকে বেশী কিছু আমাদের চিন্তাতেই আসে না।”
রাজসমুন্দের যে মেহতা মঙ্গরী এলাকায় আফরাজুলের বাসা, সেখানকার কয়েকজন স্থানীয় যুবকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল।
এক হিন্দু যুবক বলছিলেন, “যদি মেনেও নিই যে তিনি কোনও ভুল কাজ করেছিলেন, কিন্তু এই ভাবে তাকে মেরে ফেলার অধিকার কারও নেই। পুলিশ প্রশাসন ছিল তো, তাদের কাছে অভিযোগ জানানো যেতো।”
বাড়ির মালিক খেমরাজ পালিওয়ালের মেয়ে বি এ পড়ছে।
তার কথায়, “কেউ কোনও দোষ করে থাকলে তার জন্য তো পুলিশ আছে। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার কে দিয়েছে?”
কিন্তু আফরাজুলের দোষটা কী ছিল?
“তার দোষ বোধ হয় এটাই যে সে সহায়সম্বলহীন ছিল, মজদুরি করতো আর মুসলমান ছিল।”
সূত্র : বিবিসি বাংলা