মাহফিজুল ইসলাম আককাজ : আধুনিক যুগেও মধ্যযুগীয় প্রচারণার শব্দ দূষণে অতিষ্ঠ সাতক্ষীরা শহরবাসী। প্রচারণার ক্ষেত্রে মাইকের ব্যবহার এখনো ব্যবসায়ীদের কাছে আস্থার প্রতীক। আর এ কারণে শব্দ দূষণ মাত্রারিক্তভাবে বেড়ে চলেছে। শব্দ দূষণের ক্ষেত্রে মাইকের পাশাপাশি গাড়ির হাইড্রোলিক হর্নও মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে জনজীবনে। জেলা শহর ছাড়াও মফস্বল শহরের অফিস, আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ ব্যক্তিগত গাড়ি অনেক বেশি। বছরের সকল সময়ে মাইক ও স্পিকার বাজিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রচার প্রচারণা চালানো, পোল্ট্রি মুরগী, গরু, মহিষের মাংস বিক্রয়ের বিজ্ঞাপন, মোবাইল কোম্পানির সিম বিক্রি, ব্যক্তিগত গাড়ি ও গণপরিবহনের হর্নের শব্দে অতিষ্ঠ সাতক্ষীরাবাসী। এছাড়াও কোচিং নিয়ে মাইকে প্রচারণা বৃদ্ধি পেয়েছে। সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা যায়, পৌরশহরে প্রতিদিন প্রায় ১০ থেকে ১২টি গাড়ি মাইক নিয়ে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পোল্ট্রি মুরগী, গরু, মহিষ মাংস বিক্রয়ের বিজ্ঞাপন, স্লোগান নানা অফার, বিভিন্ন ক্লিনিকে ডাক্তারদের রোগী দেখার (বিএমডিসি’র নিয়ম অনুযায়ী এটা করার কোন সুযোগই নেই) বিজ্ঞাপনী প্রচার বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। এতে প্রতিনিয়ত মানুষজন নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। বধির হওয়া থেকে শুরু করে মাথায় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে স্কুল ও কলেজগামী শিক্ষার্থীদের উপর এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, অথচ বিজ্ঞাপনের জন্য মানুষ এখনও মাইক চালায়। আরকি কোন মাধ্যম নেই? সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের নাক, কান ও গলার চিকিৎসক ফারুকুজ্জামান বলেন, অতি উচ্চ মাত্রায় শব্দ দূষণের ফলে যে কোন বয়সে মানুষের শারিরীক ও মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। তবে শিশুদের মধ্যে এ ঝুঁকি বেশি। শহরের একজন প্রবীণ নাগরিক বলেন- “বাবা শহরে শব্দ দূষণে খুবই অতিষ্ঠ। হয়তো কিছুদিন বাঁচতাম তা আর হবে নাÑ মাইকসহ গাড়ির হর্নের শব্দে। খালি আওয়াজ আর আওয়াজ। বাড়ির আশেপাশে রাস্তায় মাইকের আওয়াজ গাড়ির হর্নের শব্দে মানব জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে।” শহর ছাড়াও প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিভিন্ন পয়েন্টে স্কুলগামী ছাত্র ছাত্রীরা গাড়ির হর্ন এর কারনে কানে হাত দিয়ে দাড়িয়ে যায়। তাদেরকে এসময় খুব আতংকিত মনে হয়। শুধু শহর নয় শব্দ দূষণের এ মাত্রা গ্রামের হাট-বাজার এলাকাসহ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। শুধু পৌরশহরে নয় গ্রামাঞ্চলে ও নানা ভোগান্তির সাথে শব্দ দূষণ একটি নিয়মিত ভোগান্তিতে রুপ নিয়েছে। সকাল বিকেল, রাত গভীর রাত পর্যন্ত শহরের হাট বাজার মাঠ, রাস্তা সর্বত্রই শব্দ দূষণ অনিয়ন্ত্রিত, মাইকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ না থাকায় এ শব্দ দূষণের মাত্রা অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। মসজিদ, মন্দির, গীর্জায় ইবাদত, প্রার্থনারত, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রী, মেডিকেল, ক্লিনিকের অসুস্থ রোগীদের জন্যে শব্দ যন্ত্রণায় অস্বস্থিকর অবস্থার পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। শহরে যান চলাচলে অযৌক্তিকভাবে হর্নের আওয়াজ হৃদরোগী, হার্টরোগী, নারী-শিশুদের মারাত্মকভাবে শব্দ দূষণের কারণে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এব্যাপারে সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ নূর হোসেন সজল বলেন, মাসিক আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় মাইকের শব্দ ও গাড়ির হাইড্রোলিক হর্নের দ্বারা শব্দ দূষণের ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। আমরা বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। নাগরিকদের দৈনন্দিন প্রয়োজনে রাস্তা মার্কেট, বাজারে বের হতে হয়, ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুল কলেজে শিক্ষার উদ্দেশ্যে বের হতে হয়, পথে তাদের পড়তে হচ্ছে শব্দ দূষণের কবলে। গাড়ীর হর্নের বিকট আওয়াজ রাস্তায় গাড়ীতে যাত্রী চলাচলের অনিরাপদ হয়ে পড়ছে, প্রশাসন, সামাজিক ও পরিবেশবাদী সংগঠনসমূহ মাঝে মধ্যে দু’একটা কথা বললেও প্রশাসনের তেমন গরজ দেখা যায় না। শব্দ দূষণের ফলে হৃদরোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, অতিমাত্রায় গাড়ীর হর্ন বাজানো, প্রয়োজন অপ্রয়োজনে গাড়ীর হর্ন, মাইকিং নিয়ন্ত্রণে আনা দরকার। আইন থাকলেও আইনের যথাযথ প্রয়োগ মাঠে দেখা যাচ্ছে না। ফলে শব্দ দূষণের হাত থেকে নাগরিক জীবন অতিষ্ঠ হয়ে আছে। এ অবস্থার পরিবর্তন হওয়া চাই। অনুষ্ঠান আয়োজনকারীদেরকে আইনের মাধ্যমে যেখানে অনুষ্ঠান সেখানেই মাইকের ব্যবহার সীমাবদ্ধ রাখতে বাধ্য করতে হবে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত মাইকের ব্যবহার, হর্ন বন্ধ করতে হবে। আইনগতভাবে রাস্তায় একাধিক মাইক ব্যবহারে কঠোর হতে হবে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনকে। মাইকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে পৌরসভা ও থানা পুলিশকে মাইকের সংখ্যা উল্লেখ পূর্বক অনুমতি থাকতে হবে। মানুষ জন চলাচলের বাইরে বিল বা স্কুল মাঠে অনুমতি সাপেক্ষে মাইক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে মাইক ব্যবহার করা যায়, এর পাশে রাস্তার পাশে মিটিংয়ের নামে দীর্ঘ এলাকা জুড়ে মাইকের ব্যবহার নাগরিকগণ ভালভাবে দেখছে না। এতে করে আয়োজনকারীদের প্রতি বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। একজনের দেখাদেখি অন্যজনেরাও লোকের চেয়ে মাইকের ব্যবহার বেশি করতে দেখা যাচ্ছে। উচ্চস্বরে কথা বলা, আওয়াজ করা, মোবাইলে বিকট আওয়াজে বাক্য বিনিময় করা, হাঁটা চলায় অন্যের ক্ষতি করে হাত পা নেড়ে ফুটপাত দখল করে হাঁটা গাড়ীর হর্ন মাত্রাতিরিক্তভাবে বাজানো, যত্রতত্র গাড়ী পার্কিং, ফুটপাত দখল করে যান চলাচলে বিঘœ সৃষ্টি করা সবকিছুই আইনগত অপরাধ। শব্দদূষণ, শব্দ সন্ত্রাস, শব্দ দিয়ে মানুষকে কষ্ট দেয়া অপরাধ। এ অপরাধ থেকে বিরত থাকতে হবে। হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার আইনত নিষিদ্ধ। তারপরও হাইড্রোলিক হর্ন বাজানো হচ্ছে। সারাদেশের বিভিন্ন অংশে এ হর্নের বিকট আওয়াজে পথচারীরা অতিষ্ট। বিশেষজ্ঞদের মতে শব্দ দূষণের ফলে শ্রবণ শক্তি ও মনোবল কমে যায়, রক্ত চাপ বেড়ে যায়। হাইড্রোলিক হর্ন নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও এক শ্রেণির চালক তা মানছেন না। ১৯৮৬ সালের মোটরযান বিধিমালা এবং ২০০৬ সালের শব্দ দূষণ বিধিমালায় হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দুঃখজনক হলেও তার ব্যবহার বিদ্যমান। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকদের চোখের সামনেই আইন ভঙ্গের এ কাজটি চলছে। তারা নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। মসজিদ, মন্দির, গীর্জা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আশপাশে সব ধরনের হর্ন বাদ্যবাজনা বাজানো নিষিদ্ধ। নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন ও সজাগ থাকতে হবে। আশা করছি প্রশাসন আর দেরি না করে হাইড্রোলিক হর্নের যন্ত্রণা ও মাইকের আওয়াজ থেকে মুক্তি দিয়ে শব্দ দূষণ থেকে জাতিকে রক্ষা করবেন। জাতি সেটাই প্রশাসনের কাছে প্রত্যাশা করে। এবিষয়ে সাতক্ষীরা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইন্সপেক্টর মারুফ আহম্মেদ বলেন, বিষয়টি আমাদের চিন্তায় রয়েছে। আমরা শহরের পরিবশে নষ্ট করে এমন মাইকিং নিয়ন্ত্রণে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করব।