সাতক্ষীরা প্রতিনিধি: এ যেনো এক যুদ্ধজয়ের ইতিহাস। গ্রামের লোকজন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন কখন ফিরবে তাদের মেয়ে। উদ্বেগ আর উৎকন্ঠায় দিন কাটিয়েছে বাড়ির সদস্যরাও। অবশেষে এক মাসের ছুটিতে মুক্তামনি বাড়ি আসছে। তাই আনন্দে আত্মহারা সবাই। গতকাল শুক্রবার রাতে একটি এ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি কামারবায়সায় ফিরে এসেছে মুক্তামনি। ছয় মাস আগের মুক্তামনি আর আজকের মুক্তামনি এক নয়। এখন তার দেহে ভার একটু হলেও কমেছে। বিরল রোগটি কিছুটিা হলেও বিদায় নিয়েছে। মার্বেলের মতো একটি ছোট গোটা থেকে বৃক্ষমানবের মতো গজিয়ে ওঠা তার ডান হাতটি পচে উঠেছিল। মুক্তামনি জানায়, ডাক্তাররা সব চেষ্টা করেছেন। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ আমার চিকিৎসার দায়িত্ব গ্রহনের জন্য। এখনও পুরাপুরি ভালো হইনি। যন্ত্রনা আছে। হাত আবার ভারি হয়েছে। তবে পচন নেই , পোকাও নেই। এর আগে হাতের ক্ষতস্থানে পোকা জমেছিল। সেদিন মুক্তার ধারে ভিড়তো না কেউ। আত্মীয় স্বজনও মুক্তাদের বাড়িতে আসতো না , মুক্তার রোগকে ঘৃণা করতো। কিন্তু সে দিনের অবসান ঘটেছে। এখন এক অন্যরকম মুক্তামনি ফিরে এসেছে গ্রামে। মুক্তা এখন খেলবে। সে পড়বে । আর গান গাইবে প্রাণ খুলে। তবে আর কিছুদিন পর। কারণ মুক্তা এখনও পুরোপুরি সুস্থ নয়। মুক্তামনির বাবা মো. ইব্রাহিম বলেন, প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব নিয়েছিলেন বলেই মেয়ের চিকিৎসা সম্ভব হলো। এজন্য ধন্যবাদ জানাই। পচে ওঠা ভারি হাত নিয়ে গত ১০ জুলাই মুক্তামনিকে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে। দেহের ক্ষতস্থানে বায়োপসি করে তার রক্তনালীতে টিউমার ধরা পড়ে । পরে তাকে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসার জন্য একটি হাসপাতালের সাথে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেখার পর সিঙ্গাপুর হাসপাতাল মুক্তার চিকিৎসায় তাদের অস্বীকৃতির কথা জানিয়ে দেয়। চোখের জল মুছতে মুছতে মুক্তামনির মা আসমা খাতুন বলেন, সিঙ্গাপুরের ডাক্তাররা রাজী না হলেও সাহসের সাথে বাংলাদেশের ডাক্তাররা মুক্তামনিকে চিকিৎসা করেছেন। আমি দোয়া করি প্রধানমন্ত্রীর জন্য। তিনি যেনো সুস্থ থাকেন। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তামনির চিকিৎসার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অবশেষে বাংলাদেশের ডাক্তাররাই মুক্তামনির বিরল রোগ নিরাময়ে সাহসী সিদ্ধান্ত নেন। দফায় দফায় সার্জারি শেষে তার ডান হাতে নতুন চামড়া লাগানো হয়। এর পর সে অনেকাংশে সুস্থ হয়ে যায়। মুক্তামনিকে ডাক্তাররা এক মাসের ছুটি দিয়েছেন। সাতক্ষীরা সদর উপজেলার কামারবায়সা গ্রামের মুদি দোকানী মো. ইব্রাহিমের দুই যমজ মেয়ে মুক্তামনি ও হীরামনি। ১২ বছর বয়সের হীরা ও মুক্তা একই সাথে পড়তো। কিন্তু অসুস্থতার কারণে মুক্তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসা করিয়েও কোনো লাভ হয়নি। অবশেষে গত জুলাইয়ে বিভিন্ন গনমাধ্যমে মুক্তামনির রোগ নিয়ে রিপোর্ট হয়। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয় তাকে। সেই থেকে এতোদিন চিকিৎসা নিয়ে মুক্তা বাড়ি ফিরলো শুক্রবার সন্ধ্যা সাতটায়। মুক্তা ঢাকা মেডিকেলের ডা. আবুল কালাম ও ডা. সামন্ত লাল সেনের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তার চিকিৎসার সব খরচ বহন করেছেন। তিনি প্রতিনিয়ত তার চিকিৎসার খবর নিয়েছেন। ছুটিতে মুক্তার বাড়ির আসার খবরে আনন্দিত হয়ে অপেক্ষায় ছিল গ্রামের নারী পুরুষ ছেলে বুড়ো সবাই। মুক্তার জন্য ওর নানা নানী বিশেষ খাবার রান্না করে এনেছেন বাড়ি থেকে। মুক্তা বললো অনেকদির নানীর হাতের রান্না খাইনি। আজ সত্যিই মজা করে খাবো। নানা শওকত আলি, নানী আনজুয়ারা, দাদী সালেহা খাতুন, চাচা আহসান আলি আর চাচী খাদিজা বেগম অপেক্ষায় ছিলেন কখন আসবে মুক্তামনি। অপেক্ষায় ছিলেন গ্রামের আনারুল, নাহিদ, রহিম, ফেরদৌস, ইসমাইল, সিয়াম, বেল্লাল, মুন্নাসহ সমবয়সী সব বন্ধু বান্ধবরা। কিন্তু অপেক্ষায় ছিলেন না মুক্তার দাদা। তিনি তো মারা গেছেন মুক্তার চিকিৎসা করাতে গিয়ে ঢাকায়। সে খবর মুক্তাকে এখনও জানানো হয়নি।