দফায় দফায় পদোন্নতি, পছন্দের জায়গায় পদায়ন, দুই দফা বেতন-ভাতা বৃদ্ধি, গাড়ি ও বাড়ির জন্য সুদ ছাড়া ব্যাংক ঋণ, রেশন বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন রকম সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন সরকারের প্রশাসন ও পুলিশে কর্মরত কর্মকর্তারা। চাকরির বয়স বৃদ্ধি হয়েছে দুই দফায়। এমনকি একাধিক কর্মকর্তা একই পদে দফায় দফায় চুক্তিভিক্তিক নিয়োগ পেয়েছেন। সুযোগ-সুবিধার খাতায় যুক্ত হয়েছে বৈশাখী উত্সবভাতাও। অতীতে আর কোনো সরকারের সময় এমন সুযোগ-সুবিধা কখনই জোটেনি সরকারি কর্মকর্তা ও পুলিশের ভাগ্যে। সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে এগুলো রেকর্ড পরিমাণ।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট জয়ী হয়ে সরকার গঠনের পর থেকেই সুযোগ-সুবিধা পেয়ে আসছেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও পুলিশ প্রশাসন। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের দুই মেয়াদ মিলিয়ে গত প্রায় নয় বছরে প্রশাসনে সবচেয়ে বেশি পদোন্নতি পেয়েছেন কর্মকর্তারা। নয় বছরে সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে শুরু করে উপসচিব, যুগ্ম-সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন দুই হাজারেরও বেশি কর্মকর্তা। এ পদোন্নতি হচ্ছে এক ধরনের প্যাকেজ সুবিধা। কারণ, পদোন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও বৃদ্ধি পায়। প্রশাসনে পদ না থাকলেও পদোন্নতির ক্ষেত্রে এ বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। বরং পদোন্নতি নিয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সন্তুষ্টির সঙ্গে আগের জায়গায়ই নিজেদের বহাল রেখেছেন। পদোন্নতি ছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রেও সরকারি কর্মকর্তারা সর্বোচ্চ সুবিধা ভোগ করছেন। বেশির ভাগ কর্মকর্তাই নিজেদের পছন্দের জায়গায় পোস্টিং নিয়েছেন। এ ক্ষেত্রেও তারা সুবিধা ভোগ করছেন। সরকার দুই দফায় পে-স্কেলের মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করেছে। প্রথম দফায় মহাজোট সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০০৯ সালে পে-স্কেল ঘোষণা করে। ওই বছরের ১ জুলাই থেকেই তা কার্যকর। তারপর বর্তমান সরকারের মেয়াদে ২০১৫ সালের ১ জুলাই সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা আরেক দফা বৃদ্ধি পায় পে-স্কেলের মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে শতভাগ বেতন বৃদ্ধি পায় কর্মকর্তাদের। আবার কারও কারও ক্ষেত্রে ১২০ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। অতীতে কোনো সরকারের সময়ই এমন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেননি আমলারা। আওয়ামী লীগ সরকারের দুই মেয়াদেই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরির বয়স বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রথম দফায় মহাজোট সরকারের সময় চাকরির বয়স ৫৭ থেকে বাড়িয়ে করা হয় ৫৯ বছর। আর দ্বিতীয় দফায় সরকারের মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে চাকরির বয়স ৬০ বছর করা হয়।
এই সরকারের দুই মেয়াদে সরকারের আমলারা গাড়ি-বাড়ি করার জন্য সুদবিহীন ব্যাংক ঋণের সুযোগ পান। প্রথমে সরকারের অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম-সচিবরা গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা পেলেও চলতি বছরই এ সুযোগ পেয়েছেন উপসচিবরা। একইভাবে তারা বাড়ি করার জন্য সুদবিহীন ব্যাংক ঋণ পাচ্ছেন।
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ এ সরকারের সময় কমে এলেও এখনো বেশকিছু কর্মকর্তা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাচ্ছেন। এটা আমলাদের সরকারের এক ধরনের উপহার।
শুধু প্রশাসনেই নয়, পুলিশের ক্ষেত্রেও এ সুযোগ-সুবিধার কমতি নেই। পদোন্নতি, আবাসন, যানবাহন, পোশাক, রেশনের সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন পুলিশের সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা। রেশন পেয়েছেন শতভাগ। অতীতে কখনই পুলিশের এমন সুযোগ-সুবিধা ছিল না।
পুলিশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, বর্তমান সরকারের নয় বছরে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে পুলিশবাহিনীতে। নয় বছরে পদোন্নতি পেয়েছেন অসংখ্য পুলিশ কর্মকর্তা। বেতন-ভাতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ঝুঁকিভাতা পুলিশ সদস্যদের মনোবল চাঙ্গা করেছে। পুলিশের মহাপরিদর্শক ছাড়াও ইন্সপেক্টর ও সাব-ইন্সপেক্টর পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পদমর্যাদা বৃদ্ধি করায় এ বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে রয়েছে সন্তুষ্টি। গত সাত বছরে নতুন নতুন থানা ভবন নির্মাণসহ আবাসন সমস্যা সমাধানে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। এসেছে নতুন অস্ত্র ও সরঞ্জাম। বেড়েছে জনবল। নতুন যানবাহনসহ পুলিশবাহিনীকে আধুনিক করে গড়ে তুলতে নানামুখী পদক্ষেপও নিয়েছে বর্তমান সরকার।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত নয় বছরে পুলিশের বার্ষিক বাজেট বেড়েছে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৭-০৮ অর্থবছরে পুলিশবাহিনীর জন্য বার্ষিক বাজেট ছিল ২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পুলিশবাহিনীর জন্য বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৯ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা।
পুলিশ সদর দফতর বলেছে, বর্তমান সরকারের সময় পুলিশ বিভাগে সবচেয়ে বড় পাওয়া স্বাধীনতা পুরস্কার-২০১১। এর মাধ্যমে দীর্ঘদিন পরে হলেও স্বাধীনতাযুদ্ধে পুলিশবাহিনীর অবদানের বিষয়টি সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেছে। এ ছাড়া বর্তমান সরকারের আমলেই পুলিশ মহাপরিদর্শকের পদকে সিনিয়র সচিব পদমর্যাদায় উন্নীত করা করা হয়েছে। ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধু-প্রদত্ত র্যাংক-ব্যাজ (থ্রি-স্টার জেনারেল)।
পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, কর্তব্যরত অবস্থায় কোনো পুলিশ সদস্য নিহত হলে অনুদান ৩ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৫ লাখ এবং আহত হলে ৫০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১ লাখ টাকা করা হয়েছে বর্তমান সরকারের আমলে। দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষিত ইন্সপেক্টর পদকে দ্বিতীয় থেকে প্রথম শ্রেণির নন-ক্যাডার এবং এসআই ও সার্জেন্ট পদকে তৃতীয় থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করা হয়েছে। পুলিশে রেশনের বৈষম্য নিরসনসহ সর্বশেষ ৩০ ভাগ ঝুঁকিভাতা ঘোষণা করায় নতুনভাবে উজ্জীবিত পুরো পুলিশবাহিনী। পুলিশ সদর দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ভাষায়, গত সাত বছরে পুলিশবাহিনীতে যে পরিমাণ উন্নয়ন হয়েছে তা স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও হয়নি।
প্রশাসন ও পুলিশে এমন সুযোগ-সুবিধাকে কীভাবে দেখছেন— জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদের সাবেক সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তাদের বয়স বৃদ্ধির বিষয়টি যৌক্তিক। এর প্রয়োজন ছিল। কিন্তু যেভাবে পদ ছাড়া পদোন্নতি হয়েছে তা কোনোভাবেই ঠিক নয়। এতে প্রশাসনের শৃঙ্খলা নষ্ট হয়।’ তিনি বলেন, ‘পদায়নের ক্ষেত্রে সরকারের কারা কীভাবে পদায়ন করে তা দেখা দরকার। পদায়নের যথাযথ নীতিমালা থাকা দরকার।’ আলী ইমাম মজুমদার মনে করেন, যুগ্ম-সচিব পর্যন্ত কর্মকর্তারা যদি সরকারের গাড়ি ব্যবহার না করেন তাহলে তাদের গাড়ি দেওয়ার বিষয়টা গ্রহণযোগ্য হতে পারে। কারণ, যুগ্ম-সচিবদের সরকারি গাড়ি ব্যবহার করতে হয়। এজন্য সরকারকে গাড়ি কিনতে হয়। আবার সেগুলো মেরামতও করতে হয়। এজন্য তাদের গাড়ি কেনার সুযোগ দিলে তা গ্রহণযোগ্য। কিন্তু উপসচিব পর্যায়ে এর প্রয়োজন নেই।
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন।