কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে এক রাতেই ১০৬ জন চিকিৎসককে ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বদলির আদেশ জারি করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ওই চিকিৎসকদের মধ্যে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ও জুনিয়র কনসালট্যান্টসহ অন্যান্য পদের ডাক্তার রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৪৪ জনকে পোস্টিং দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন উপজেলায়, অন্যদের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কিংবা জেলা সদরে। বদলি হওয়া বেশির ভাগ চিকিৎসকই ছিলেন সংযুক্তি নিয়ে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, গত ২১ ডিসেম্বর রাতে ওই আদেশ ছাড়া হয় মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে। আদেশে উল্লেখ করা হয়েছে, ২৮ ডিসেম্বরের মধ্যে নতুন কর্মস্থলে যোগদান না করলে পরদিন থেকেই অবমুক্ত বলে গণ্য করা হবে, এমনকি তারা ওএসডি হিসেবে বেতন-ভাতাও পাবেন না। মন্ত্রণালয়ের এমন কঠোর পদক্ষেপের পরও নানাভাবে বদলি ঠেকাতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন অনেক চিকিসক। তবে হঠাৎ করে এই বদলির ফলে মারাত্মক সমস্যায় পড়েছে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ১০৬ চিকিৎসকের মধ্যে ওই মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালেরই আছেন ৫৩ জন। অন্যরা রাজধানীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আগাম জানান দিয়ে বদলি করলে তদবিরে অতিষ্ঠ হতে হয়, ঠিকমতো আর বদলি করা যায় না। তাই এবার কঠোর গোপনীয়তার মাধ্যমেই এ বদলি করা হয়েছে। এখন থেকে এমন বদলি আরো হবে। আর সুযোগ দেওয়া হবে না। কারণ মাঠে ডাক্তার শূন্যতায় মানুষের সেবা যেমন বিঘ্নিত হয়, তেমনি নানা মহল থেকে আমরা সব সময় গালমন্দ শুনতে থাকি। এ ছাড়া অতিরিক্ত সংযুক্তির কালচার থেকেও আমরা বেরিয়ে আসতে চাচ্ছি। ’
এদিকে এই বদলির আদেশ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল। তিনি বলেন, ‘বদলির বিষয়টি নিয়ে এক ধরনের বিশৃঙ্খল অবস্থা চলছে। কোনো পরিকল্পনা না করেই এমন বদলি কতটা সুফল বয়ে আনবে সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। বিশেষ করে একদিকে উপজেলা খালি করে জুনিয়র প্রায় সব ডাক্তারকে উচ্চশিক্ষার নামে ঢাকায় নিয়ে আসা হচ্ছে কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই। সেটাও যেমন পর্যায়ক্রমে করলে ভালো হতো, তেমনি এখন ঢাকা থেকে এতজন সিনিয়র ডাক্তারকে একযোগে বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হলো তাতেও কোনো পরিকল্পনা নেই। ’
অধ্যাপক ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব। তিনি বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের উচিত ডাক্তার বদলি ও পোস্টিংয়ের ক্ষেত্রে আরো পরিকল্পিত উদ্যোগ নেওয়া, যাতে করে ডাক্তাররা গ্রাম ছাড়া না হয়, আবার ঢাকায় অতিরিক্ত সংযুক্তির সুযোগ না থাকে। ’ তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে এত অতিরিক্ত ডাক্তারদের সংযুক্তি কেন এবং কিভাবে দেওয়া হয়েছিল সেটাও দেখতে হবে। মন্ত্রণালয় থেকেই তো এই সংযুক্তির আদেশ নিয়ে আসে!’
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া বলেন, ‘হঠাৎ করে এখানে বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না করে এক দিনে দুটি আদেশের মাধ্যমে ৫৩ জন ডাক্তারকে বদলি করা ঠিক হয়নি। এখন এতগুলো পদের শূন্যতা হঠাৎ করে কিভাবে সামাল দেব বুঝতে পারছি না। পর্যায়ক্রমে বদলি করলে এমন সমস্যায় পড়তে হতো না। ’
বিএমএ ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) প্রভাবশালী নেতা ডা. উত্তম বড়ুয়া আরো বলেন, ‘নানা সময় প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের এই হাসপাতালে বিভিন্ন স্থানের ডাক্তারদের সংযুক্তি পোস্টিং দেওয়া হয়েছে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে পদ না থাকলেও মন্ত্রণালয় কিংবা অধিদপ্তর থেকে আদেশ নিয়ে এখানে এসে যোগদান করেছেন। আমরা বাধ্য হয়ে তাঁদের জায়গা করে দিয়েছে। সেই সঙ্গে তাঁদের নিয়ে নতুনভাবে সেটআপ তৈরি করে আমরা হাসপাতালের সেবার মান আগের তুলনায় অনেক উন্নত করেছি। এখন সাধারণত কোনো রোগীকেই আর এই হাসপাতালে এসে বিনা চিকিৎসায় ফিরে যেতে হয় না, সব ধরনের চিকিৎসাই দেওয়া হয়। ’ তিনি আরো বলেন, ‘বদলির ক্ষেত্রে আরেকটি ঘটনাও মানা যাচ্ছে না। সেটা হলো যাঁদের বদলি করা হয়েছে তাঁরা সবাই সরকার সমর্থক সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের নেতাকর্মী। অন্য দলগুলোর সমর্থক কেউ ওই তালিকায় পড়ল না কেন সেটা আশ্চর্য লাগছে। ’