পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতরের (ডিআইএ) কর্মকর্তাদের উদ্দেশে ৪ ডিসেম্বর শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ‘সহনশীল ঘুষ’ নেওয়ার কথা উল্লেখ করার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন সেক্টরে বিষয়টি নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। শিক্ষামন্ত্রী ‘সহনশীল ঘুষ’ এর কথা বলেননি বলে প্রথমে সংবাদের প্রতিবাদ ও পরে ২৭ তারিখ সংবাদ সম্মেলন করে ব্যাখ্যা দিলেও শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষা বিভাগের ঘুষের কথা অস্বীকার না করে এখন সময় এটি প্রতিরোধ করা।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ দেশের সাতটি খাতের দুর্নীতির বিষয়ে প্রতিবেদন হাজির করলেও দুর্নীতির পরিমাণ বিবেচনায় শিক্ষাখাতের দুর্নীতি লাগামছাড়া বলে তাদের বিভিন্ন জরিপে উঠে আসে। শিক্ষার বিভিন্ন বিভাগ ধরে ধরে যখন তারা গবেষণা হাজির করছেন তখন একইসঙ্গে মন্ত্রণালয় থেকে চলছে এসব জরিপকে ‘একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়’ বলে অস্বীকারের প্রবণতা। শিক্ষাবিদরাও বলছেন, শিক্ষার দুর্নীতি অস্বীকার না করে এ ব্যাপারে জিরো টলারেন্সে যেতে হবে। একশভাগ দায়িত্ব নিয়ে দুর্নীতি বিরোধী অবস্থান নিতে হবে।
দেশের ৬৭ শতাংশ সেবা গ্রহীতা কোনও না কোনোভাবে ঘুষ দিতে বাধ্য হন বলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক জরিপে বেরিয়ে আসে। এই জরিপ উল্লেখ করে গত ১০ ডিসেম্বর টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি খাতে সেবা নিতে গিয়ে সেবা গ্রহীতারা দুর্নীতির শিকার হন। যারা ঘুষ দিয়েছেন তাদের মধ্যে ৭০ শতাংশ মনে করেন, এছাড়া (ঘুষ) সেবা পাওয়ার অন্য কোনও উপায় নেই।’ এর আগে গতবছর জুন মাসে এই প্রতিষ্ঠানেরই আরেক জরিপে উঠে আসে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আইনশৃঙ্খলা, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পাসপোর্ট ও বিচারিকসহ অন্তত ১৬টি খাতের সেবা পেতে বছরে ৮ হাজার ৮২১ কোটি ৮০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়।
পরবর্তীতে গত ১৬ ডিসেম্বর ‘সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রভাষক নিয়োগের প্রতিটি ধাপেই হচ্ছে দুর্নীতি। এক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ৩ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ লেনদেন হয়ে থাকে। এতে দাবি করা হয়, প্রভাষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাকে প্রাধান্য না দিয়ে যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হয় দলীয় পরিচয়, স্বজনপ্রীতি এবং অঞ্চলপ্রীতি।
তবে জরিপ কিংবা শিক্ষাবিদদের পর্যবেক্ষণ যাই বলুক না কেন মন্ত্রনালয়ের পক্ষ থেকে বারবারই এসব অভিযোগ অস্বীকার করা হয়। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদরাসহ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান বলছেন, ঘুষ লেনদেন হয় এবং এ টাকা কোথায় যায় তা সবার জানা।
বছরের পর বছর ধরে এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থেকে কোচিং-বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের অভিযোগে রাজধানীর আটটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৯৭ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সম্প্রতি সুপারিশ করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত নভেম্বর মাসের শুরুতে ২৪টি সরকারি বিদ্যালয়ের ৫২২ জন শিক্ষককে একই কারণে বদলির সুপারিশ করে দুদক। তবে দুঃখজনক হচ্ছে এখনও কারও বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এমনকি এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার কোনও কার্যক্রমও শুরু হয়নি।
শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধূরী মনে করেন ঘুষকে নিয়ে এধরনের অস্বীকার প্রবণতা ক্ষতিকর। তিনি বলেন, ‘তিনি (শিক্ষামন্ত্রী)এমন বক্তব্য দেওয়ার অর্থই হচ্ছে ঘুষ মেনে নিলেন। এই পর্যায়ে তিনি এধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য কেন দেবেন? শিক্ষা প্রশাসনের বাস্তবচিত্র যে কী ভয়াবহ তা রোজ পত্রপত্রিকায় আমরা আমাদের আশেপাশে দেখতে পাচ্ছি। অস্বীকার না করে প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিন, সেটা কাজের হবে। আজকের যে পরিস্থিতি তাতে একজন শিক্ষক নৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে যাওয়া মানে তার সব অপরাধের বিরুদ্ধে যে শক্ত মেরুদণ্ড আমরা আশা করি, তা জাতি পাবে না।’
টিআইবির ট্রাস্টিবোর্ডের সদস্য ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, অনেক রকমের দুর্নীতি হয়। আমরা তো মনে করি শিক্ষা বিভাগটা দুর্নীতির বড় আখড়া। প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে যা হচ্ছে কে জানে না? সবাই জানে, কিন্তু কেউ বলে না। এনসিটিবি (জাতীয় শিক্ষাক্রম ও টেক্সটবুক বোর্ড) নিয়েও টিআইবি কাজ করেছিল। মাউশিতেও অনেক ঘুষের লেনদেন হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এমন কোনও বিভাগ নেই যেখানে ঘুষ লেনদেন হয় না। এটি স্বীকার না করে আজকে দেখলাম শিক্ষামন্ত্রী ব্যাখ্যা দিয়েছেন, এসব দুর্নীতি বিএনপি জামায়াত আমলের। আমার পর্যবেক্ষণ বলে, বিএনপির আমলের যে ঘুষ লেনদেন পরিস্থিতি ছিল তার কোনও উন্নতি হয়নি। জিরো টলারেন্স ছাড়া অন্য যেকোনও মন্তব্য বা আচরণ ঘুষ লেনদেনকারীদের কাছে ভুল বার্তা দেবে। তারা সতর্ক না হলে আরও বেশি ঘুষ নেবে। বালিতে মাথা না গুঁজে একশভাগ দায়িত্ব নিয়ে ঘুষ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। কারণ শিক্ষা হলো মগজ। মগজে পচন ঘটলে আর কিছু করা সম্ভব না।
শিক্ষক নিয়োগে ঘুষ লেনদেনের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি)চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান বলেন, ‘শিক্ষক নিয়োগে ঘুষ লেনদেনের অনেক অভিযোগ আছে ঠিকই কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রমাণিত সেভাবে হয়নি। মাঝে মাঝেই এমন অভিযোগ আসে। যেমন সর্বশেষ কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য এ এম এম শামসুর রহমানের বিরুদ্ধে ঘুষ নিয়ে চাকরি দেওয়ার একটা অভিযোগ পেয়েছিলাম। তিনি সেটা স্বীকারও করেছেন।
ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ প্রায়ই পাওয়া যায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, কেবল টিআইবি জরিপ না দুদক থেকেও এমন অভিযোগ এসেছে, প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে এসেছে। এগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি তদন্ত করেছি এবং এর প্রতিবেদনও জমা দিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, ‘দেশের এত বড় একটি সেক্টর এবং যেটা জাতির অন্যতম শ্রদ্ধার জায়গা সেই জায়গায় যদি ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ থাকে তাহলে সেটা তো খুবই লজ্জার। শিক্ষক, উপাচার্য এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ আসে। এগুলো তো খুবই লজ্জার এবং মারাত্মক অভিযোগ। এই জায়গাকে যদি ঠিক রাখতে না পারি তাহলে দেশকে কিভাবে ঠিক রাখবো।’
ঘুষের টাকা কোথায় যায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঘুষের টাকা যারা নেয় তাদের কাছে যায়। ঢাকা শহরের কোন সরকারি কর্মকর্তার কতটা বাড়ি আছে, গুলশান বনানীতে কতটি বাড়ি আছে তা খতিয়ে দেখলেই তো বোঝা যাবে ঘুষের টাকা কোথায় যায়।’