গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকা থেকে হারিয়ে গেলো আরও একটি বছর। রবিবার দিবাগত মধ্যরাত থেকে নতুন বছরের (২০১৮) দিন গোনা শুরু হলো। একইসঙ্গে দেশে শুরু হয়েছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষণগণনাও। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ২০১৮ সাল বহুল-প্রত্যাশিত নির্বাচনের বছর। সবকিছু ঠিক থাকলে এ বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হবে সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচন কমিশনসহ (ইসি) রাজনৈতিক দলগুলো সারা বছরই তৎপর থাকবে। ফলে বছরজুড়ে রাজনীতি আবর্তিত হবে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। নির্বাচন বিশ্লেষকরাও মনে করছেন, নতুন বছরটি হবে ইতিবাচক রাজনীতির বছর। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থা তৈরির বছর। নির্বাচন কমিশন, প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এবং নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপকালে এমন আভাস পাওয়া গেছে।
বিদায়ী বছরের শেষ দিনে রবিবার এক অনুষ্ঠানে নতুন বছরকে নির্বাচনের বছর বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, ‘নতুন বছর ২০১৮ সাল হচ্ছে নির্বাচনের বছর। এই বছরেই বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে দেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো নতুন বছরকে ঘিরে তাদের প্রস্তুতি শুরু করেছে। নির্বাচনি রাজনীতির জন্য ভোটারদের মনোযোগ আকর্ষণে এরই মধ্যে নিজেদের কৌশলও ঠিক করে ফেলেছে তারা। এক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের কৌশল হতে যাচ্ছে সরকারের টানা দশ বছরের নানা উন্নয়ন-অর্জনের প্রচার ও বিএনপিকে চাপে রাখার চেষ্টা। অন্যদিকে বিএনপির কৌশল হচ্ছে, ইতিবাচক রাজনীতি ও জনগণের কষ্ট হয়; এমন কোনও কর্মসূচি না দিয়ে জনগণের সমর্থন আদায়। এ লক্ষ্যে দুই দলই নির্বাচনি এ বছরটির শুরু থেকেই রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামতে চায়। বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি নিয়ে যেতে চায়, ভোটারদের দ্বারে দ্বারে। নির্বাচনের ফসল ঘরে তুলতে এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে চায় গোটা বছর।
আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত করাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান লক্ষ্য। এ লক্ষ্য অর্জনে পরিচালিত হবে দলটির সব কর্মকাণ্ড। আওয়ামী লীগকে আগের চেয়ে আরও বেশি জনসম্পৃক্ত করে তুলতে কাজ করার পাশাপাশি বিএনপির ‘নেতিবাচক’ রাজনীতি, দেশ পরিচালনায় তাদের ব্যর্থতা, লুটপাট-দুর্নীতির চিত্র জনগণের মাঝে আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে বেশি করে তুলে ধরতে কাজ করবে ক্ষমতাসীন দলটি। একইসঙ্গে বর্তমান সরকারের সাফল্য, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির প্রচারণা নিয়ে নির্বাচন পর্যন্ত জনগণের দুয়ারে যাবে আওয়ামী লীগ।
দশম সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপিও নতুন বছরে পথ চলতে চায় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠেয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অন্যতম লক্ষ্য স্থির করে এ বছর এগুতে চায় বিএনপি। দলটির নেতাকর্মীরা মনে করেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক করে জোটগতভাবে অংশ নিতে হবে। এই নির্বাচনে কোনোভাবেই ফাঁকা মাঠ ছেড়ে দেওয়া হবে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে। নির্বাচনের মুখোমুখি হবে বিএনপি। আর এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই নতুন বছরে দলটির সব ধরনের কর্মসুচিতে থাকবে নির্বাচনি আমেজ।
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সম্প্রতি এক সমাবেশে আগামী বছরে দলের কর্মসূচির বিষয় ইঙ্গিতও দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আগামী বছর আন্দোলন, সংগ্রাম ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের বছর। সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবেই গণতন্ত্রকে উদ্ধার করতে হবে।’
রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনও এগুচ্ছে একাদশ নির্বাচনের পথ ধরে। হাঁটবে একাদশ নির্বাচনের লক্ষ্যে তাদের তৈরি রোডম্যাপ ধরে।
এদিকে, ইসির নতুন বছর শুরু হবে হালনাগাদ ভোটার তালিকা প্রকাশের মধ্য দিয়ে। মঙ্গলবার (২ জানুয়ারি, ২০১৮) প্রকাশিত হবে হালনাগদকৃত ভোটার তালিকা। এটি চূড়ান্ত হবে ৩১ জানুয়ারি। পরে জুন মাসে তারা চূড়ান্ত ভোটার তালিকার সিডি তৈরি করবে। এর ফাঁকে ফাঁকে তারা সংশোধন করবে আরপিওসহ নির্বাচনি আইনগুলো। পুনর্বিন্যাস করবে সংসদীয় আসনের সীমানা।
নতুন বছরের কর্মসূচি ও লক্ষ্য সম্পর্কে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবউল আলম হানিফ বলেন, ‘নতুন বছরে আওয়ামী লীগের লক্ষ্য একটাই। তাহলো নিরঙ্কুশ বিজয়। টানা তৃতীয়বার দলকে ক্ষমতাসীন করতে কাজ করবেন দলের সব স্তরের নেতাকর্মীরা।’
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য ফারুক খান বলেন, ‘নতুন বছরে আমাদের প্রধান করণীয় হবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া। বাংলাদেশের জনগণকে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করা। দলকে টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় আনার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করা।’ আওয়ামী লীগের লক্ষ্য সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমান সরকারের উন্নয়নমূলক কাজগুলো অব্যাহত রাখার পাশাপাশি সম্ভাব্য কাজগুলো দ্রুত শেষ করার লক্ষ্যে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। পাশাপাশি সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডকে জোরদার ও শক্তিশালী করাও আমাদের লক্ষ্য।’
নির্বাচন প্রশ্নে ফারুক খান বলেন, ‘যদি কিছু রাজনৈতিক দল তাদের মাথাটা ঠিক রাখতে পারে, জনগণের ওপর আস্থা রাখতে পারে, তাহলে বাংলাদেশে প্রতিটি নির্বাচনই খুব ভালো হবে।’ তিনি বলেন, ‘জনগণের ওপর আস্থা রাখতে না পারার কারণে বিএনপি-জামায়াত ২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কট ও প্রতিহতের চেষ্টা করেছে। তবে তারা ব্যর্থ হয়েছে। আমরা আশা করবো, তারা এবার ভুলটি করবে না। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সচল রাখতে নির্বাচনে অংশ নেবে।’
জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘নতুন বছরটিকে আমরা পরিবর্তনের বছর হিসেবে দেখছি। ২০১৮ সাল হবে গণতন্ত্রের বিজয়ের বছর। নতুন বছরকে সকলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও নির্বাচনের বছর হিসেবে দেখছি। দেখছি নির্দলীয় অবস্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের বছর হিসেবে। দেখছি জনগণের মনের মতো নতুন সরকার প্রতিষ্ঠার বছর হিসেবে। ব্যর্থতা গ্লানি ও ফ্যাসিবাদের কবর দিয়ে আমরা নতুন বছর গণতন্ত্রের পতাকা উড়ানোর বছর হিসেবে দেখছি।’ বিএনপি তার নতুন বছরের প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে গোটা বছরই তাদের কর্মসূচি পরিচালনা করতে চায় বলেও জানান দলের এই নেতা।
আগামী নির্বাচন নিয়ে কারও ভিন্ন কোনও পরিকল্পনা থাকলে তা বুমেরাং হবে মন্তব্য করে শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘বিএনপি নির্বাচনে যাবে ও বিজয়ী হবে।’ নতুন বছরের কর্মসূচি প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সবাইকেই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাইলে সবাইকে এক হতে হবে। ছোট দলগুলোর বড় নেতারা তাদের জীবনকে গণতন্ত্রের জন্য উৎসর্গ করেছেন। যেহেতু ২০১৮ সাল গণতন্ত্র ফেরানোর বছর, সেহেতু নিরপেক্ষ নির্বাচন আদায়ে তাদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবেই বিএনপি এগিয়ে যাবে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘২০১৮ সাল হবে গণতন্ত্রের বছর। মানুষের ভোটাধিকার ফিরে পাওয়ার বছর হবে এটি। মানুষ তার নাগরিক অধিকার ফিরে পাবে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে, চরম দুর্নীতি থেকে মুক্ত হওয়ার বছর হবে ২০১৮ সাল।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পেরেছি, এ বছর ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আমরা চাই, যে নির্বাচনটা ২০১৮ সালে হবে, সেটা যেন অবশ্যই ভালো হয়। আমরা চাই নির্বাচনটি সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হোক। আর এই জন্য দরকার একটি আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠা খুবই জরুরি। এজন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে নির্বাচন প্রশ্নে একটি সমঝোতা প্রয়োজন।’
বিএনপি একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে এমনটি প্রত্যাশা করে ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, নির্বাচনে না গেলে বিএনপি বড় ধরনের সমস্যায় পড়বে। নিবন্ধন হারানোসহ মামলা-হামলায় জড়িয়ে যাবে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা চাই সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজ করার জন্য আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ সব দল একটি কার্যকরী পদক্ষেপ নেবে। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনেরও দায়িত্বটাও অনেক বড়। তারা একটি উদ্যোগ নিতে পারে, যেন দুটো বড় দলের মধ্যে একটি আস্থার সম্পর্ক তৈরি হয়।’ নতুন বছরটি দেশের জন্য শঙ্কা, সহিংসতামুক্ত ইতিবাচক রাজনীতির বছর হবে বলেও মন্তব্য করেন তারেক শামসুর রেহমান।
নির্বাচন কমিশনের ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন বলেন, ‘একাদশ সংসদ নির্বাচনসহ ২০১৮ সালে কমিশনের অনেক কাজ রয়েছে। এগুলোকে সুন্দর ও সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে কমিশন রোডম্যাপ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়ে এগুচ্ছে।’ সংসদ নির্বাচন ছাড়াও এ বছর বড় বড় কয়েকটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন কমিশনকে করতে হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।