সরকারের মেয়াদের শেষ বছরে মন্ত্রিসভায় নতুন সংযোজনের পর মন্ত্রীদের দফতর ব্যাপক রদবদল করে চমক দেখালেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নবনিযুক্ত তিন মন্ত্রী ও এক প্রতিমন্ত্রীর মধ্যে দফতর বণ্টনের পাশাপাশি পুরনো তিন মন্ত্রী ও এক প্রতিমন্ত্রীর দফতর রদবদল করা হয়েছে। গতকাল এক সরকারি প্রজ্ঞাপনে দফতর রদবদলের কথা জানানো হয়।
রদবদলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন নতুন দায়িত্ব পাওয়া মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়ে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেছেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলতে পারবেন কিসের জন্য তিনি পরিবর্তন করেছেন। উনি হর্তাকর্তা বিধাতা। উনি সব নির্ধারণ করেন।
বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়ে রাশেদ খান মেনন বলেন, আকাশ থেকে মাটিতে নামলাম।
অন্যদিকে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়ে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, সরকারে ছিলাম সরকারেই আছি।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী থেকে তথ্য প্রতিমন্ত্রী হয়ে তারানা হালিম বলেন, এভাবে সরিয়ে দেওয়াটা মানুষ হিসেবে একটু লাগে।
পুরনো যে তিন মন্ত্রীর দফতর বদল করা হয়েছে তারা সবাই ক্ষমতাসীন মহাজোটের শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় পার্টি (জেপি) ও জাতীয় পার্টির নেতা। আর আওয়ামী লীগের মধ্যে কেবল জনপ্রিয় অভিনেত্রী তারানা হালিমকে তার আগের দফতর পরিবর্তন করে তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী করা হয়েছে।
গতকাল দুপুরে মন্ত্রিসভা বৈঠকের পর সচিবালয়ে সংবাদ ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম জানান, বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেননকে আগের মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বিমান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন নতুন নিয়োগ পাওয়া এ কে এম শাহজাহান কামাল। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন শুরু থেকেই বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে দেওয়া হয়েছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। আর পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন জাতীয় পার্টির (এরশাদ) প্রেসিডয়াম সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। তিনি এর আগে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে ছিলেন। নতুন মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়া তথ্য ও প্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বার পেয়েছেন ডাক, টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা নারায়ণ চন্দ্র চন্দ মন্ত্রী হিসেবে পদোন্নতি পাওয়ার পর তাকে একই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা অভিনেত্রী তারানা হালিমের দফতর বদল করে পাঠানো হয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে। এ মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু। নতুন শপথ নেওয়া কাজী কেরামত আলী পেয়েছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাদ্রাসা ও কারিগরি বিভাগের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ একই মন্ত্রণালয়ে রয়েছেন।
কে কী বললেন
আনোয়ার হোসেন মঞ্জু : বর্তমান সরকারের প্রথম থেকেই পরিবেশ ও বনমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। তাঁকে এখন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় পরিবর্তন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলতে পারবেন কেন, কীসের জন্য তিনি পরিবর্তন করেছেন। এ বিষয়ে আমার কোনো ক্রিয়া বা প্রতিক্রিয়া নেই। আমি কুম্ভরাশির জাতক, কাজের লোক। বদলের কারণ আমি বলতে পারব না। উনি (প্রধানমন্ত্রী) হর্তাকর্তা-বিধাতা, উনি সব নির্ধারণ করেন।
রাশেদ খান মেনন : বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী হিসেবে চার বছর দায়িত্ব পালনের পর সরকারের শেষ মেয়াদে এসে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেলেন রাশেদ খান মেনন। দফতর বদলের প্রতিক্রিয়ায় তিনি গতকাল বিকালে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, আকাশ থেকে তিনি মাটিতে নামলেন। সূত্র বিডিনিউজ।
বিডিনিউজ আরও জানায়, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি সরকারের শরিক দলের নেতা মেনন খানিকটা হেসেই বলেন, ‘আমার জন্য সুখকর এই কারণে বলতে পারেন, আমি আকাশ থেকে একটু মাটিতে নামলাম। সামাজিক নিরাপত্তার প্রশ্নে বলেন, সামাজিক কল্যাণের প্রশ্নে বলেন, একেবারে সাধারণ মানুষের কাছে।’ দফতর বদলের পর বিকালে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান মেনন। পরে বিকালে সচিবালয়ে বিমান মন্ত্রণালয়ে এসে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে মেনন বলেন, ‘শেখ হাসিনা অনেক হিসাব করেই মন্ত্রিসভায় রদবদল এনেছেন। বছরের প্রথম ভাগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার যে সম্প্রসারণ ও পরিবর্তন সাধন করলেন, আমার মনে হয় স্বাভাবিকভাবে প্রশাসনে গতিশীলতা আনার জন্যই করলেন। এটিই হচ্ছে শেষ বছর আমাদের সরকারের।
সুতরাং তিনি চেয়েছেন শেষ বছরের কাজের সমন্বয় আরও ভালোভাবে যেন হয়।’ দফতর বদলকে কেউ কেউ ‘অবনমন’ বললেও নতুন সমাজকল্যাণমন্ত্রী বিষয়টি ইতিবাচকভাবেই দেখতে চান। তিনি বলেন, ‘আমি সবচেয়ে কম বাজেটের একটি মন্ত্রণালয়ে (বিমান) ছিলাম। এখন আমি অনেক বড় বাজেটের একটি মন্ত্রণালয়ে যাচ্ছি। এখানে প্রান্তিক মানুষের জন্য কাজ করার অনেক জায়গা আছে।’ গত চার বছরের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে মেনন বলেন, ‘আমার পক্ষ থেকে সিভিল এভিয়েশন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে কাজ করা খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল। যখন আমি দায়িত্ব নিয়েছিলাম, তখন অনেকে তাচ্ছিল্য করেছিল। বন্ধুরা বলত, “তোমাকে একটি ডুবন্ত জাহাজ তুলতে দিয়েছে”।’ তার সময়ে সিভিল এভিয়েশনে কী কী অগ্রগতি হয়েছে, তার একটি বিবরণও সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন মেনন। বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর বিমান পরপর তিনবার লাভ করেছে। অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রীদের যাতায়াত বেড়েছে।’ মন্ত্রিসভার রদবদলে কেবল তিন শরিকের পরিবর্তনে জোটে বিরূপ প্রভাব পড়বে কিনা— এ প্রশ্নে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি বলেন, তেমন কোনো শঙ্কা তিনি দেখছেন না। এই পরিবর্তনের আভাস আগেই পেয়েছিলেন কিনা, এ পরিবর্তনে খুশি কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দেখেন, আমি এক কথায়…। প্রশ্নটা হলো…আমি রাজনীতি করি। আমরা সব বিষয়ের জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকি।’
আনিসুল ইসলাম মাহমুদ : এ সরকারের প্রথম থেকেই পানিসম্পদমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন জাতীয় পার্টির (এরশাদ) প্রেসিডিয়াম সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। তাকে দফতর বদল করে দেওয়া হয়েছে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। গতকাল তিনি বলেন, ‘সরকারে ছিলাম, সরকারে আছি। প্রধানমন্ত্রী যে দায়িত্ব দিয়েছেন তা আগেও পালন করেছি, আগামীতেও করব।’ দফতর বদলের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি কিছু বলব না। সরকারে ছিলাম, সরকারে আছি।’
তারানা হালিম : দফতর বদল করা হয়েছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমেরও। তাকে দেওয়া হয়েছে তথ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব। দফতর বদলের প্রতিক্রিয়ায় গতকাল তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের কাজ শেষ করে এনেছি। স্যাটেলাইট বিষয়ে মানুষের কোনো ধারণা ছিল না, থাকলেও ভ্রান্ত ধারণা ছিল। আমি সেই ধারণা সৃষ্টি করেছি এবং ভ্রান্ত ধারণা পাল্টে দিয়েছি। এ রকম পরিস্থিতিতে আমাকে সরিয়ে দেওয়াটা মানুষ হিসেবে একটু লাগে। আমি তো ফেরেশতা নই, অন্য কিছুও নই; মানুষ। রক্তে-মাংসে গড়া।’ তারানা হালিম প্রশ্ন করেন, ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটসহ আমার হাতে সম্পন্ন করা জিনিসগুলো যখন প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অন্য কেউ উদ্বোধন করবেন, তা যখন আমি দেখব, আমার লাগাটা কি স্বাভাবিক নয়?’ নতুন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সামনের পথ কী হবে, আমি জানি না। এ নিয়ে আমি কিছু ভাবিনি, পরিকল্পনাও করিনি। গত দুই বছর সততার সঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে দায়িত্ব দিয়েছেন, তা পালন করেছি। প্রধানমন্ত্রীর মুখ উজ্জ্বল করার চেষ্টা করেছি।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘তার পরও আমি কৃতজ্ঞ আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনার ওপর। তিনি আমাকে দুবার এমপি বানিয়েছেন, প্রতিমন্ত্রী বানিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে তার সেই বিশ্বাস ও আস্থা রাখার চেষ্টা করেছি। তবে নতুন যে দায়িত্ব সেখানে আমার কী কাজ হবে, তা জানি না। এ নিয়ে আমি কোনো পরিকল্পনাও করিনি।’