আজকের সেরা

সরকারি কলেজ মাঠে মেলা; নেই হস্তশিল্প, নেই ঈদের আনন্দ! আছে লটারি, জুয়া আর অশ্লীলতা

By Daily Satkhira

October 29, 2016

আমির হোসেন খান চৌধুরী ও হাসানুজ্জামান: ঘুরে ফিরে নাম ও চেহারা বদলিয়ে সাতক্ষীরাবাসীর সামনে বারবার ফিরে আসছে গণলুণ্ঠনের র‌্যাফেল ড্র, ওঠাও বাচ্চা। লক্ষ লক্ষ মানুষের পকেট কেটে দিনের শেষে ২০/২৫ জন আনন্দ নিয়ে ফিরতে পারলেও হাজারো মানুষ নিজেদের পরিবারের অন্ন-বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা এমনকি সন্তানের পড়াশোনায় অর্থ ব্যয় না করে ছুটছে লটারির অন্তরালে জুয়ার পিছনে। সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ জেলা বৃহত্তম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কি শিখছে সেই প্রতিষ্ঠানের প্রায় ১৫০০০ শিক্ষার্থী? তারা দেখছে সামসে উচ্চ মাধ্যমিকসহ একের পর এক পাবলিক পরীক্ষা কিন্তু তাদের ক্যাম্পাস সংলগ্ন মাঠে গভীর রাত পর্যন্ত চলছে উদ্দাম নগ্ন নৃত্য, র‌্যাফেল ড্র নামক জুয়া আর মাইকিং করে হাউজি খেলা। শুধু উচ্চ মাধ্যমিক নয়Ñ সামনে আছে মাধ্যমিক পরীক্ষা, মেলার মধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীর চূড়ান্ত মডেল টেস্ট পরীক্ষা। স্কুলের বাৎসরিক পরীক্ষাতো নিঃশ্বাস ফেলছে ঘাড়ের উপরে। কারও কোন মাথা ব্যাথা নেই, কারও কোন ভ্রুক্ষেপ নেই আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যতের প্রতি! থাকবে কি করে? মেলা যে চলছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ব্যানারে! মুক্তিযোদ্ধারা জাতির সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাদের আত্মত্যাগ আর অসীম বীরত্বে বাঙালির আজম্ম লালিত স্বাধীনতা সম্ভব হয়েছিল একাত্তরে। কিন্তু বিষ্ময়কর হলেও সত্য সাতক্ষীরা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নামে চলা এই মেলায় ঈদের কোন আনন্দ নেই, গ্রামীণ হস্তশিল্পের কোন দেখা মিলছে না! চলছে শুধু কাঁচা টাকা উড়িয়ে ফূর্তি আর ফতুর হওয়ার খেলা! আর এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। এ বিষয়ে সমাজের প্রভাবশালী কোন অংশেরই কোন বক্তব্য না থাকায় ক্ষোভ ঝরে পড়ছে জেলার মানুষের মধ্যে। গণমাধ্যম, রাজনীতিবিদ, প্রশাসন, পুলিশ, নাগরিক সমাজে সকলের সমালোচনা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

গ্রামীণ হস্তশিল্প ও ঈদ আনন্দ মেলার নামে সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ মাঠে হাউজি আর লটারিতে মেতে ওঠা মানুষেরা কেউ কেউ মোটা টাকা নিয়ে ঘরে ফিরছেন। আবার কেউ বা চাল কিনবার টাকা খুইয়ে খালি হাতে বাড়ি ফিরে বউয়ের বকুনি শুনছেন। পারিবারিক ঝগড়া ও অশান্তিতে  জড়িয়ে পড়ছেন তারা। জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কল্যাণের কথা বলে গত ১৩ অক্টোবর সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ মাঠে এক মাসের অনুমতি নিয়ে আয়োজিত মেলায় হস্তশিল্প দূরে থাক, বসেনি কোনো ক্রয়যোগ্য সামগ্রীও। তবু মেলায় প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের ভিড়। প্রতিদিন সন্ধ্যায় বসছে মেলার নামে হাউজি ও লটারির টাকা ভাগাভাগি। চলছে রাতভর মাতামাতি। এর সাথে যুক্ত হয়েছে সার্কাসের মতো রুচিশীল বিনোদন।  লটারি আর হাউজি নিয়ে হৈ হুল্লোড় আর মাইকের প্রচ- ঘ্যানঘ্যানানিতে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া লাটে উঠবার উপক্রম হয়েছে। ১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দেশ জুড়ে জেএসসি ও জেডিসি পরিক্ষা। স্কুলগুলিতেও চলছে এসএসসি নির্বাচনী পরিক্ষা।  সাতক্ষীরার শিক্ষাপাড়া নামে খ্যাত সরকারি কলেজের চারপাশে রয়েছে ডজন চারেক ছাত্র ও ছাত্রী মেস ও হোস্টেল। তাদের লেখাপড়া নিয়ে অভিভাবকরা রীতিমতো উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন। এর মধ্যেও থেমে নেই চটকদার প্রচার প্রচারণা, প্রচার মাইকের বিরক্তিকর কান ফাঁটা বিকট শব্দ। মাত্র ২০ টাকার টিকেট। পুরস্কার থাকছে দুই লাখ দশ হাজার টাকার পালসার মোটর সাইকেল ছাড়াও মূল্যবান সামগ্রী। হরদম টিকেট বিক্রি হচ্ছে। মানুষ কিনছেও বেশ। যদি লাইগ্যা যায়। ভাগ্য পরীক্ষায় নেমেছেন তারা। এ মেলার অনুমতিদাতা সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক আবুল কাসেম মো. মহিউদ্দিন বলেন মেলায় লটারি, হাউজি, পুতুল নাচ কোনোটিরই অনুমতি নেই। তিনি বলেন আমরা অনুমতি দিয়েছি মুক্তিযোদ্ধা সংসদের উন্নয়নকল্পে রুচিসম্পন্ন বিনোদনের মাধ্যমে হস্তশিল্প মেলার। কোনো অপসংস্কৃতি চার্চার জন্য নয়। তিনি জানান, ২৮ অক্টোবর এই মেলার সমাপ্তির দিন। এ মেলা বর্ধিত করার আবেদন পেয়েছি কিন্তু আমরা তা বাড়াবো না। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাতক্ষীরা জেলা ডেপুটি কমান্ডার আবু বক্কর সিদ্দীক বলেন, মেলায় কোন অশ্লীলতা হচ্ছে না। আর হাউজি খেলা বা র‌্যাফেল ড্র বহু জায়গায় হয়। তবে সামনে সাতক্ষীরায় আর কোন মেলা হবে কি না সন্দেহ। অন্যদিকে সাতক্ষীরা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ইউনিট কমান্ডার ইনামুল হক বিশ্বাস বলেন, “মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ব্যবহার করে আয়োজিত মেলায় এমন নোংরামি আর লটারি ও হাউজি চলায় মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানহানি হয়েছে।” অবিলম্বে এ ধরনের অপতৎপরতা বন্ধ করা না হলে আন্দোলনে যাবেন বলেও জানান তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে প্রতিদিন হাউজিতে অংশ নিচ্ছেন তিন হাজারেরও বেশি মানুষ। এতে অংশ নিচ্ছে দিন আনা দিন খাওয়া সাধারন শ্রমজীবীঢ নাগরিকও। দিনের আয়ের টাকা ঢেলে দিয়ে খালি হাতে ফিরছেন তারা। অপরদিকে যারা ধনাঢ্য, সমাজে মান সম্মান প্রতিপত্তি আছে, জনপ্রতিনিধিত্ব করেন, রাজনৈতিক দল করেন, কিংবা পেশাজীবী তারাও দিব্যি রাত জেগে হাউজি খেলছেন। হারছেন কিংবা জিতছেন। তবু এই মরণ নেশায় মেতে ওঠা মানুষের কোনো আক্ষেপ নেই। মেলায় বসে সিগারেট ফুঁকছেন। মাদক নিয়ে মাতামাতি করছেন। নারীদের নিয়ে অশোভন মন্তব্য করছেন। তাদের উত্ত্যক্ত করছেন। এ যেন এক  নিয়ন্ত্রণহীন আদিম উৎসবে এসেছেন তারা। তারা দিনের পর দিন লটারির টিকিট কিনছেন একটা দুইটা নয়, অনেকগুলি। এরপর রাত জেগে মাঠ বসে থাকা। প্রতিদিন ১২৩ টি বাক্স নিয়ে লটারির টিকিট বিক্রি করতে জেলার গ্রামগঞ্জে ঘুরে বেড়াচ্ছে বিক্রয়কর্মীরা। মনভুলানো চটকদার প্রচার করছেন তারা। বিক্রিও হচ্ছে দেদারসে। রাত ১১ টায় সবগুলি বাক্স থেকে বের করা হচ্ছে বিক্রিত টিকিটের একাংশ। এতে লেখা থাকছে ক্রেতার নামসহ  মোবাইল নম্বর।  রাত ১২ টায় টিকিটগুলি এক জায়গায় করা ও একটি একটি করে তুলে দেখানোর কাজটি দেখানো হয় স্যাটেলাইটে। একজন শিশুর চোখ বেঁধে রাখা হয় কাপড় দিয়ে। শিশুটি হাজার হাজার  টিকিটের ঝাঁপি থেকে একটি করে তুলছে। আর সঞ্চালক তার নম্বর প্রচার করে এর বিপরীতে পুরস্কারের ঘোষণা দেবেন। শিশুটিকে সঞ্চালক বলবেন  ‘উ ঠা ও    বা ” চা’। চোখ বাঁধা শিশুটি ফের একটি করে টিকিট তুলবে। এভাবে রাত জেগে হাজার হাজার মানুষের ভাগ্যে জুটছে ঘোড়ার ডিম আবার গুটিকয়েকের কপালে লাগছে মোটর সাইকেল, মোবাইল কিংবা ফ্রিজ। অথবা অন্যকিছু। এতে অংশ নিচ্ছেন শত শত সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ। তাদের সারা দিনের রোজগারের টাকা এভাবেই খেয়ে ফেলছেন সবুজ বাংলা লটারির পরিচালক আজিজ আহমেদ সোহেল আর তার দালাল কথিত মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ নেতা সোহাগসহ একটি দুষ্টচক্র। দিনের আয়ের টাকা খুইয়ে বাড়ি যেয়ে পারিবারিক অশান্তিতে জড়িয়ে পড়ছে মানুষ। প- হয়ে যাচ্ছে সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় চাল ডাল নুন তেল কেনা কাটা, রোগীর ওষুধ। ২০ টাকার টিকিট কিনে তাই কেউ পৌষ মাসের মুনাফা নিচ্ছেন। আবার কেউ ঘরে ডেকে নিচ্ছেন সর্বনাশ। দৈনিক গড়ে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টিকিট বিক্রি হচ্ছে। সেই হিসাবে টিকিট বিক্রি করে দৈনিক কম বেশি ১৫/২০ লাখ হাতিয়ে নিচ্ছে সবুজ বাংলা ট্রেড ফেয়ার। দৈনিকের এই আয়ের এক চতুর্থাংশ দিয়ে পুরস্কার ও অন্যান্য ঘুষ ব্যয় মিটিয়ে বাকি তিন চতুর্থাংশ টাকা উঠছে মেলা  ‘নীলকর সাহেবদের পকেটে’। সন্ধ্যার পরপরই বসছে হাউজি। কলেজ মাঠ জুড়ে বিশাল আকারের প্যান্ডেল। বড় ব্যানারে লেখা হাউজি। এই জুয়াতেই নাম লেখাচ্ছেন সর্বস্তরের মানুষ। কেউ জিতছেন, কেউ হারছেন। পরিচালকরা প্রতিদিন ঘরে তুলছেন কয়েক লাখ টাকা। হাউজিতে মাতোয়ারাদের মধ্যে নারীরাও রয়েছেন। হাউজির প্রতিটি শীটের দাম ৫০ টাকা। কোনো সময় তা বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়। আবার দেড়শ’ টাকাও হচ্ছে। শুক্রবার প্রতি শীট ২০০ টাকা বিক্রি হয়েছে। এদিন দুই লাখ টাকা বোনাস ঘোষনার সিদ্ধান্ত জানানো হয়। হাউজিতে নাম লেখাতে মরিয়া হয়ে উঠছেন অনেকেই। রাতভর খেলার ইচ্ছা নিয়েই মাঠে আসছেন বেশ ফুরফুর মেজাজে সেজেগুজে প্রস্তুত হয়ে। হার জিত যাই হোক, যেনো কোনো আক্ষেপ নেই। গ্রামীণ হস্তশিল্প ও ঈদ আনন্দ নামের এ  মেলা উদ্বোধন করার কথা ছিল মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক এর। সে অনুযায়ী দাওয়াত পত্রও ছাপানো হয়েছিল। জনশ্রুতি রয়েছে তিনি কর্মসূচি বাতিল করেন একজন জনপ্রতিনিধির চাপের মুখে। পরে ওই চাপপ্রয়োগ করা জনপ্রতিনিধিকে বিশেষভাবে সন্তষ্ট করা হয়। জেলা মেলা পরিচালনার অনুমতি দিয়ে নয়টি বিষয় নিষিদ্ধ করে দিলেও আয়োজকরা তার কোনো গুরুত্বই দেননি। এর মধ্যে রয়েছে জুয়া হাউজি লটারি নগ্ন নৃত্য নিষিদ্ধ, কোনো ধরনের মাদক গ্রহন, পুতুল নাচ, অধিক রাত্রি পর্যন্ত মেলা পরিচালনা না করা, সহনীয়ভাবে মাইক বাজানো, আজান ও নামাজের সময় মাইক বন্ধ রাখতে হবে। এ ছাড়া স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী দিয়ে আইনশৃংখলা রক্ষায় সহায়তা করা। জেলা প্রশাসক আবুল কাসেম মো. মহিউদ্দিনের কাছে বিষয়টি সম্পর্কে জানানো হলে তিনি সরাসরি বলেন ‘এর কোনো অনুমতি নেই।’ হাউজি, লটারি ও নগ্ন নৃত্য সম্পর্কে জানতে চাইলে সাতক্ষীরার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার একেএম আরিফুল হক বলেন ‘ওসব বিষয়ে অনুমতি দেওয়া না দেওয়া জেলা প্রশাসনের দায়িত্ব। পুলিশ শুধু আইন শৃংখলাই দেখছে’। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসকের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি।