আট হাজার ভুয়া ডক্টরেট ডিগ্রিধারী পাকড়াও করতে মাঠে নামছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। শুধু ডিগ্রিধারী নয়, যারা এ সনদ বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত তাদের আইনের আওতায় আনার লক্ষ্যে কাজ করছে সংস্থাটি। বিভিন্ন সূত্রমতে, দেশে সাড়ে আট হাজারের মতো ব্যক্তি ভুয়া ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়েছেন দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে। তাদের অনেকে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। তদন্তে সহযোগিতা করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তা নেবে দুদকের এ সংক্রান্ত তদন্ত টিম। দুদকের একজন পরিচালক সাংবাদিকদের বলেন, সারাদেশের জাল সনদ নিয়ে দুদকের বড় একটি টিম কাজ করছে। জাল সনদের কাজ করতে গিয়ে প্রচুর ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রি ধরা পড়ছে। এ ডিগ্রি নিয়ে অনেকেই পদোন্নতি, আর্থিক সুযোগ নিচ্ছেন। এতে সরকারের অতিরিক্ত অর্থ খরচ হচ্ছে। এ জন্য এ সনদকে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করছি। এ বিষয়ে দুদকের একজন কর্মকর্তা বলেন, জাল সনদ ধরতে দুদকের কয়েকটি টিম সারা দেশে কাজ করছে। সেখানে যত ধরনের জাল সনদ পাওয়া যাবে সবগুলো তদন্ত করে ধরা হবে। পিএইচডি ডিগ্রির ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি জানান, সব জাল সনদ ধরা হবে। সেটা যে পর্যায়েরই হউক।
জানা যায়, ভুয়া ডিগ্রি নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করছে। প্রকৌশলী, আমলা, শিক্ষক এমনকি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিদের সনদ এই তদন্তের আওতায় আনা হবে। তদন্ত টিমের কর্মকর্তারা জানান, কারও সনদ নিয়ে যে কেউ ইচ্ছে করলে লিখিত আকারে আমাদের কাছে অভিযোগ করতে পারবেন। এছাড়াও মাউশি, ডিআইএ’র অভিযোগগুলো আমলে নিয়ে আমরা তদন্ত করবো। কর্মকর্তারা জানান, দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্তের ১৪টি টিম জাল সনদ নিয়ে এক সঙ্গে কাজ করছে। এই টিমের তিন মহাপরিচালকের অধীনে ৬ জন পরিচালকসহ আরো বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা কাজ করছেন। দুদকের কর্মকর্তারা জানান, তদন্তে আমরা এমন পিএইচডি ডিগ্রি পেয়েছি যারা এ ডিগ্রি নেয়ার ন্যূনতম শর্ত পূরণ করেনি। এটা দেখার দায়িত্ব থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর আবদুল মান্নান দুদকের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, এ ব্যাপারে নোটিশ দিতে দিতে হয়রান হয়ে গেছি। ইউজিসির আইনে ভুয়া পিএইচডি ধরার কোনো সুযোগ নেই। এটা ফৌজদারি অপরাধ। কারণ এ সনদ দেয়া ও নেয়ার ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেন হয়। তাই এগুলো ধরার দায়িত্ব দুদক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। আর ইউজিসিতে জাল সনদ ধরার উইং নেই, লোকবলও নেই। তাই দুদকের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। তিনি বলেন, ভুয়া পিএইচডি সনদ নিয়ে অনেকেই সরকারি ও বেসরকারি দপ্তরে কাজ করে। সবাইকে ধরা উচিত। দুই বছর আগে ডিআইএ’র দেয়া তথ্য অনুযায়ী তখন এমন ভুয়া সনদধারী ছিল ৫ হাজারের মতো। এখন তা সাড়ে আট হাজার হবে বলে ডিআইএ সূত্র জানিয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রফেসর ড. তারেক শামসুর রেহমান দুদকের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, যেটা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের করার কথা ছিল সেটা দুদককে করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, সরকারি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন পিএইচডি ডিগ্রি দেয়া হচ্ছে। এসব ডিগ্রির কোনো গুণগত মান নেই। কোনো গবেষণা হয় না। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলতে পারি, যেখানে অনেক বিভাগের পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে প্রশ্ন আছে। অনেকেই ডিগ্রি নিয়েছেন যারা কোনোদিন গবেষণা তো দূরের কথা লাইব্রেরি পর্যন্ত যায়নি। এসব ভুয়া ডিগ্রি নিয়ে ইউজিসির একটি কমিটি গঠন করা উচিত। সম্প্রতি বিসিএসআইআরের একজন ঊর্ধ্বতন গবেষণা কর্মকর্তার সনদ নিয়ে দুদকের কাছে অভিযোগ করেছেন ওই দপ্তরের কয়েকজন। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছে দুদক। দুদকের কর্মকর্তারা জানান, এ সংক্রান্ত অভিযোগ তদন্ত করে আমরা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়ে দেব। এছাড়া সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পিএইচডি ডিগ্রি তদন্ত করতে গিয়ে অননুমোদিত প্রতিষ্ঠান থেকে জাল সনদ নেয়ার বিষয় ধরা পড়ে। এর মধ্যে আমেরিকানওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির নামে প্রায় ৫ হাজারের বেশি ব্যক্তি পিএইচডি ডিগ্রি নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম ২০১৪ সাল থেকে বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে আরো বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রি বিক্রি করছে। এরমধ্যে আছে ইন্টারন্যাশনাল কালচারাল ইউনিভার্সিটি, ইন্টারন্যশনাল ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ক্যালানিয়া, ইউনিভার্সিটি অব সালায়গন, ওপেন ইউনিভার্সিটি অব মালয়েশিয়া, দার্জি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন, নর্থ আম্বিয়া ইউকে, হিলিয়েট ওয়ার্ক ইউনিভার্সিটি, গ্রীন ইয়ুথ, রয়েল রুথ অব কানাডা। এসব প্রতিষ্ঠানের নামে বাংলাদেশে শাখা খুলে সনদ বাণিজ্য করে বিভিন্ন চক্র।