ছয় মহাদেশের ২০৯ দলের ৮৬৪ ম্যাচের লড়াই শেষে চূড়ান্ত হয়েছে ২০১৮ সালের রাশিয়া বিশ্বকাপের ৩২ প্রতিনিধি। ২০১৮ সালের ১৪ জুন স্বাগতিক রাশিয়া ও সৌদি আরবের ম্যাচ দিয়ে শুরু হবে রাশিয়া বিশ্বকাপ। কিন্তু তার আগেই বিশ্বকাপজ্বরে কাঁপছে পুরো বিশ্ব। গত বছর নভেম্বরে মস্কোয় জমকালো ড্রয়ে ভাগ্য নির্ধারিত হয়েছে ৩২ দলের কে কোন গ্রুপে খেলবে।
সাধারণত স্বাগতিক দলই থাকে ‘এ’ গ্রুপে। এবার রাশিয়া স্বাগতিক হওয়ায় তাদের জন্য গ্রুপ ‘এ’ আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। বাকি সব দলের ভাগ্য নির্ধারিত হয়েছে লটারিতে। স্বাগতিক হওয়ার সুবাদে ১১ বারের মতো রাশিয়া বিশ্বকাপে অংশ নিতে যাচ্ছে। স্বাগতিকের সুবিধা কাজে লাগিয়ে তারা কতদূর নিজের দলকে টেনে নিতে পারে, সেটা দেখার জন্য মুখিয়ে আছে ফুটবলবিশ্ব। গত বছর অক্টোবরে ফিফা র্যাংকিংয়ের হিসাবে ড্রর জন্য চারটি পটে আট দলকে রাখা হয়। রাশিয়ার সঙ্গে শীর্ষ সাত দল রাখা হয় এক নম্বর পটে। পরের আট দল দুইয়ে, এভাবে সাজানো হয় পটগুলো।
ইউরোপ ছাড়া অন্য কোনো মহাদেশের একটির বেশি দল এক গ্রুপে পড়েনি। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা বরাবরের মতো এবারও আলাদা গ্রুপে। ব্রাজিল আছে ‘ই’ গ্রুপে। সেখানে তাদের প্রতিপক্ষ সুইজারল্যান্ড, কোস্টারিকা ও সার্বিয়া। ‘ডি’ গ্রুপে আর্জেন্টিনার সঙ্গী ক্রোয়েশিয়া, আইসল্যান্ড ও নাইজেরিয়া।
তুলনামূলক কঠিন গ্রুপে পড়েছে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পর্তুগাল। তাদের গ্রুপে আছে একবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন স্পেন। বর্তমান চ্যাম্পিয়ন জার্মানির গ্রুপে শক্ত প্রতিপক্ষ সুইডেন। প্লে-অফের ফাঁড়া কাটিয়ে শেষ দল হিসেবে বিশ্বকাপে জায়গা পায় পেরু।
সবার বিচারেই ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপের হট ফেভারিটের তকমা দখল করেছে পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল। রাশিয়া বিশ্বকাপে বাছাই পেরিয়ে সবার আগে টিকেট নিশ্চিত করেছিল দলটি। বর্তমান কোচ টিটে দায়িত্ব গ্রহণের পর দ্রুত পাল্টে গেছে ব্রাজিল। সব দল যেখানে রাশিয়ার টিকেট পাওয়ার জন্য মুখিয়ে ছিল, সেখানে অনায়াসেই বাছাইপর্ব টপকে সবার আগে রাশিয়া টিকেট অর্জনের কৃতিত্ব দেখায় পেলের উত্তরসূরিরা। বিভিন্ন ইউরোপীয় ক্লাবে খেলা তারকা ফুটবলারদের নিয়ে দলটি পরিপূর্ণ এবং অনেকের মতে, এবারের বিশ্বকাপে ফেভারিট ব্রাজিল। দলটির প্রতিটি পজিশনেই উপস্থিতি রয়েছে পরীক্ষিত সব পারফরমারের, যাঁদের মধ্যে অন্যতম নেইমার।
ব্রাজিলের পরই রাশিয়া বিশ্বকাপে ফেভারিট জার্মানি। বর্তমান চ্যাম্পিয়ন দলটিতে কিছুটা হলেও অভিজ্ঞ ফুটবলারদের ঘাটতি রয়েছে। ২০১৪ সালের বিশ্বকাপের শেষ মুহূর্তে গোল দিয়ে দলটি শিরোপা জিতলেও মূলত তারুণ্যনির্ভর জার্মান দলই অংশ নেবে এবারের রাশিয়া বিশ্বকাপে। ২০১০ সালের চ্যাম্পিয়ন ফুটবলের ধারক-বাহক স্পেন আসন্ন রাশিয়া বিশ্বকাপের তৃতীয় ফেভারিট। অনেক তরুণ ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন স্প্যানিশ দলটির টার্গেট গত বিশ্বকাপের দুঃস্বপ্ন ভুলে শ্রেষ্ঠত্ব পুনরুদ্ধার করা।
বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে চরম হতাশার পর আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপের টিকেট পাবে কি না, সেটা নিয়েই সৃষ্টি হয় অনিশ্চয়তা। ইকুয়েডরের সঙ্গে নাটকীয় জয়ে রাশিয়ার টিকেট নিশ্চিত হলেও অনেকেই আর্জেন্টিনার বর্তমান দলকে রাশিয়া বিশ্বকাপে ফেভারিট মানতে নারাজ। আর্জেন্টিনা দলে অনেক তারকা ফুটবলার আছেন, কিন্তু জাতীয় দলে তাঁরা নিজেদের সেরাটা দেখাতে ব্যর্থ হন। যার ফলে পুরো চাপটা এসে পড়ে মেসির কাঁধে। ইকুয়েডরের সঙ্গে ম্যাচে মেসির হ্যাটট্রিক না হলে রাশিয়া বিশ্বকাপে আর্জেন্টাইনদের দর্শক হয়েই হয়তো কাটিয়ে দিতে হতো। ১৯৭০ সালের পর এই প্রথম এতটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে তারা মূল পর্ব নিশ্চিত করে।
গত তিন বছরে টানা তিনটি টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠে প্রতিবারই আর্জেন্টিনাকে ফিরতে হয়েছে খালি হাতে। ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে শেষ মুহূর্তে গোল খেয়ে বসে আর্জেন্টিনা। পরের দুই বছর কোপা আমেরিকার ফাইনালে চিলির কাছে টাইব্রেকারে হারে দুবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা। আর্জেন্টাইন কোচ সাম্পাওলির অধীনে দলটির উন্নতি তেমন চোখে পড়ার মতো নয়। তাই রাশিয়ায় শিরোপা লড়াইয়ে থাকতে হলে দলের আরো দ্রুত উন্নতি করতে হবে দলটিকে। রাশিয়া বিশ্বকাপের ‘ডি’ গ্রুপে আর্জেন্টিনাকে লড়তে হবে আইসল্যান্ড, নাইজেরিয়া ও ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে।
সদ্যসমাপ্ত রাশিয়া বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে সবচেয়ে বেশি গোল করার কৃতিত্ব অস্ট্রেলিয়ার দখলে। ২০ ম্যাচে তারা করেছে ৪৮ গোল। তবে ম্যাচপ্রতি গড়ে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড গড়েছে ইউরোপের অন্যতম আলোচিত দল বেলজিয়াম। অ্যাটাকনির্ভর দলটির ম্যাচপ্রতি গোলের গড় ৪ দশমিক ৩। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ও লিওনেল মেসির মতো স্ট্রাইকারকে টপকে বাছাইপর্বের সর্বোচ্চ গোলের মালিক পোলিশ স্ট্রাইকার রবার্ট লেমনডস্কি। জার্মান জায়ান্ট বার্য়ান মিউনিখের স্ট্রাইকার ম্যাচে করেন সর্বোচ্চ ১৬ গোল।
উরুগুয়ে বিশ্বকাপ জিতেছে দুবার। ১৯৬৬ সালে নিজেদের দেশে আয়োজিত বিশ্বকাপ জেতার পর থেকে ইংল্যান্ড একবার এই প্রতিযোগিতার সেমিফাইনালে উঠতে সক্ষম হয়েছিল। পর্তুগালের নেতৃত্বে থাকবেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। প্রতিটি দলই চাইবে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে।
এবারের বিশ্বকাপে সবচেয়ে বড় অঘটন চারবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ইতালির বাছাইপর্ব থেকে বাদ পড়ে যাওয়া। ইউরোপ অঞ্চলের বিশ্বকাপ বাছাইয়ের প্লে-অফ পর্বের দ্বিতীয় ম্যাচে সুইডেনের বিপক্ষে গোলশূন্য ড্র করে রাশিয়া বিশ্বকাপে খেলা হচ্ছে না ইতালির। অন্যদিকে প্রথম লেগে ঘরের মাঠে ১-০ গোলে জেতায় ১২ বছর পর বিশ্বকাপ খেলা নিশ্চিত হলো সুইডেনের।
একদিনে কান্নার রোল, অন্যদিকে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। তবে নিজ মাঠে গ্যালারিভর্তি দর্শকদের হতাশার সাগরে ভাসিয়ে রাশিয়া বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়া মানতে পারছেন না মিলানবাসী। ইতালির ছিটকে পড়ার থেকেও মানুষের মনে দাগ কেটেছে কিংবদন্তি জিয়ুনলুইজি বুফনের চোখের জল। বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করতে না পারলে সান সিরোতে সুইডেনের বিপক্ষে প্লে-অফের ম্যাচটিই হবে ইতালির জার্সি গায়ে তার শেষ ম্যাচ। ম্যাচের আগে এমনটাই ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেও সুইডেনের বিপক্ষে গোলের দেখা পায়নি ইতালি। ব্যর্থতায় মোড়ানো এই ম্যাচ হয়ে থাকল বুফনের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ। আর ৬০ বছর পর বিশ্বকাপ খেলা থেকে বঞ্চিত হতে হলো ইতালিকে।
বিশ্বকাপের আট গ্রুপ :
গ্রুপ-এ : রাশিয়া, উরুগুয়ে, মিসর, সৌদি আরব
গ্রুপ-বি : পর্তুগাল, স্পেন, ইরান, মরক্কো
গ্রুপ-সি : ফ্রান্স, পেরু, ডেনমার্ক, অস্ট্রেলিয়া
গ্রুপ-ডি : আর্জেন্টিনা, ক্রোয়েশিয়া, আইসল্যান্ড, নাইজেরিয়া
গ্রুপ-ই : ব্রাজিল, সুইজারল্যান্ড, কোস্টারিকা, সার্বিয়া
গ্রুপ-এফ : জার্মানি, মেক্সিকো, সুইডেন, দক্ষিণ কোরিয়া
গ্রুপ-জি : বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড, তিউনিসিয়া, পানামা
গ্রুপ-এইচ : পোল্যান্ড, কলম্বিয়া, সেনেগাল, জাপান