রাষ্ট্রপতি হিসেবে মো. আবদুল হামিদের পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ হচ্ছে আগামী ২৩ এপ্রিল। সংবিধান অনুযায়ী আগামী এক মাসের মধ্যে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করতে হবে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, এ পদে আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনের তফসিল নির্ধারণের লক্ষ্যে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সঙ্গে আগামীকাল বুধবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদার বৈঠকের ব্যবস্থা করতে সংসদ সচিবালয়কে অনুরোধ জানানো হয়েছে। এই প্রস্তুতির মধ্যে আগামী রাষ্ট্রপতি কে হচ্ছেন এ নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে চলছে নানা আলোচনা। এ আলোচনায় দলটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের নাম বিশেষভাবে উঠে আসছে। পাশাপাশি এটাও শোনা যাচ্ছে, বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকেই দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত করা হবে। বঙ্গবন্ধুর ছোট কন্যা শেখ রেহানা, স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর নামও আলোচনায় আছে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা জানান, গত মেয়াদে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা ও তৎকালীন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু তখন শেখ রেহানা ও সৈয়দ আশরাফ কেউই প্রস্তাবে সায় দেননি। তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। সৈয়দ আশরাফ তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছিলেন। সে কারণে তিনি দল ছেড়ে রাষ্ট্রপতি হতে চাননি। এখন সৈয়দ আশরাফ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করছেন। দলীয় কর্মকাণ্ডেও আগের মতো সক্রিয় নেই। ফলে এবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার প্রস্তাব পেলে তা প্রত্যাখ্যান করার সম্ভাবনা কম। আর রাষ্ট্রপতি পদ নিয়ে সৈয়দ আশরাফদের পরিবারের কিছু নস্টালজিয়া আছে। সৈয়দ আশরাফের বাবা সৈয়দ নজরুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির গুরুদায়িত্ব সামলেছেন।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ওই নেতাদের মতে, আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী নেতারা এবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করবেন অনেক ভেবেচিন্তে। কারণ এবার যিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন তাঁর মেয়াদেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। যেকোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতিকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে সৎ, পরীক্ষিত এবং দৃঢ়চেতা একজনকে রাষ্ট্রপতি করাকেই সবচেয়ে গুরুত্ব দেবে আওয়ামী লীগ। সৈয়দ আশরাফ আলোচিত এক-এগারোর দুঃসময়ে দলকে সামলেছেন আবার ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। আর বিভিন্ন দল-মতের মানুষের কাছে আশরাফের অন্য রকম গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। ফলে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বিবেচনায় তিনিই এগিয়ে থাকবেন বলে অনেক নেতা মনে করছেন।
আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো জানায়, রাষ্ট্রপতি পদে আবদুল হামিদকে আরেক মেয়াদে নির্বাচিত করার বিষয়েও আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে আলোচনা আছে। আবদুল হামিদকে নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো বিতর্ক হয়নি। মানুষের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতাও রয়েছে। ফলে তাঁকে আরেক মেয়াদে নির্বাচিত করার সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানাকেও রাষ্ট্রপতি পদে দেখা যেতে পারে—এমন আলোচনাও আছে। রেহানা রাজি থাকলে তাঁকে এ পদে দেখা যাবে—এ মতেও বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীকেও রাষ্ট্রপতি পদে দেখা যেতে পারে বলে মনে করে আওয়ামী লীগের একটি অংশ। তাদের মতে উচ্চশিক্ষিত, মেধাবী শিরীন শারমিন চৌধুরীর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চাইলে শিরীন শারমিনই হবেন দেশের প্রথম নারী রাষ্ট্রপতি।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পরবর্তী রাষ্ট্রপতি কে হবেন তা নিয়ে দলের মধ্যে নানামুখী আলোচনা আছে। দলীয় নেতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকসহ অনেকেই আগ্রহী আছেন। তবে আওয়ামী লীগ সভাপতি কারো বিষয়েই এখনো দলীয় নেতাদের কাছে কোনো ইঙ্গিত দেননি। সৈয়দ আশরাফের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এই নেতা বলেন, ‘আশরাফের মতো নির্লোভ ও পরীক্ষিত নেতা রাষ্ট্রপতি হলে সেটি আমাদের জন্য ভালোই হবে। কিন্তু এখানে শেখ হাসিনার চাওয়া ও সৈয়দ আশরাফের সম্মতির ব্যাপার আছে। দেশে-বিদেশে সৈয়দ আশরাফের গ্রহণযোগ্যতার কমতি নেই। তবে এ দেশের ওপর প্রভাবশালী একটি বিদেশি রাষ্ট্র আশরাফকে খুব বেশি পছন্দ করে বলে মনে হয় না।’
এদিকে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় সূত্র জানায়, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের তফসিল নির্ধারণের জন্য আগামীকাল বিকেলে সংসদ সচিবালয়ে জাতীয় সংসদের স্পিকারের সঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) বৈঠক হতে পারে। আজ মঙ্গলবার এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দেওয়া হবে। স্পিকারের সঙ্গে বৈঠকের সময় চাওয়া ছাড়াও দলভিত্তিক সংসদ সদস্যদের নামের তালিকা চেয়েও একটি চিঠি পাঠানো হবে। এর আগে ২০১৩ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ২০ দিন আগে ওই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। ভোটগ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করা হয় ২৯ এপ্রিল। কিন্তু তার আগেই ২৪ এপ্রিল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন বাংলাদেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
সংবিধানে রাষ্ট্রপতির চলতি মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার বিধান রয়েছে। সে অনুযায়ী দেশের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে আগামীকাল ২৪ জানুয়ারি থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যে। সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি পদের মেয়াদ অবসানের কারণে মেয়াদ শেষ হওয়ার দিনের আগের ৯০ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করতে হবে। আইনজ্ঞরা বলছেন, মেয়াদ পূরণের আগের ৯০ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে বলতে প্রথম ৩০ দিনকে বোঝাবে। নির্বাচন কমিশনও তা-ই মনে করে। গতকাল নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ বলেন, সংবিধান অনুসারে আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারির আগেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে।
তবে নির্বাচনের সময় আসন্ন হলেও বিষয়টি নিয়ে নির্বাচন কমিশনে এত দিন তেমন আলোচনা ছিল না। গতকাল সকালে বিষয়টি নিয়ে সিইসি সব নির্বাচন কমিশনার ও কমিশন সচিবকে নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসেন। এ বৈঠকের জন্য নির্বাচন আইন সংস্কার বিষয়ক কমিটির একটি পূর্বনির্ধারিত সভাও বাতিল করা হয়।
প্রসঙ্গত, সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কারো বয়স ৩৫ বছরের নিচে হলে, সংসদ সদস্য নির্বাচনের যোগ্য না হলে এবং সংবিধানের অধীন অভিশংসন দ্বারা রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অপসারিত হলে তিনি অযোগ্য বিবেচিত হবেন। এ ছাড়া রাষ্ট্রপতি নির্বাচনী আইন অনুসারে সংসদ সদস্যরা প্রস্তাবক ও সমর্থক না হলে কেউ প্রার্থী হতে পারবেন না। সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কর্মকর্তারা বলছেন, এবারও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সম্পন্ন হবে। সংসদে ক্ষমতাসীন দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে অন্য কোনো দল থেকে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
সূত্র: কালের কণ্ঠ।