ফিচার

ক্যাডারভুক্তির সুযোগ পাবেন বঞ্চিত ৩ শতাধিক কলেজ শিক্ষক

By Daily Satkhira

January 25, 2018

২০১৬ সাল পর্যন্ত সরকারি হওয়া ৪২ কলেজের তিন শতাধিক কলেজের শিক্ষক-কর্মকর্তারা ক্যাডারভুক্তির সুযোগ পাবেন। ২০১২ সালের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পদ সৃজনের শর্ত, ২০১৪ সালের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) একটি সুপারিশ, ২০১৩ সালের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সিদ্ধান্ত এবং চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি উচ্চ আদালতের দেওয়া আদেশের পর ওই শিক্ষক-কর্মকর্তাদের জন্য এ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আত্তীকরণের পর তিন বছরের মধ্যে কাম্য যোগ্যতা অর্জনের শর্তেই তারা এ সুযোগ নিতে পারবেন। মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৮ সাল থেকে দেশের বেসরকারি কলেজ জাতীয়করণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৩২৫টি কলেজ সরকারি হিসেবে স্বীকৃতি পায়। তবে ৩২৫টি কলেজের মধ্যে ১৭টি কলেজের সব শিক্ষকসহ ৪২টি কলেজের প্রায় তিনশ’ শিক্ষক, প্রদর্শক ও সহকারী গ্রন্থাগারিক আত্তীকরণ থেকে বঞ্চিত হন। বঞ্চিত শিক্ষকদের মধ্যে ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার বীরশ্রেষ্ঠ আব্দুর রউফ কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আনোয়ারা চৌধুরী ও ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক কাজী আমিনুল ইসলামসহ ছয় জন রয়েছেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১২ সালের ২৪ জানুয়ারির প্রজ্ঞাপনে বীরশ্রেষ্ঠ আব্দুর রউফ কলেজ সরকারি হওয়ার পর একই বছর ১৯ জুন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ৪৭ জনের পদ সৃজন করে। পদ সৃজনের শর্তে বলা হয়, উপযুক্ত শিক্ষাগত যোগ্যতা যদি কোনও শিক্ষকের না থাকে, তাহলে সরকারি চাকরিতে আত্তীকরণের তিন বছরের মধ্যে প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার বীরশ্রেষ্ঠ আব্দুর রউফ কলেজের প্রভাষক কাজী আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘বঞ্চিত এসব শিক্ষকদের মধ্যে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আনোয়ারা চৌধুরীসহ আমরা ছয় জন শিক্ষক পদ সৃজনের পরও আত্তীকরণ বঞ্চিত হই। এর প্রেক্ষিতে ২০১৩ সালে হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দাখিল করি। ওই রিটের প্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের ১১ মার্চ দুই মাসের মধ্যে স্বপদে আত্তীকরণের আদেশ দেন আদালত। আদেশে বলা হয়, আত্তীকরণের তিন বছরের মধ্যে কাম্য যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় আত্তীকরণ না করে প্রায় একবছর পর উচ্চ আদালতে আপিল করে। সরকার পক্ষের এই আপিল খারিজ হয়ে যায় ২০১৫ সালের ৮ মার্চ।’ অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, আপিল খারিজ হয়ে যাওয়ার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওই সময়ের যুগ্ম-সচিব ড. মো. ফারুক হোসেন ২০১৬ সালের ২৪ জানুয়ারি শিক্ষকদের নিয়োগের পরামর্শ দেন। ওই পরামর্শে তিনি উল্লেখ করেন, ‘পিটিশনারকে আত্তীকরণ করা যেতে পারে।’ আইনি ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘আপিল দায়েরের কোনও মেরিট না থাকায় তা খারিজ হয়ে যায়। বর্তমান স্তরে আপিল রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশন দায়ের করলে আইনত ফল লাভের বা সরকারের জয় লাভের সম্ভাবনা খুবই কম। উপরন্তু রিভিউ পিটিশন দায়ের করা হলে রাষ্ট্রীয় অর্থ ও সময় অপচয়ের আশঙ্কা রয়েছে।’ এরপরও মাউশি-এর মহাপরিচালক ড. এস এম ওয়াহিদুজ্জামান (বিদায়ী সদস্য) আইন মন্ত্রণালয়ের সলিসিটরকে (রিট) ২০১৬ সালের ৭ এপ্রিল চিঠি দিয়ে রিভিউ করার অনুরোধ জানান। ওই রিভিউ আবেদন চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি খারিজ করে দেন আপিল বিভাগের একটি পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। রিভিউ খারিজের কারণে হাইকোর্টের রায় বহাল থাকে। ফলে বঞ্চিত ওই ছয় শিক্ষককে ক্যাডারভুক্ত করে তিন বছরের মধ্যে কাম্য যোগ্যতা অর্জনের সুযোগ দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে রিটকারী পক্ষের আইনজীবী সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ‘রায়ের পর বঞ্চিত ছয় শিক্ষককে আত্তীকরণ করতে হবে।’ এই রায়ের প্রেক্ষিতে একই রকম বঞ্চিত অন্য শিক্ষকদের মন্ত্রণালয় সুযোগ দিতে বাধ্য কিনা, জানতে চাইলে ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ‘এই রায়ের মধ্যদিয়ে একই রকম বঞ্চিত দেশের অন্যান্য শিক্ষকদেরও সরকারের কাছে আত্তীকরণের দাবি তোলার সুযোগ তৈরি হলো। মন্ত্রণালয় চাইলে আত্তীকরণ করতে পারবে। এছাড়া ভিন্ন রিট করে এই রায়কে রেফারেন্স হিসেবেও কাজে লাগাতে পারবেন অন্য শিক্ষকরা।’ এদিকে, মাউশি-এর একটি সুপারিশেও পদ সৃজনের মাধ্যমে বঞ্চিত বাকি শিক্ষকদের ক্যাডারভুক্ত হওয়ার দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন ‘আত্তীকরণ বঞ্চিত শিক্ষক ও অশিক্ষক জাতীয় ঐক্যে’র সদস্য সচিব হারুন অর রশিদ সাপলু। এ ব্যাপারে অনুসন্ধানে জানা গেছে, ‘২০১৪ সালের ২৪ মার্চ মাউশি-এর তৎকালীন মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন পদ সৃজন থেকে বাদ পড়া শিক্ষকদের আত্তীকরণের সুপারিশ করেন। ফাহিমা খাতুন স্বাক্ষরিত সুপারিশ থেকে জানা গেছে, ২০১০ সালের ১৪ মে বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ ডিগ্রি কলেজ জাতীয়করণ করা হয়। জাতীয়করণের পর নতুন শিক্ষকদের বাদ দিয়ে তালিকা পাঠানো হয় কলেজ থেকে। পরিদর্শনের সময় কাম্য যোগ্যতা না থাকায় ওইসব শিক্ষেকদের তালিকা পাঠানো হয়নি। কাম্য যোগ্যতা অর্জনের পর আবার নতুন করে পাঠানো তালিকা ধরে আরও সাত জন শিক্ষককে নতুন করে ক্যাডারভক্ত করার সুপারিশ করা হয়। এছাড়া ২০১৩ সালের ২৩ জুলাই শিক্ষা মন্ত্রণালয় (অধিশাখা- ৮) থেকে শেখ মুজিবুর রহমান কলেজের ১১ জন শিক্ষককে আত্তীকরণের জন্য তিন বছর সময় বেঁধে দেওয়া হয়। উপ-সচিব মালেকা খায়রুন্নেছা স্বাক্ষরিত এক আদেশে বলা হয়, তিন বছরের মধ্যে সরকার অনুমোদিত যে কোনও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়োগবিধি অনুসারে শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করা সাপেক্ষে সরকারি চাকরিতে আত্তীকরণ করা হবে। এসব শিক্ষকদের পরে ক্যাডার হিসেবে আত্তীকরণ করা হয়েছে। এভাবে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সরকারি হওয়া ৩২৫টি কলেজের অনেক শিক্ষক আত্তীকরণের সুযোগ পান। তবে গত বছর নতুন করে ২৮৩টি কলেজ সরকারিকরণের আওতায় নেয় সরকার। এরপর শুরু হয় ‘নো বিসিএস, নো ক্যাডার’ আন্দোলন। পিছিয়ে পড়ে সরকারি হওয়া কলেজের আত্তীকরণ প্রক্রিয়া। আগের সরকারি হওয়া কলেজের প্রায় তিন শতাধিক শিক্ষক ক্যাডারভুক্তি থেকে বঞ্চিত হন। বঞ্চিত শিক্ষকদের আত্তীকরণ করার বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (কলেজ) ড. মোল্লা জালাল সম্প্রতি জানিয়েছিলেন, ‘কাম্য যোগ্যতা থাকলে সব শিক্ষকদের আত্তীকরণ করা হবে পর্যায়ক্রমে।’ কাম্য যোগ্যতা না থাকলে সেসব শিক্ষকদের আত্তীকরণ করা হবে না।’ সরকার পক্ষের এই বক্তব্যের পর গত ১১ জানুয়ারি আপিল বিভাগে করা রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেন সর্বোচ্চ আদালত। ফলে বহাল থাকে হাইকোর্টের রায়। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মাউশি-এর আইন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন অতিরিক্ত সচিব (কলেজ) ড. মোল্লা জালাল উদ্দিন। মাউশি-এর আইন কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘যারা রিট করেছেন, তারাই বেনিফিট পাবেন। অন্যরা একই রকম হলেও মামলা করেই তাদের বেনিফিট নিতে হবে।’ ‘আত্তীকরণ বঞ্চিত শিক্ষক ও অশিক্ষক জাতীয় ঐক্যে’র সদস্য সচিব হারুন অর রশিদ সাপলুসহ অন্য শিক্ষক নেতারা বলেন, এই রায়ের সুফল পাবেন বঞ্চিত সব শিক্ষকরাই। যদি এক্ষেত্রেও মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিতে না পারে, তাহলে অন্যান্য শিক্ষকরাও তাদের দাবি আদায়ে উচ্চ আদালতে যাবেন। তারা আরও বলেন, ২০১৭ সালে সরকারি হওয়া ২৮৩টি কলেজের আত্তীকরণও আটকে রয়েছে। যদি নতুন বিধিমালা তৈরির আগে এসব শিক্ষকদের নিয়োগে পদ সৃজন করা হয়, তাহলে যাদের কাম্য যোগ্যতা নেই, তাদেরও শর্তসাপেক্ষে ক্যাডারভুক্ত হওয়ার পথ সৃষ্টির সুযোগ তৈরি হবে। শিক্ষক আত্তীকরণ নিয়ে জটিলতা দেখা দেওয়ায় দীর্ঘদিন থেকেই সরকার প্রস্তাবিত বিধিমালা চূড়ান্ত করতে পারছে না বলেও জানান শিক্ষক নেতারা।