বর্তমান সরকারের ১৭১তম মন্ত্রিপরিষদে সোমবারের (২৯ জানুয়ারি) নিয়মিত বৈঠকে চূড়ান্ত অনুমোদিত ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮’-এর ৩২ ধারায় বর্ণিত ‘গুপ্তচর’ শব্দ নিয়ে বিব্রত সরকারের নীতি-নির্ধারণী মহল। বিষয়টি নিয়ে তারা অনেকটা বিব্রত। অনেকেই প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে না চাইলেও নিজেদের মধ্যে অনুষ্ঠিত আলোচনায় বিষয়কে ‘ডিজিটাল গুপ্তচর’বৃত্তি নামে অভিহিত করেছেন। সরকারি প্রশাসনের সর্বোচ্চ দফতর বাংলাদেশ সচিবালয়ে মঙ্গলবার (৩০ জানুয়ারি) মন্ত্রী, সচিবসহ উচ্চপদ্স্থ একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপকালে এমন তথ্য জানা গেছে।
সোমবার অনুমোদিত ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮’-এর ৩২ ধারায় বর্ণিত তথাকথিক ‘গুপ্তচর’ বা এ আইনের অন্য যেকোনও বিষয় সম্পর্কে মঙ্গলবার (৩০ জানুয়ারি) সচিবালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও মন্ত্রী বা সচিব প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি। তবে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্ব-স্ব মন্তব্য উপস্থাপন করেছেন। তবে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমের কাছে এ আইন ও আইনে বর্ণিত ‘গুপ্তচর’ সম্পর্কে জানতে চাইলেও তারা অনেকেই এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। আবার অনেকেই এর যেনতেন ব্যাখ্যা দিয়ে সাংবাদিকদের সন্তুষ্ট করারও চেষ্টা করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, এমন বিতর্কিত বিষয়ে মন্তব্য না করাই ভালো।
সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে অবস্থিত এক মন্ত্রণালয়ের সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। এ নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করা উচিত হবে না।’ তিনি বলেন, ‘‘গুপ্তচর শব্দটি আগেও শুনেছি। এবার শুনলাম নতুন করে শুনলাম ‘ডিজিটাল গুপ্তচরে’র গল্প কাহিনি।’’
এদিকে সচিবালয়ের ৪ নম্বর ভবনের এক মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব পদমর্যদার একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে সরকারের নীতি-নির্ধারকরা অনেকটাই বিব্রত পরিস্থিতিতে পড়েছেন বলে মনে হয়। হয়তো এই অবস্থা কেটে যাবে।’ তবে কিছুটা সময় লাগবে বলে জানান ওই কর্মকর্তা। তিনি আরও বলেন, ‘রাতের টক শো-তে অনেককেই দেখেছি, যেনতেন ব্যাখ্যা দিয়ে সাংবাদিকদের কাছ থেকে পার পাওয়ার চেষ্টা করেছেন।’
মঙ্গলবার সচিবালয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষ ঢাকা চেম্বারের নবনির্বাচিত কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। এ সময় ওই বৈঠকে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদিকরাও উপস্থিত ছিলেন। সরকারের নীতি-নির্ধারক হিসেবে তার কাছে জানতে চাওয়া হয় এ সম্পর্কে। এ সময় তিনি বলেন, ‘আপনারা (সাংবাদিকরা) গণমাধ্যমে যেভাবে বিভিন্ন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করেন, তাতে তাদের মান-ইজ্জত থাকে না। তাদের সম্মান ক্ষুণ্ন হয়। তারা তো জনপ্রতিনিধি। এ আইনের বলে এখন হয়তো এমন পরিস্থিতি থেকে রেহাই পাওয়া যেতে পারে।’ তবে তিনি আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলেন, ‘আইন করা হলেও আমার বিশ্বাস আপনাদের (সাংবাদিক) ঠেকানো যাবে না।’
বাণিজ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮’ অনেক চিন্তা-ভাবনা করেই করা হয়েছে। অনুমোদনের আগে এ আইনটি নিয়ে নিজেদেও মধ্যে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে এ আইনের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। আগের আইসিটি অ্যাক্টটি বিএনপির সময়ে করা ছিল। যেখানে অনেক বিষয় অস্পষ্ট ছিল। নতুন আইনে বিষয়গুলো আরও স্পষ্ট করা হয়েছে।’
এদিকে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক সচিবালয়ে সাংবাদিকদের কাছে বলেন, ‘আমি এ আইন নিয়ে আর কী বলবো? কারণ আইনটি তো আমি করিনি। আইনটি চূড়ান্ত করেছে আইসিটি মন্ত্রণালয়।’ পরে অবশ্য তিনি বলেন, ‘কম্পিউটারে সংঘটিত অপরাধগুলোকে আইনের আওতায় আনতেই এ আাইন করা হয়েছে। যা আগে ছিল না। কোনও কম্পিউটারে যদি লিগ্যাল কিছু পাওয়া যায় এবং তা যদি সত্য হয় তাহলে তা কোনও অপরাধ হবে না বলে আমি মনে করি। সাংবাদিকরা সত্য প্রকাশ করলে তা গুপ্তচরবৃত্তি হবে না। তিনি বলেন, ‘‘যদি সাংবাদিকরা কোনও অবৈধ ঘটনা প্রকাশ করেন, তবে সেটি ‘গুপ্তচরবৃত্তি’ বা অপরাধ হবে না।’’
এ সময় আনিসুল হক বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে উল্লিখিত সংজ্ঞায়িত অপরাধ না করলে এ আইনের মাধ্যমে কেউ হয়রানি হবেন না। এ আইনে কারও বাক-স্বাধীনতা হরণ করা হয়নি। ফলে কারও বাক-স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও চান, এই আইনের মাধ্যমে যেন কেউ হয়রানির শিকার না হন। সে কারণেই ৫৭ ধারা বিলুপ্ত করা হয়েছে। আমি মনে করি, আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারায় বাক-স্বাধীনতা কিছুটা ক্ষুণ্ন হয়েছে। ৫৭ ধারার অপব্যবহার হচ্ছিল, আমরা সেটি বন্ধ করার কমিটমেন্ট করেছিলাম। আমরা সেটিই বাস্তবায়ন করেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘গুপ্তচরবৃত্তি একটি অপরাধ। এটি আগেও ছিল, এখনও আছে। এটি নতুন করে বলার কিছু নেই। জাতির জনককে হত্যা করা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটাক্ষ করা হয়েছে। কিন্তু তাদের আইনের আওতায় আনা যায়নি। এখন ডিজিটাল আইনের মাধ্যমে তাদের আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা করা হয়েছে।’
আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারা অস্পষ্ট ছিল। যেখানে সর্বনিম্ন সাজা ছিল সাত বছর। নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অপরাধগুলোকে স্পষ্ট করে সাজা কম বেশি করা হয়েছে। অপরাধগুলোকে পরিষ্কার করে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।’
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি কেন করা হলো সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আগের অনেক অপরাধের বিচার পেনাল কোডে করা হতো। কিন্তু কম্পিউটার ব্যবহার করে করা সেই একই ধরনের অপরাধগুলোর বিষয়টি আইনে স্পষ্ট ছিল না। তাই কম্পিউটার ব্যবহার করে করা অপরাধের বিষয়গুলোকে নতুন আইনে স্পষ্ট করা হয়েছে।’