শাকিলা ইসলাম জুঁই : জনবল, ডাক্তার সংকট আর দুর্নীতি ও অব্যবস্থ্যপনার কারণে চরমভাবে ভেঙে পড়েছে সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য সেবা। বন্যা কবলিত উপজেলার প্রায় ৪ লাখ মানুষের চিকিৎসা সেবার এক মাত্র আশ্রয়স্থল এ হাসপাতালটিতে ৩৪টি ডাক্তারের পদ থাকলেও ডাক্তার রয়েছে মাত্র ৬ জন। এদের মধ্যে অনেকেই আছেন ডেপুটিশনে আবার কেউ রয়েছেন প্রশিক্ষনে। বিশেষ করে সার্জন, এ্যানেসথেসিয়া, গাইনি, চক্ষু কনসালটেন্ট ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ না থাকায় চরম চিকিৎসা সংকটে পড়েছে এ উপজেলার মানুষ। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, ৪র্থ শ্রেণিসহ মোট ২৩১টি পদের মধ্যে ৭৬টি পদই খালি রয়েছে। দীর্ঘ ৬ মাস ধরে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে এক্স-রে ম্যাশিন ও এ্যাম্বুলেন্সটি। হাসপাতালের একমাত্র এক্স-রে মেশিনটি বিকল থাকায় রোগীদের ছুটতে হয় বাহিরে কোন প্রাইভেট ক্লিনিক অথবা জেলা শহর সাতক্ষীরায় বা খুলনায়। ফলে চরমভাবে উপজেলার ৫০ শয্যা বিশিষ্ট তালার এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে চিকৎসা বঞ্চিত হচ্ছে উপজেলাবাসী। তার মধ্যে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ কুদরত-ই-খূদা ও হেলথ্ ইন্সেপেক্টর মীর মহাসিন আলীর ক্ষমতার দাপট, অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় তালা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি এখন পরিণত হয়েছে চরম দুর্নীতির আখড়ায়। মেডিকেল টেকনিশিয়ান (ডেন্টিস) মোঃ নাসির উদ্দীন দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে অফিস না করেও বেতন ভাতা উত্তোলন করে আসছেন। রাজধানী ঢাকার বাড্ডায় নিজস্ব বাসভবনের সাথে ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন বিলাশ বহুল অত্যাধুনিক একটি বেসরকারি ক্লিনিক। মেডিকেল টেকনিশিয়ান নাসির উদ্দীন সেখানেই মূলত ব্যস্ত সময় পার করেন। একই অভিযোগ অফিস সহকারী-কাম হিসাব রক্ষক রেজওয়ান এর বিরুদ্ধে। তিনিও বছরের পর বছর অফিস না করে হাসপাতালের সকলকে ম্যানেজ করে হাজিরা খাতায় সই-স্বাক্ষরের মাধ্যমে বেতন ভাতা উত্তোলন করে যাচ্ছেন। তবে এ বিষয়ে কেউ কারও যেন মাথা ব্যথা নেই। গত ২৮ জানুয়ারী তালা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সরেজমিনে গিয়ে দেখাগেছে হাসপাতালের একমাত্র এক্স্র-রে ম্যাশিনটি ৬ মাস ধরে নষ্ট হয়ে আছে। এ্যাম্বুলেন্সটি বিকল অবস্থায় পড়ে আছে। সার্জন, এ্যানেসথেসিয়া, গাইনি, চক্ষু, কনসালটেন্ট ও মেডিসিনসহ বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার না থাকায় প্রতিদিনই প্রচুর পরিমাণ রোগী চিকিৎসা সেবা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছে। মাত্র ৪ জন মেডিকেল অফিসার নিয়ে জোড়া তালি দিয়ে ধুকে ধুকে চলছে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স্র এর কার্যক্রম। তবে জরুরী বিভাগে গিয়ে দেখাগেছে কোন মেডিকেল ডাক্তার নেই। হাসপাতালে সাংবাদিক আসার খবরে তড়িঘড়ি করে জরুরি বিভাগে ছুটে আসেন উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার মো: রাইহান ইসলাম ও মেডিকেল অফিসার ডাক্তার আবু সাইদ রিপন। তবে মো: রাইহান ইসলামের পোস্টিংও আবার ইউনিয়ন সাব সেন্টারে। সেখানে উপজেলার তেতুলিয়া গ্রাম থেকে আসা খুকুমনি তার ৪ বছরের পা ভেঙ্গে যাওয়া নাতনিকে ডাক্তার দেখাবেন বলে এসেছেন। এসময় বাইরে থেকে আসা আরও কয়েক জন পা ভাঙা রোগী উপস্থিত হতেই হাসপাতালের এক্্র-রে ম্যাশিন নষ্ট থাকায় তাদেরকে এক্্র-রে করার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় বেসরকারী ক্লিনিক তালা সার্জিকাল ক্লিনিকে। পরে সেখান থেকে তারা ২৬০ টাকা দিয়ে এক্্র-রে করে হাসপাতালে ঔষধের জন্য উপস্থিত হয়েছেন। কিন্তু হাসপাতালে কোন ঔষধ নেই বলে তাদের সাব জানয়ে দেওয়া হয়। দ্বিতীয় তলায় পুরুষ ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। অধিকাংশ বেড নোংড়া অপরিস্কার অবস্থায় খালি পড়ে আছে। হাসপাতালে কোন বিষেশজ্ঞ ডাক্তার না থাকায় চিকিৎসা বঞ্চিত হয়ে রোগী ফিরে যাওয়ার কারনে তাই রোগীর সংখ্যাও কম বলে জানালেন কয়েক জন নার্স। তবে হাসপাতালের বেডে ভর্তি চিকিৎসাধীন রোগী দক্ষিণ নলতার আব্দুল কুদ্দুস জানান, বমি, গ্যাসসহ শারিরিক নানা সমস্যার কারণে দুই দিন আগে ভর্তি হয়েছেন। কিন্তু ঠিকমত চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন না। হাসপাতাল থেকে গ্যাসের ট্যাবলেট ছাড়া বাকি ঔষুধ সব বাইরে থেকে চড়া দামে কিনে আনতে হচ্ছে। খাদ্য খাবার চিড়ি, চিনি, কলাসহ যা দেওয়া হয় তাও অত্যন্ত নিন্ম মানের। একই অভিযোগ করলেন পাশ্ববর্তী বেডে চিকিৎসাধীন পাইকগাছার জামাল। তাকেও বাইরে থেকে ঔষক কিনে আনতে হয়। ১৯৬৫ সালে ৩১ শয্যার মধ্য দিয়ে তালা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্্েরর যাত্রা শুরু হয়। সাবেক স্বাস্থ্য মন্ত্রী ডা. আ ফ ম রুহুল হক এমপির বদান্যতায় ২০০৯ সালে হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও লোকবল নিয়োগ না হওয়ায় হাসপাতালটি চলছে এখন ধুকে ধুধে। হেলথ ইন্সেপেক্টর মীর মহাসিন, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ কুদরত-ই-খূদা সহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার কারনে হাসপাতালটি এখন পরিনত হয়েছে অনিয়ম ও দুর্নীতির আখড়ায়। মেডিকেল টেকনিশিয়ান (ডেন্টিস) মোঃ নাসির উদ্দীন দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে অফিস না করেও বেতন ভাতা উত্তোলন করে আসছেন। একই অভিযোগ অফিস সহকারী-কাম হিসাবরক্ষক রেজওয়ান এর বিরুদ্ধে। তিনিও বছরের পর বছর অফিস না করে হাসপাতালের সকলকে ম্যানেজ করে হাজিরা খাতায় সই-স্বাক্ষরের মাধ্যমে বেতন ভাতা উত্তোলন করে যাচ্ছেন। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রতিবাদে এবং দীর্ঘ ৮/১০ বছর ধরে স্টাফ কোয়াটারে বসবাসরত নার্স ও ডাক্তারদের ভাড়ার টাকা সরকারী কোষাগারে জমা না দিয়ে আত্মসাত ও হাপাতালের চুরি করে সরকারী ঔষধ বিভিন্ন ক্লিনিকে বিক্রি বন্ধসহ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নিয়োগের দাবীতে গত ১৫ জানুয়ারী হাপতালালের সামনেই মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে এলাকাবাসী। তালা প্রেসক্লাবের ব্যানারে উক্ত কর্মসূচী পালিত হয়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত মেডিকেল টেকনিশিয়ান (ডেন্টিস) মোঃ নাসির উদ্দীন ও অফিস সহকারী-কাম হিসাবরক্ষক রেজওয়ান এর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহন করেনি স্বাস্থ্য বিভাগ। এ ব্যাপারে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ কুদরত-ই-খূদা জানান, আমি ১ বছর হচেছ তালা হাসপাতালে যোগদান করেছি। দীর্ঘ দিন যাবত অফিস না করে মেডিকেল টেকনিশিয়ান (ডেন্টিস) নাসির উদ্দীন ও অফিস সহকারী-কাম হিসাবরক্ষক রেজওয়ানের বেতন ভাতা উত্তলনের বিষয়ে কেন কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেয়নি তা আমার জনানেই। অফিস না করে বেতন ভাতা উত্তলোন ও স্টাফ কয়াটারের ভাড়ার টাকা যারা আত্মসাৎ করেছে তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সিভিল সার্জনকে জানিয়েছি। এসব অনয়ম ও দুর্নীতির সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন ডা: তহিদুর রহমান জানান, আমি ঢাকাতে ট্রেনিং এ আছি, তালা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্্েরর কর্মরত কর্মকর্তাদের বেশ কিছু অনিয়ম ও দুর্নীতি এবং স্টাফ কয়াটারের ভাড়ার টাকা রাজস্ব ক্ষাতে জমা না দিয়ে প্রদান অফিস সহকারী কর্তৃক টাকা আত্মসাতের বিষয়টি শুনেছি। সাতক্ষীরায় ফিরে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।