সুভাষ চৌধুরী: স্বাক্ষর একটি নাম, একটি স্বাক্ষর। একটি প্রতিশ্রুতি, একটি সংগ্রাম, একটি উদীয়মান সূর্য, একটি নক্ষত্র। একটি আদর্শ, একটি পথ। একটি অবিরাম চলমান ফটোগ্রাফী, একটি জীবন, একটি প্রকৃতিকে বেঁধে রাখা। মুক্তিযুদ্ধের ফ্রেমে আঁকা, ভাষা সংগ্রামের তুলিতে বুলানো একটি প্রলম্বিত প্রত্যাশা, একটি স্বাক্ষর। শনিবার বিকালে সাতক্ষীরা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনের উপচে পড়া ভিড়ে রুদ্ধদ্বারে মুক্ত প্রাণের মতো গম্ভীর কন্ঠে ভেসে আসছিল স্বাক্ষর, তার জীবন, তার আদর্শের এসব শব্দগুলি। পিনপতন নীরবতার মধ্যে শতজনের মতো আমিও নীরবে সিক্ত হয়েছি আপন অশ্রুতে। হয়তো তখন ভুলেই গিয়েছিলাম কে আমি, কোথায় আমি। কবিতার ভাষায় চয়িত শব্দে কেঁপে কেঁপে উঠছিল মঞ্চ। কানফাঁটা আওয়াজ আঘাত করছিল হৃদয়ের গভীরে। শুধু শুনেছি, আর দেখেছি, আর শিখেছি । ছবির কলা কৌশলে বার বার স্বাক্ষর রেখে গেছে নিজের স্বাক্ষর। এ যেনো তারই উচ্চারন, এ যেনো তারই প্রতিশ্রুতি, একাত্তরের ঘাতকদের বিচার চাই। একটি সাধারন পরিবার থেকে উঠে আসা, বিজ্ঞান মনস্ক,রাজনীতি মনস্ক, সংগ্রামী চেতনা ও প্রতিবাদে ভাস্বর। কখনও মিছিলে, কখনও স্লোগানে, কখনও চিত্রায়নে। রাজনৈতিক পরিবারে বেড়ে ওঠা শিশুটির ভেতর বাহিরও ছিল রাজনীতি মোড়ানো। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভাস্বর, অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক, প্রতিবাদে দৃঢ় কন্ঠস্বর, এক স্পর্ধিত তরুনের নাম অনীক আজিজ স্বাক্ষর। তার হৃদয়ের ভেতর ছিল এক প্রস্ফুটিত পদ্ম। তার বাহির ছিল আরেক প্রস্ফুটিত গোলাপ। তার অকাল প্রয়াণ হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। তার অসময়ের চলে যাওয়া মানুষকে শুন্যতায় ঠেলে দিয়েছে। তার অপ্রত্যাশিত প্রস্থান মাতৃত্বের ফল্গুধারাকে আহত করেছে। যে জীবন সে দেখতে চেয়েছিল, যার ছবি সে বারবার আঁকতো, যে জীবনকে সে আদর্শ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে বারবার সংগ্রাম করেছে, মিছিল করেছে সেই জীবনের প্রতি কেনো এতো তুচ্ছ জ্ঞান সে প্রশ্নের জবাব নেই। সৃজনশীলতা ছিল যার জীবনের গতি তা কেনো মৃত্যুর যুক্ত অক্ষরে বাঁধা পড়লো। এ প্রশ্নেরও জবাব মেলেনি।
অনীকের নাগরিক স্মরণ সভায় কন্ঠশিল্পী আবু আফফান রোজ বাবুর কন্ঠে উচ্চারিত হলো তোমার সমাধি ফুলে ফুলে ঢাকা। স্তব্ধ স্থির একাডেমি মিলনায়তন যেনো আরেক বার ডুকরে কেঁদে উঠলো। শিল্পী মঞ্জুরুল হক গাইলেন যাবার আগে কিছু বলে গেলে না। কবিতার ভাষায় মিনা মিজানুর রহমান বললেন আকাশের অগনিত নক্ষত্রের মেলা থেকে খসে পড়লো একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র, সে তো অনীক আজিজ স্বাক্ষর। কেউ গাইলেন তুমি রবে নীরবে। কবি তৃপ্তি মোহন মল্লিক বললেন পৃথিবীর ধ্রুব সত্য বানী চিরন্তনী, সাম্যবাদ মৃত্যুতে প্রকট। তুমি ছিলে তুমি আছো। সংস্কৃতিকর্মী মুশফিকুর রহমান মিল্টন কবিতার শব্দে বললেন অনীক আজিজ স্বাক্ষর এমন যার নাম। ক্ষনিকের ছোঁয়া পেয়ে মোরা হারিয়ে ফেললাম। আবৃত্তি ও কন্ঠশিল্পী শামীমা পরভিন রতœার কম্পিত কন্ঠে উচ্চারিত হলো মা নাসরিন খান লিপির লেখা কবিতা ‘কেনো চলে গেলে কিছু বলে গেলে না, কোনো চলে গেলে সূত্রটি বলে গেলে না’। কবি দিলরুবা রুবির ‘সেই ছেলেটা’ কবিতায় ‘সেই ছেলেটা যাকে দেখলে মনে হয় মুঠি ভরা মেঘ ভাঙ্গা সোনা রোদ’। কবি শহীদুর রহমান ‘ঝরে যাওয়া এক উজ্জ্বল জ্যোতিস্ক’ কবিতায় বললেন ‘এভাবেই চলে যাবে তুমি এমন তো কথা ছিল না’।
ফুলে ফুলে ভরে উঠা অনীক আজিজের প্রতিকৃতি ঘিরে শিল্পকলা একাডেমির প্রবেশ পথ যেনো প্রস্ফুটিত বাগানে পরিনত হয়েছিল। অগনিত মানুষের পদচারনায় যেনো জীবন্ত হয়ে উঠেছিল প্রবেশ দ্বার। ২১ জানুয়ারি আত্মহননের অবিশ্বাস্য ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে ওঠা মানুষ কেবলই নীরবে অশ্রু মুছেছেন। হৃদয়ের গভীরে ক্ষত নিয়ে বারবার কেঁেদছেন। বাবা মুস্তফা লুৎফুল্লাহ বলেন ‘আমার আক্ষেপ আমার ছেলে মিছিলে আন্দোলনে সংগ্রামে মারা যায়নি কেনো। কেনো সে লড়াইয়ের ময়দানে একজন সৈনিক হিসাবে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেনি। মা নাসরিন খান লিপি বলেন আমার ছেলের কোনো চাহিদা ছিল না। ছিল আমার প্রতি পাগলের মতো অফুরান ভালবাসা। বোন অদিতি আদৃতা সৃষ্টি কান্না জড়িত কন্ঠে জানালো আমাদের জীবন ছিল রাখী বন্ধনের মতো। আমাদের জীবন ছিল বন্ধুর মতো। স্মরণ সভায় শামীম পারভেজের ‘অনীক মানে যোদ্ধা’ ডকুমেন্টারিতে ফুটে উঠেছে অনীকের জীবন, তার সংগ্রাম, তার চলার পথ, তার আদর্শ, তার প্রকৃতি ও জীবনবোধ ও মানবপ্রেম। মাসুদুল হকের ছবিতে প্রস্ফুটিত হয়েছে প্রকৃতির প্রতি অনীকের ভালবাসার অন্তরঙ্গ চিত্র। নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করতে এসে দৈনিক সত্যপাঠ সম্পাদক হারুনার রশীদ বলেন অনীক নিজেই প্রগতির সকল কাজে স্বাক্ষর করে গেছে। অনীক নিজেই একটি শিক্ষা, নিজেই একজন শিক্ষক। সাংবাদিক হাফিজুর রহমান মাসুম বলেন অনীক ছিল গনজগরণ মঞ্চের সম্মুখ সারির সংগঠক ও সার্বক্ষণিক কর্মী। অনীকের নিরহংকার চরিত্র আমাদের তরুণদের জন্য আদর্শ হতে পারে। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধকালীন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো.মোসলেমউদ্দিন বলেন অনীকের আদর্শের পথ প্রলম্বিত। অনীক একজন নিবেদিত সৈনিক। তার স্মরণে তৈরি হবে অনীক ট্রাস্ট। অনুভূতি ব্যক্ত করতে এসে কলারোয়া উপজেলা চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমেদ স্বপন বলেন মানুষ মানুষের জন্য,জীবন জীবনের জন্য। তুমি রবে নীরবে। ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য ইকবাল কবির জাহিদ বলেন ‘আমরা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অভিন্ন অঙ্গিকারে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম। অনীকের আদর্শ আমাদের আদর্শ, অনীকের গনজাগরন মঞ্চ আমাদের মঞ্চ, অনীকের সব অঙ্গিকার আমাদের অঙ্গিকার, তা থেকে আমরা যেনো কেউ সরে না যাই। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারন সম্পাদক কমরেড ফজলে হোসেন বাদশা এমপি বলেন অনীক ছিল আমার নিকট প্রতিবেশি। ঢাকার মিছিলে সংগ্রামে তার পায়ে স্যান্ডেল নেই, হাতে ছিল ক্যামেরা। তাকে দেখে সাহস জাগে, কারণ অনীকরাই তো সমাজ পরিবর্তনের শক্তির সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। তিনি বলেন ‘তোমার স্বপ্ন গুলো পূরন হবে। দেশে বিপ্লব হবে। লাল পতাকার জয় হবে’। হৃদয়স্পর্শী স্মরণ সভায় ওয়াকার্স পার্টি নেতা মহিবুল্লাহ মোড়ল ও এড. ফাহিমুল হক কিসলুর শোক কম্পিত ও ভারাক্রান্ত কন্ঠে বারবার উঠে এসেছে অনীকের জীবন সংগ্রামের কথা, তার মানবপ্রেম ও আদর্শের কথা। বাবা মুস্তফা লুৎফুল্লাহর সাম্যবাদী আদর্শের রাজনীতি মোড়ানো পরিবারের বৃন্ত থেকে ছিটকে পড়া অনীক। নিরহংকার, নির্লোভ, সত্যনিষ্ঠ, কর্মঠ, আবেগী তরুন অনীক ছিল এক সরল সহজ হাসিমাখা হৃদয়ের অধিকারী। অধিকার আদায়ের আন্দোলন সংগ্রামে যার নিত্য পদচারনা, অন্যায় আর অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে যার নিরন্তর লড়াই, তারই নাম অনীক আজিজ স্বাক্ষর। ছাত্র, সংগঠক, ফটোগ্রাফার, মিষ্ট ও মৃদূু ভাষী, মুক্তমনা, টগবগে দুরন্ত তারুণ্যের দীপ্ত স্বাক্ষর অনীক আজিজ স্বাক্ষরের অকাল প্রয়াণ তাই বারবার রেখে যায় অবিনাশী স্বাক্ষর।