লন্ডনে চিকিৎসাধীন তারেক রহমান বাংলাদেশের আইনের চোখে একজন পলাতক আসামি। আর এ অবস্থার মধ্যেই তিনি বিএনপির ‘ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান’-এর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। দলের গঠনতন্ত্রের ৮ ধারার ‘গ’ উপধারা অনুযায়ী, চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে দায়িত্ব নেবেন ‘সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান’। তবে গত বছর খালেদা জিয়ার লন্ডন সফরে থাকার সময়ে তিন মাসের অনুপস্থিতি কিংবা এক-এগারো’র সরকারের সময়ে একবছরের বেশি কারাবাসের সময় তারেককে ‘ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান’ করার প্রয়োজন মনে করেনি বিএনপি। আর এবার চেয়ারপারসন গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যাওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তারেককে ‘ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান’ করার কথা জানালেন দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। এতে করে দল ও দলের বাইরে অনেকেই মনে করছেন, তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত করার মধ্যদিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নতুন করে বিতর্ক ও সমালোচনার সুযোগ দেওয়া হলো। যেখানে খালেদা জিয়ার কারাবরণ ‘শাপে বর’ হতে পারে— রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের এমন ভাষ্য সত্ত্বেও নতুন বিতর্কে জড়িয়ে পড়লো বিএনপি। তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলছেন, ‘গঠনতন্ত্র মেনেই তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এটা স্বাভাবিকভাবেই ঘটেছে। এতে করে দলীয় গঠনতান্ত্রিক চর্চা অব্যাহত রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘এক-এগারো’র সময় বিএনপির গঠনতন্ত্রে এই সুযোগ ছিল না। এবং ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) যখন লন্ডনে গিয়েছিলেন, তখন কিন্তু আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। এখন জেলে যাওয়ায় সে সুযোগ কম। চাইলেই দেখা করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে তারেক রহমান দায়িত্ব পালন করবেন।’ বিএনপির কোনও কোনও সিনিয়র নেতা পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেছেন, তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত করার মধ্যদিয়ে পুরনো বিতর্ক নতুন করে উঠে আসবে। ক্ষমতায় থাকতে ‘হাওয়া ভবন’ চর্চা, ‘বিকল্প প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়’ তৈরি করা, দুর্নীতির মামলাসহ বিভিন্ন মামলায় পলাতক আসামি হিসেবে তারেক রহমানের রাজনৈতিক আবেদন এখনও খালেদা জিয়ার চেয়ে বহুগুণ কম। সেই কারণেই খালেদা জিয়ার কারাগারে যাওয়ার মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তারেককে এভাবে ভারপ্রাপ্ত করার মধ্যদিয়ে একদিক দিয়ে কারাবন্দি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অবজ্ঞার প্রকাশ ঘটেছে। যদিও বিএনপির নয়া পল্টন কার্যালয়ের একটি সূত্রের ভাষ্য, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর আগ্রহের কারণে তারেক রহমান দ্রুত ‘ভারপ্রাপ্ত’ পদে বসতে আগ্রহী হয়েছেন। এতে করে বিএনপির মহাসচিব ও স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করতে হবে না তাকে। বিশেষ করে বৃহস্পতিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) খালেদা জিয়ার রায়ের পর পরই স্থায়ী কমিটি ছাড়াই সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিক্রিয়া জানানোর পর থেকে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়েছে। বিশেষ করে খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতেই স্থায়ী কমিটিতে সিদ্ধান্ত ছিল, দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে পরামর্শ করে এবং স্থায়ী কমিটির সঙ্গে সমন্বয় করে মহাসচি দলের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবেন। আর এই সিদ্ধান্ত মানতেই সমস্যা হচ্ছে দলের একটি অংশের। রুহুল কবির রিজভীর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য একাধিকবার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। যদিও শুক্রবার (৯ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে ডাকা সংবাদ সম্মেলনে তার বক্তব্য ছিল, ‘দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও স্থায়ী কমিটির সঙ্গে সমন্বয়ে দল আগামীতে পরিচালিত হবে ।’ রিজভীর এই বক্তব্য মেনে নিলেও বিএনপির একটি অংশ বলছে, তারেক রহমান বিএনপির ভবিষ্যৎ। তার নেতৃত্ব নিয়েও কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু যখন খালেদা জিয়ার গ্রেফতার হলেন, আর সময় গেল মাত্র ২৪ ঘণ্টা, তখনই প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিষয়টি জানিয়ে দেওয়ার মধ্যদিয়ে মূলত বিএনপির সিনিয়র নেতৃবৃন্দকে উপেক্ষা করা হয়েছে। বিশেষ করে দলের এই সময়ে যখন বিএনপির সিনিয়র নেতাদের ঐক্যবদ্ধ থাকার কথা, সেখানে হঠাৎ করে তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার ঘোষণা দেওয়া হলো। বিশেষ করে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ভারপ্রাপ্ত’ করায় দলের মধ্যে এই মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে। যদিও খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ভাষ্য, ‘কোনও দ্বিমত বা দ্বন্দ্ব তৈরি করবে না। আর এতে স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হয় না। এটা কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত। গত কাউন্সিলে তারেক রহমান সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।’ ইতোমধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অভিযোগ করেছে, তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করে বিএনপি প্রমাণ করেছে—‘তারা দুর্নীতির পথ থেকে সরে আসেনি। প্রমাণ হয়েছে বিএনপি সুস্থ রাজনৈতিক চিন্তা করতে পারে না। তারা মনে করে, আইন আদালতের ঊর্ধ্বে তারা।’ বিএনপি’র যুক্তরাজ্য শাখার সাধারণ সম্পাদক কয়সর আহমেদ বলেন, ‘তারেক রহমান ভারপ্রাপ্ত হয়েছেন গঠনতান্ত্রিক নিয়মে। এটা তো দেরি হয়ে গেছে। আরও আগেই করা দরকার ছিল। আর ভারপ্রাপ্ত হওয়ায় দলে কেন প্রশ্ন থাকবে? কোনও সমস্যা থাকবে না।’ আর আওয়ামী লীগ সমালোচনা করছে, তার মানে বিএনপি ঠিক পথেই আছে (রাইট ওয়ে) বলেও মন্তব্য করেন কয়সর আহমেদ। বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি বলেন, ‘বিএনপির একটা গঠনতন্ত্র আছে, সেই অনুযায়ী তারেক রহমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। এর বাইরে দলের অন্য নেতারা সবাই তো আছেন। তারেক রহমানের নেতৃত্বে দল আরও ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী হবে আগামীতে।’ জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব) মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘চেয়ারপারসনের অনুপস্থিতিতে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দল পরিচালিত হবে। সেক্ষেত্রে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে পরামর্শ করে আগামী দিনের করণীয় নির্ধারণ করা হবে।’ তিনি বলেন, ‘তারেক রহমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হওয়ায় আমি কোনও সমস্যা দেখছি না। এনিয়ে দলের মধ্যে কোনও সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে বলেও মনে করি না। কারণ, আমাদের দলের গঠনতন্ত্রে চেয়ারপারসনের অনুপস্থিতিতে ভাইস চেয়ারম্যানই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হবেন—এটা সুস্পষ্টভাবে বলা আছে।’