আগামী ২০ থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে দেশ বহু প্রতীক্ষিত চতুর্থ প্রজন্মের (ফোরজি) মোবাইল ফোন সেবার যুগে ঢুকছে। প্রথমে ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরে এ সেবা শুরু হবে। গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এ সেবার তরঙ্গ নিলামের কাজ শেষ করেছে। লাইসেন্স দেওয়া হবে আগামী ১৯ বা ২০ ফেব্রুয়ারি। বিটিআরসির ২০ ফেব্রুয়ারি লাইসেন্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল। এর আগেই মোবাইল অপারেটররা লাইসেন্স চায়। আজ বুধবার এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বিটিআরসি। মোবাইল অপারেটররা বলছে, লাইসেন্স পাওয়ামাত্র ফোরজি সেবা দেওয়ার জন্য তারা প্রস্তুত। তবে পরীক্ষামূলক সেবা এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
আন্তর্জাতিক মান অনুসারে ফোরজি ইন্টারনেটের গতি ১০ থেকে ১৫ এমবিপিএস (মেগাবাইটস পার সেকেন্ড)। ভারতে গতি ৭ এমবিপিএস। বাংলাদেশে এটি হ্যান্ডসেট ও স্থান বিবেচনায় ৬ থেকে ১০ এমবিপিএস হতে পারে। এ ক্ষেত্রে তা থ্রিজির চেয়ে তিন থেকে পাঁচ গুণ বেশি গতির হবে।
রবি আজিয়াটার নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট শাহেদ আলম এসব তথ্য জানিয়ে আরো বলেন, ফোরজি সেবা পেতে চাইলে গ্রাহককে নতুন করে সিম নিতে হবে। কারণ ফোরজির জন্য প্রয়োজন হবে ‘ইউ-সিমের’। হ্যান্ডসেটও হতে হবে ফোরজি উপযোগী। আর আইফোন ব্যবহারকারীরা এক থেকে দেড় মাস এই সেবা পাবে না। আইফোনের নিজস্ব নিরাপত্তাগত কারণেই সংশ্লিষ্ট গ্রাহকদের কিছুদিন অপেক্ষায় থাকতে হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ফোরজিতে ব্যয় অপরিবর্তিত থাকবে, তবে ব্যবহার বাড়বে। এ সেবার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে তিনি বলেন, বর্তমানে ৮ থেকে ১০ শতাংশ গ্রাহকের কাছে ফোরজি উপযোগী হ্যান্ডসেট রয়েছে। তিন বছর ঝুলে থাকার পর গতকাল ফোরজি মোবাইল ফোন সেবা চালুর জন্য তরঙ্গ নিলাম সম্পন্ন হয়েছে। ঢাকা ক্লাবে দুপুর ১২টায় এ নিলাম অনুষ্ঠিত হয়। দেশের ছয়টি মোবাইল অপারেটরের মধ্যে গ্রামীণফোন আর বাংলালিংকের মধ্যেই এ নিলাম সীমাবদ্ধ থাকে। রবি আজিয়াটা ও সিটিসেল আগে তরঙ্গ নিলামে অংশ নেওয়ার আগ্রহ দেখালেও শেষ পর্যন্ত বিড আর্নেস্টমানি জমা দেয়নি। রবির কাছে পর্যাপ্ত তরঙ্গ রয়েছে। সিটিসেলের বিষয়ে ধারণা করা হচ্ছিল, এ নিলামে অংশগ্রহণের মাধ্যমে কার্যক্রম বন্ধ থাকা এই প্রতিষ্ঠানটিতে নতুন কোনো অংশীদারের দেখা মিলবে; কিন্তু তা হয়নি। নিলামে সরকারের মালিকানাধীন মোবাইল অপারেটর টেলিটকও অংশ নেয়নি। কারণ টেলিটকের কাছেও পর্যাপ্ত তরঙ্গ রয়েছে।
রবির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাহাতাব উদ্দিন গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘গত ডিসেম্বর মাস থেকেই আমরা প্রস্তুত। লাইসেন্স পাওয়ার পরপরই অন্য অপারেটরদের তুলনায় বেশি শহরে এ সেবা চালু করতে পারব। আমাদের কাছে বিভিন্ন ব্যান্ডের যে পরিমাণ কোয়ালিটি তরঙ্গ রয়েছে, তা দিয়ে মানসম্মত ফোরজি সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা এক ধাপ এগিয়ে থাকব।
এদিকে গতকালের নিলামে নতুন করে তরঙ্গ বা স্পেকট্রাম কেনার পর গ্রামীণফোনের সিইও মাইকেল ফোলি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমাদের প্রযুক্তি নিরপেক্ষ স্পেকট্রামের সঙ্গে নতুন এই স্পেকট্রাম যোগ হওয়ায় গ্রামীণফোন দেশের সবচেয়ে আধুনিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সেরা ফোরজি সেবা প্রদানে একটি দৃঢ় অবস্থানে পৌঁছে গেল।’
গ্রমীণফোনের আধুনিক এই নেটওয়ার্ক উপভোগ করার জন্য গ্রাহকদের তাদের থ্রিজি সিম পরিবর্তন করে ফোরজি সিম গ্রহণ করতে অনুরোধ করছে।
বাংলালিংকের একজন কর্মকর্তাও গতকাল তাঁদের একই প্রস্তুতির বিষয়ে জানান। বাংলালিংকের সিইও এরিক অস গতকাল রাতে এক প্রেস বিবৃতিতে বলেন, ‘নতুন স্পেকট্রাম গ্রহণ করতে পেরে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত। নতুনভাবে সংযোজিত স্পেকট্রামের ফলে আমরা গ্রাহকদের নিরবচ্ছিন্ন ডিজিটাল সংযোগসহ আরো উন্নত কাভারেজ দিতে সক্ষম হব, যা গ্রাহকদের আরো ভালো সেবা দিতে সাহায্য করবে।’
বিটিআরসির চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ বলেন, ‘মোবাইল অপারেটরদের যে প্রস্তুতি রয়েছে তাতে আশা করছি লাইসেন্স দেওয়ার পরপরই দেশে ফোরজি সেবা চালু হয়ে যাবে। বিটিআরসি এ বিষয়ে সব ধরনের সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত।’
গতকাল ঢাকা ক্লাবে তরঙ্গের নিলামের আনুষ্ঠানিকতা শেষে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ সাংবাদিকদের জানান, ফোরজি তরঙ্গের নিলাম এবং তরঙ্গের প্রযুক্তি নিরপেক্ষতার সুবিধা বিক্রি করে ভ্যাটসহ পাঁচ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা আয় করছে সরকার। বাংলালিংক ও গ্রামীণফোন মোট তিন হাজার ৮৪৪ কোটি টাকায় তরঙ্গ বরাদ্দ নিয়েছে। এ ছাড়া আগের বরাদ্দ তরঙ্গে প্রযুক্তি নিরপেক্ষতা দিয়ে (যাতে ওই তরঙ্গ যেকোনো প্রযুক্তিতে ব্যবহার করা যায়) গ্রামীণফোন, বাংলালিংক ও রবির কাছ থেকে সরকার পেয়েছে এক হাজার ৪৪৫ দশমিক ৮ কোটি টাকা।
বিটিআরসি পৃথক তিনটি ব্যান্ডের তরঙ্গ নিলামের আয়োজন করলেও গ্রামীণফোন আর বাংলালিংকের আগ্রহ ছিল শুধু দুটি ব্যান্ডে। যে তিনটি ব্যান্ডের তরঙ্গ নিলামের আয়োজন করা হয় সেগুলো হলো ৯০০ মেগাহার্টজ, ১৮০০ মেগাহার্টজ ও ২১০০ মেগাহার্টজ। নিলামের নীতিমালা অনুযায়ী, ৯০০ ও ১৮০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডের তরঙ্গ নিলামের ক্ষেত্রে প্রতি মেগাহার্টজের ভিত্তিমূল্য তিন কোটি মার্কিন ডলার। আর ২১০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডের তরঙ্গের ভিত্তিমূল্য মেগাহার্টজপ্রতি দুই কোটি ৭০ লাখ ডলার। নিলামে প্রতিটি ব্যান্ডের অংশ নেওয়ার বিড আর্নেস্ট মানি ১৫০ কোটি টাকা করে। গ্রামীণফোনের আগ্রহ ১৮০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডের তরঙ্গে। বাংলালিংক ১৮০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডের সঙ্গে ২১০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডও নিতে পারে। এই দুই ব্যান্ডের তরঙ্গ টুজি ও থ্রিজির সঙ্গে ফোরজিতেও ব্যবহার করা যাবে।
গতকাল গ্রামীণফোন শুধু ১৮০০ মেগাহার্টজ এবং বাংলালিংক ২১০০ মেগাহার্টজ ও ১৮০০ মেগাহার্টজ তরঙ্গ নিলামে অংশ নেয়।
বাংলালিংক এক হাজার ১১৯ কোটি টাকায় ২১০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ড এবং এক হাজার ৪৩৯ কোটি টাকায় ১৮০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডের মোট ১০.৬ মেগাহার্টজ তরঙ্গ কিনে নেয়। আর গ্রামীণফোন এক হাজার ২৮৪ কোটি টাকায় কিনে নেয় ১৮০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডের ৫ মেগাহার্টজ তরঙ্গ।
টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের উপস্থিতে তরঙ্গ নিলম অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন বিটিআরসি স্পেকট্রাম বিভাগের মহাপরিচালক নাসিম পারভেজ।
বাংলালিংকের সিইও এরিক অস ও গ্রামীণফোনের সিইও মাইকেল ফলি লটারির মাধ্যমে তাঁদের জন্য নির্ধারিত দুটি আলাদা টেবিলে বসে এ নিলামে অংশ নেন।
বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কম্পানি লিমিডেটের (বিএসসিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মসিউর রহমান গতকাল বলেন, ‘ফোরজি সেবাকে বিবেচনায় রেখে আমরা সক্ষমতা বাড়ানোর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছি। দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবল সি-মি-উই-৫ থেকে আমরা এখন ২০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইডথ পাচ্ছি। এর সক্ষমতা বাড়িয়ে ৪০০ জিবিপিএস করা হচ্ছে। আগামী বছর পাওয়া যাবে ৮০০ জিবিপিএস। আর প্রথম সাবমেরিন কেবল সি-মি-উই-৪ থেকে পাচ্ছি ৩০০ জিবিপিএস। দেশে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথের চাহিদা বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৫০০ জিবিপিএস। কিন্তু বিএসসিসিএল থেকে ব্যবহার হচ্ছে ২৩০ জিবিপিএস। বাকিটা আসছে ভারতের আইটিসি অপারেটরদের মাধ্যমে।’