নিজস্ব প্রতিবেদক: সাতক্ষীরায় যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদ করায় সরকারি শিশু পরিবার থেকে মিথ্যা অভিযোগ এনে ৪ শিশুকে বহিষ্কার করার অভিযোগ উঠেছে। এছাড়াও সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটিতে এতিম বাচ্চাদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হচ্ছে বলেও জানিয়েছে ওই ৪ বালক। আজ বুধবার সকালে সাতক্ষীরা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে তারা এসব অভিযোগ সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরে। এঘটনায় নাগরিক আন্দোলন মঞ্চ, সাতক্ষীরার পক্ষ থেকে আগামিকাল সকাল ১১টায় সাতক্ষীরা নিউ মার্কেটস্থ শহিদ স ম আলাউদ্দীন চত্বরে এক মানববন্ধনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে।
পাঠকের সুবিধার্থে সংবাদ সম্মেলনে পঠিত এসব এতিম শিশুদের লিখিত বক্তব্য নি¤েœ হুবহু উপস্থান করা হলোÑ “আমাদের শুভেচ্ছা নিন। আমাদের আহবানে আপনাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করে আজকের এ সংবাদ সম্মেলনে হাজির হবার জন্য কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সাতক্ষীরা শিশু পরিবার(বালক)-এ বছরের পর বছর ধরে চলা নির্মম নির্যাতনের প্রতিবাদকারী ৪ জন শিক্ষার্থীকে বহিস্কারের প্রতিবাদে আজকের এই সংবাদ সম্মেলন। সাংবাদিক ভাইয়েরা : আমরা নিম্নস্বাক্ষরকারী সাতক্ষীরা সরকারি শিশু পরিবার(বালক) এর শিক্ষার্থীবৃন্দ হইতেছি। আপনারা সকলেই অবগত আছেন গত ২০১৭ সালের জুলাই মাসের ৩০ তারিখে ঠিকমত খাদ্য, চিকিৎসা, পোশাক ও শিক্ষা উপকরণ না দেওয়া এবং ভয়ংকর যৌন নিপীড়নসহ বিভিন্ন অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে শিশু পরিবারের সকল শিশু মিলে ৪ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে একযোগে প্রতিবাদ করি। বিষয়টি আপনাদের লেখনীর মাধ্যমে সাধারণ মানুষের গোচরে আসে এবং কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয় একটি তদন্ত কমিটি করতে। পুরাতন সাতক্ষীরা এলাকায় ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত সরকারি শিশু পরিবারে (এতিম খানা, বালক) ১০০ জন শিশুর আবাসন ব্যস্থা থাকলেও নির্যাতন বহিস্কারের কারণে এখন নিয়মিত বাস করে ৫০ জনেরও কম এতিম শিশু। আমাদের দেখভাল করার জন্য শিক্ষক কর্মচারীসহ ১৭টি পদের মধ্যে রয়েছেন ৯ জন। যৌন নির্যাতন, মারপিট, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা না রাখা, বিনোদন, আতœীয়ের দেখা সাক্ষাৎ করতে না দেওয়া, ঠিকমত খাদ্য ও চিকিৎসা না দেওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাদের উপর নির্যাতন করা হয়। এসব বিষয় নিয়ে অভিযোগ করাই ইতোমধ্যে করিম, মুরশিদ, এখলাছুর ও সবুজের মেয়াদ থাকার পরও নির্যাতন করে বের করে দেয় এবং এ বিষয়ে কাউকে কিছু না বলার জন্য শাসানো হয়। এছাড়া আমাদের ওপর নেমে আসে আরও বেশি নির্যাতন। এঘটনায় তৎকালীন সদর সহকারী কমিশনার(ভূমি) ও ভারপ্রাপ্ত ইউএনও দেবাশিষ চৌধুরী সকলকে শান্ত থাকতে বলেন এবং পরবর্তীতে বিষয়টি শুনে বুঝে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস প্রদান করেন। পরবর্তীতে একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের পরও অপরাধের বিপরীতে দোষীদের বিরুদ্ধে কোন আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। আামাদের উপর নির্যাতনকারী তৎকালীন ওই কর্মকর্তারা হলেন, অফিস সহকারী সাতক্ষীরার দেবনগর এলাকার খলিলুর রহমানের ছেলে তানভীর হোসেন, গোপালগঞ্জ জেলার বিমল বৈরাগী, বড় ভাই (পদের নাম) নওগা জেলার মোজাফফার হোসেনের ছেলে আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বিন হোসেন ও কৌশিক। আপনারা জানলে অবাক হবেন, সরকারি শিশু পরিবারে শিক্ষার্থী পিছু সরকারি বরাদ্দ খাওয়া ও অন্যান্য উপকরণসহ মাসিক দুই হাজার ছয়শত টাকার উপরে। কিন্তু সরকার কর্তৃক দেওয়া সুযোগ সুবিধা থেকে এতিম শিশুদেরকে বছরের পর বছর ধরে বঞ্চিত করা হচ্ছে। আমরা অসুস্থ হলেও ঠিকমত চিকিৎসা করানো হয় না। সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো ওই কর্মকর্তারা আমাদের (এতিম শিশুদের) দিয়ে বিকৃত যৌনাচার করতেন। কথা না শুনলে ছোট ছোট বাচ্চাদের বেদম মারপিট করেন তারা। আমাদের টিভি রুম দখল করে সপরিবারে সেখানে বসবাস করতেন কর্মচারীরা। অথচ তাদের পরিবার নিয়ে থাকার কোন সুযোগ নেই। এবিষয়ে কারো কাছে নালিশ করলে আমাদের জন্য আরও কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়। তারপরও আমরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বার বার বিচার দিলেও কোন ফল পায়নি। আপনারা সাংবাদিকরা সকলেই সে সময় এসব অভিযোগের সত্যতা সরেজমিনে দেখছেন ও জেনেছেন। এদিকে, কোন উপায় না পেয়ে সিনিয়র শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে আমরা সংঘবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ করতে বাধ্য হই। এঘটনায় বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ও প্রিন্ট মিডিয়ায় সংবাদ পরিবেশন হলে অপরাধীদের বাঁচাতে অন্যত্র বদলি করা হয় এবং সভাপতি ও জেলা প্রশাসক সরেজমিনে আসলে আমাদের সাথে কোন কথা না বলে শুধু কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে চলে যাচ্ছিলেন। আমরা কিছু বলতে চাইলে তিনি বরং আমাদেরকে ভর্ৎসনা করে বলেন, সাংবাদিকদের কাছে কেন আমরা অনিয়মের ব্যাপারে কথা বলেছি। সাময়িকভাবে সপ্তাহ খানেক সমাজের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ ও সাংবাদিকদের যাতায়াতের কারণে সরকারি শিশু পরিবারে খাবারের মান বাড়ে এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীরা শোভন আচরণ করতে শুরু করেন। কিন্তু কিছুদিন পরই পূর্বের মত আমাদের উপর নির্যাতন চলতে থাকে। যাদেরকে সরকার বেতন দিচ্ছেন আমাদের সেবা করার জন্য শিশু পরিবারের সেই কর্মচারীরা আমাদেরকে দিয়ে ব্যক্তিগত ফাই ফরমায়েশ খটিয়ে নেন। আমাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা শুধু কাগজে-কলমে আর হিসাবের খাতায়। বাস্তবতা হচ্ছে অসুখ-বিসুখ হলে মানসম্পন্ন কোন চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে আমাদেরকে অনেক সময় দরিদ্র মায়ের কাছে বা পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। খাবারের যে তালিকা করা আছে তা মানা হয় না। শিক্ষা উপকরণ খুবই অপ্রতুল। অথচ এসব কিছুর জন্য সরকারি বরাদ্দ আছে যা প্রতিমাসে লুটপাট হচ্ছে। এক পর্যায়ে আবারো আগের মত নির্যাতন নিপীড়ন চালাতে থাকলে আমাদের কেউ কেউ প্রতিবাদ করার সাথে সাথেই উপ-তত্ত্বাবোধায়ক জামাল উদ্দিন পুলিশ ডেকে এনে আমাদেরকে গ্রেফতার করানোর ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রাখেন। সাংবাদিক বন্ধুগণ, বর্তমান সরকার অত্যন্ত শিশুবান্ধব। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শিশুদের মায়ের মত ভালোবাসেন। অথচ সাতক্ষীরা সরকারি শিশু পরিবারের শিশুদের উপর নির্মম নির্যাতনের প্রতিবাদ করায় আমাদেরকে বহিস্কার করা হয়েছে। গত রোববার সন্ধ্যায় সাতক্ষীরা শিশু পরিবারের উপ-তত্ত্বাবোধায়ক জামাল উদ্দিন স্বাক্ষরিত বহিস্কারাদেশ পত্র আমাদের বাড়িতে পাঠানো হয়। এরপরও শিশু পরিবারের শিশুদেরকে দিয়ে কর্মচারীরা মটরবাইক পরিস্কার, কাপড় চোপড় পরিস্কার করানোসহ ভারী কাজ কর্ম করাচ্ছেন কিন্তু তাদের কোন শাস্তি হচ্ছে না। উক্ত নির্যাতন ও যৌন নিপীড়নের ঘটনার ৮ মাস অতিবাহিত হওয়ার পর ওই দোষী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোন আইনি ব্যবস্থা না নিয়ে আমাদেরকে শাসানো হচেছ, তোমরা এঘটনায় বাইরে প্রকাশ করলে তোমাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে এরপরপরই আমাদের বহিষ্কারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কি কারণে আমাদেরকে বহিস্কার করা হলো সে ব্যাপারে সমাজসেবা কর্মকর্তাসহ গভনিং বর্ডির কেউ আমাদের সাথে কথা বলেননি। এরপরপরই বর্তমানে যে সকল শিশুরা আছে তাদের উপরে ব্যাপকভাবে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। আমাদের বহিস্কারের ব্যাপারে বাহিরের কারো কাছে কোন প্রকার তথ্য প্রকাশ না করতে বিভিন্ন ভয়ভীতি দেখানো হয়। আমরা উক্ত ঘটনায় দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও আইনগত ব্যবস্থাসহ আমাদের বিরুদ্ধে অবৈধ বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহার, আমরা যাতে নির্বিঘেœ থাকতে পারি তার ব্যবস্থা গ্রহণ করার জোর দাবি জানিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় সমাজকল্যাণমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছি। সর্বপরি আশা করি সাংবাদিক ভাইয়েরা আপনাদের বস্তুনিষ্ঠ লেখনির মাধ্যমে স্ব স্ব গণমাধ্যমে উক্ত সংবাদটি প্রকাশ করে যাহাতে আইনগত ও আদালতের সহযোগিতা পেতে পারি তার বিহীত ব্যবস্থা করবেন। একই সাথে আমাদের ছোট ভাইয়েরা যারা এই শিশু পরিবারে আছে তারা আপনাদের সন্তান তুল্য। যে অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার তারা হচ্ছে এবং যে অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে আপনাদের সন্তানদের বেড়ে উঠতে হচ্ছে, আপনাদের শক্তিশালী লেখনীই পারে তার পরিবশে উন্নত করতে। পরিশেষে আপনাদের সু-স্বাস্থ্য ও চিরকল্যাণ কামনা করছি।” সংবাদ সম্মেলনে উপস্থি ৪ শিশু হলো- আব্দুল করিম, পিতা- মৃত নুর আলী সরদার, সাং- ধুলিহর, থানা ও জেলা-সাতক্ষীরা, এখলাছুর রহমান পিং- মৃত. শওকত আলী সাং- যুগিপোতা, থানা ও জেলা সাতক্ষীরা, মুরশিদ গাজী পিং- মৃত. নেছার আলী গাজী সাং গোবিন্দপুর(কাদাকাটি), থানা-আশাশুনি, জেলা-সাতক্ষীরা এবং শেখ সবুজ হোসেন পিং- মৃত. আলী আহমেদ, সাং- বড় কাশিপুর (পাটকেলঘাটা), থানা- পাটকেল ঘাটা, জেলা-সাতক্ষীরা। এদিকে, আজকের সংবাদ সম্মেলনে এতিম শিশুদের সাথে একত্মাতা ঘোষণা করে নাগরিক আন্দোলন মঞ্চ, সাতক্ষীরার নেতৃবৃন্দের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, সংগঠনের আহবায়ক এড. ফাহিমুল হক কিসলু, সদস্য সচিব আলীনুর খান বাবুল, প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি আবুল কালাম আজাদ, জে এস ডি’র সাধারণ সম্পাদক সুধাংশু শেখর সরকার, সাংবাদিক কল্যাণ ব্যানার্জী, সাংবাদি এম. কামরুজ্জামান, ইঞ্জিনিয়ার আবিদুর রহমান, আ . লীগ নেদতা হাসান হাদী, আমির হোসেন খান চৌধুরী প্রমুখ। নাগরিক আন্দোলন মঞ্চ, সাতক্ষীরা এতিম খানার দুর্নীতি অনিয়ম নির্যাতন ও যৌন নিপীড়নের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা এবং ৪জনকে বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে আগামিকাল বৃহস্পতিবার সাতক্ষীরা নিউমার্কেটস্থ শহীদ স ম আলাউদ্দিন চত্বরে মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়েছে। উক্ত মানববন্ধনে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে উপস্থিত থাকার জন্য নাগরিক আন্দোলন মঞ্চের পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হয়।