অনলাইন ডেস্ক: সাজা পেয়ে প্রথমবারের মতো কারাগারে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। মোটা দাগে এরই মধ্যে চার চ্যালেঞ্জে পড়েছে দলটি। প্রথমত. বেগম জিয়াকে মুক্ত করাই এ মুহূর্তে বিএনপির প্রধান চ্যালেঞ্জ। দ্বিতীয়ত. দলের নেতারা মনে করেন বেগম জিয়ার কারাবাস দীর্ঘায়িত হলে দলের ঐক্যও ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। নিজেদের মধ্যে বাড়তে পারে সন্দেহ-অবিশ্বাস। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে নেতাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে পারে সরকার। তাই বিএনপি-প্রধান কারাগারে যাওয়ার পর আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি রাজপথের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিও চলবে। তৃতীয়ত. আন্দোলন আর আইনি লড়াইয়ের মধ্যে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়াতেও দৌড়ঝাঁপ বিএনপির। এরই মধ্যে বেড়েছে কূটনৈতিক তৎপরতাও। তবে তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কতটুকু আস্থায় আনতে পেরেছে তা স্পষ্ট নয়। চতুর্থত. বেগম জিয়ার কারাগারে যাওয়ার পর থেকেই বিএনপির নির্বাচন প্রস্তুতিতে ভাটা পড়েছে। যদিও তারা বলছে, তারা সবসময়ই নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। বলছে, সবার অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েই বিএনপির বিজয় হবে। এদিকে দণ্ডপ্রাপ্ত দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। জিয়া পরিবারের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ অনেকটা অনিশ্চিত বলে মনে করেন কেউ কেউ। পাশাপাশি বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাও বিভিন্ন মামলায় আসামি। জিয়া পরিবার ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে না বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছে। এ অবস্থায় মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীরাও এখন বেগম জিয়ার মুক্তি আন্দোলনে ব্যস্ত। ফলে নির্বাচন প্রস্তুতিতে পিছিয়ে বিএনপি। জানা যায়, দেশি-বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি নেতারা বোঝানোর চেষ্টা করছেন, বেগম জিয়াকে অন্যায়ভাবে সরকার কারাগারে নিয়েছে। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাচনে অযোগ্য করাই সরকারের টার্গেট। তবে তারা কূটনীতিকদের কতটুকু আস্থায় নিয়ে আসতে পেরেছেন তা স্পষ্ট নয়। দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা বলছেন, তারা বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন। কূটনীতিকরাও সরকারকে নানাভাবে চাপ দিচ্ছেন বলে জানান বিএনপির কূটনীতিসংশ্লিষ্ট নেতারা। বিএনপি সমর্থিত এক বুদ্ধিজীবী বলেন, বেগম জিয়ার কারামুক্তি দীর্ঘায়িত হলে বিএনপির চিত্র পাল্টে যেতে পারে। দলে ভাঙন সৃষ্টির পাশাপাশি বিভেদও বাড়তে পারে। তাই কারান্তরিন হওয়ার আগে বেগম জিয়া দলীয় ঐক্য ধরে রাখার নির্দেশ দিয়ে গেছেন। লন্ডন থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানও একই বার্তা দিয়েছেন। তিনি নিয়মিত সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে কথা বলছেন। দলের ঐক্য ধরে রাখার পাশাপাশি কর্মসূচি নিয়েও কথা বলছেন। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এখন জেলে। সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানও সাজাপ্রাপ্ত হয়ে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। তার সহধর্মিণী ডা. জোবায়দা রহমানও লন্ডনে অবস্থান করছেন। এ অবস্থায় জিয়া পরিবারের রাজনীতি কোন পথে— এমন প্রশ্নে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘বিএনপি জিয়াউর রহমান মারা যাওয়ার পর এবং এরশাদের সময়ও সংকটে পড়েছিল। ওয়ান-ইলেভেনের সময়ও একটা বড় সংকট তাদের গেছে। কিন্তু এবার পরিস্থিতি জটিল। দল তো আছে, তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে দলের মধ্যে সংহতিটা থাকবে কিনা। কারণ এই দলের অনেক নেতা অতীতে দল ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন আবার এসেছেন, আবার চলেও যেতে পারেন। সরকার থেকে নানান টোপ তাদের দেওয়া হতে পারে। সুতরাং এই সময়টা বিএনপির জন্য খুবই নাজুক।’
বিএনপির শীর্ষ নেতারা বলছেন, এ মুহূর্তে বিএনপির প্রথম ও প্রধান কাজ বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে মুক্ত করা। এজন্য আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি রাজপথের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি থাকবে। কারাবাস দীর্ঘায়িত হলে সে ক্ষেত্রে কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হতে পারে। তবে বেগম জিয়ার নির্দেশনা অনুযায়ী আপাতত নরম কর্মসূচিতেই থাকবে বিএনপি। এই সময়ে জামিন আবেদন করা হবে। এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘চেয়ারপারসনের মুক্তির বাইরে আমরা আপাতত কিছু ভাবছি না। তাকে মুক্ত করতে আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি রাজপথেও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি নিয়ে মাঠে আছি। এটাই আপাতত ভাবনা আমাদের।’
দলের নেতারা বলছেন, ক্ষমতাসীনরা চেষ্টা করছে, আগামী নির্বাচন পর্যন্ত বেগম জিয়াকে কারাগারে রেখে তাকে নির্বাচনের বাইরে রাখার। ৬৩২ পৃষ্ঠার এ বিশাল রায়ের সার্টিফায়েড কপি পেতে বেশ কিছু দিন লেগে যেতে পারে। এ ছাড়া আরও পাঁচ মামলায় জারি থাকা গ্রেফতারি পরোয়ানাও বেগম জিয়ার মুক্তিতে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার আমরা মামলার রায়ের কপি চেয়েছি। সেদিন আমরা সত্যায়িত কপিটি পাইনি। এখনো আমরা তা পাইনি বলে শুনেছি। এভাবে সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে রায়ের কপি দেওয়া নিয়ে গড়িমসি করছে।’ একই কথা বলেন স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য মির্জা আব্বাস।
জানা গেছে, খালেদা জিয়ার কারাগারে যাওয়ার আগে সম্ভাব্য প্রার্থীরা যেমন এলাকামুখী হয়ে নির্বাচনী প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তারা সবাই এখন দলীয় কর্মসূচি পালনে ব্যস্ত। অনেকেই মামলার ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তা ছাড়া বিএনপি-প্রধানের মুক্তির বাইরে তারা কিছুই ভাবছেন না।
বিএনপি সূত্র জানায়, দলের চলমান কূটনৈতিক তৎপরতা পর্যায়ে গতকালও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল। এর আগে কয়েক দফায় যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের প্রভাবশালী সব দেশের প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নেতৃত্বাধীন দলের শীর্ষস্থানীয় একটি প্রতিনিধি দল। বিএনপির রংপুর বিভাগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, ‘আমাদের কাছে খালেদা জিয়া মায়ের মতো। তাকে মুক্ত না করা পর্যন্ত বিএনপি ঘরে ফিরে যাবে না।’ বিএনপির সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানান, ‘সারা দেশে স্থানীয় সুবিধা অনুযায়ী জেলা নেতৃবৃন্দ এখন বিএনপি চেয়ারপারসনের মুক্তির কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত। নেত্রীকে মুক্ত না করা পর্যন্ত আমরা কেউ বাড়ি ফিরব না।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আওয়ামী লীগের লক্ষ্য হচ্ছে আমাদের অপ্রস্তুত রেখে নির্বাচন করা। জনগণের কাছে যেতে না দেওয়া। আমরা নির্বাচনে যেতে চাই। এর আগে চেয়ারপারসনসহ কারাগারে থাকা সব নেতা-কর্মীকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। চেয়ারপারসন ছাড়া বিএনপি নেতা-কর্মীরা নির্বাচনে যাবেন না— এটাই পরিষ্কার কথা।’