কক্সবাজারের মহেশখালীর আদিনাথ মন্দিরে চলছিল শীব চতুর্দশী পূজা। ভিড় ঠেলে সিঁড়ি বেয়ে সবাই উঠছেন পূজা দিতে। কিন্তু সিঁড়ির নিচে অসহায় আকুতি করে যাচ্ছেন এক বৃদ্ধা। খুব করে চাইছেন কোনোভাবে মন্দিরে গিয়ে পূজা দেবেন তিনি। কিন্তু এমন ভিড়ে কার কথা কে শোনে। শেষ পর্যন্ত এগিয়ে এলেন মহেশখালী থানার কনস্টেবল আফতাব উদ্দিন। বৃদ্ধাকে কোলে তুলে সিঁড়ি বেয়ে মন্দিরে তুলে দিলেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে গেছে ছবিটি। ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে আফতাব এক বৃদ্ধাকে কোলে তুলে বেয়ে উঠছেন মন্দিরের শতাধিক সিঁড়ি। আর তা অবলোকন করছেন সিঁড়ির দু’পাশে দাঁড়ানো পূজারী ও দর্শনার্থীরা। বৃদ্ধাকে মন্দিরের একেবারে জিরো পয়েন্টে এনে পূজা ও মনভরে প্রার্থনা করবার সুযোগ করে দিয়ে পুনরায় কোলে নিয়ে আগের জায়গায় নামিয়ে দেন পুলিশ কনস্টেবল আফতাব উদ্দিন।
বুধবার সকালে মেলা প্রাঙ্গণে বেলুন ব্যবসায়ী গণেশ বনিক (৪৬) ও মমতা রাণী বণিক (৩৮) নামে এক দম্পতি গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মারা যান। আহত হন আরও বেশ কয়েকজন। এ ঘটনার পর এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল। এরই মধ্যে বিকেলে মহেশখালী থানার কনস্টেবল আফতাব উদ্দিনের (নং-৫২৯) এ মানবিক ঘটনা সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে।
এ ঘটনার রহস্য খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে এক অভিনব কাহিনী। যা ধর্মের চেয়ে মানবিকতাকে উঁচুতে তুলেছে। কোলে থাকা বৃদ্ধার হাতের কারণে পুলিশ সদস্যের নেমপ্লেটটি দেখা যাচ্ছিল না। তাই অনেকে মনে করেছিলেন সনাতনী যুবকটি তার বয়োবৃদ্ধ আত্মীয়াকে জীবনের শেষ বয়সে শিবপূজা দিতে সহযোগিতা করছেন। কিন্তু যখন জানা গেল পুলিশ সদস্যটি মুসলমান তখন চারদিকে হৈ চৈ পড়ে যায়। এটা কীভাবে হলো? কেন একজন মুসলমান সনাতনী এক বৃদ্ধাকে এভাবে পূজা করতে সহযোগিতা করলেন? এ রকম নানা ধরনের আলোচনা। এতে পুলিশের ভালো-মন্দ নিয়ে নানাজন নানা অভিজ্ঞতার কথা বলে আলোচনাটি সরব রেখেছে।
পুলিশ কনস্টেবল আফতাব উদ্দিন বলেন, আমরা আদিনাথ মন্দির এলাকায় নিরপত্তার ডিউটি করছিলাম। আদিনাথ মন্দিরের নিচে বসেছে শতাধিক দোকান-পাটের মেলা যেখানে মানুষে গিজগিজ করছিল। আর মন্দিরে উঠতে পার হতে হয় শতাধিক সিঁড়ি। নিরপাত্তার স্বার্থে সিঁড়ির মাঝখান খালি রেথে দুপাশ দিয়ে পূজারী ওঠার ব্যবস্থা করা হয়। সেভাবেই সময় মতো পূজা দিতে যে যার মতো ব্যস্ত। সে ব্যস্ততায় দেখলাম লাইনে দাঁড়াতে অক্ষম এক বৃদ্ধা সিঁড়ির একপাশে বসে কাতর স্বরে সবার কাছে আকুতি রেখে চলছে, তাকে যেনো মূল মন্দিরে পৌঁছাতে সহযোগিতা করা হয়। কিন্তু কেউ বিষয়টি গ্রাহ্য করছে না। নতুন কাপড়ে কঙ্কালসার দেহের নারীটিকে দেখে আমার মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। নিজের অজান্তেই তাকে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। মূল মন্দিরের সামনে তার পছন্দমতো জায়গায় বসালাম। পূজা ও প্রার্থনা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে আবার সেই জায়গায় এনে নামিয়ে দিলাম।
আপনি মুসলিম হয়ে একজন সনাতনী নারীকে পূজা করতে সহযোগিতা করলেন এতে কোনো সংকোচ কাজ করেছে কিনা জানতে চাইলে আফতাব বলেন, যখন বৃদ্ধাকে কোলে নিলাম তখন আমার মাথায় ধর্মানুভূতি কাজ করেনি। মনে হচ্ছিল আমি আমার মাকে তার আবদার পূরণে সহযোগিতা করছি। কোলে মানুষ নিয়ে শতাধিক সিঁড়ি ওঠা কষ্টকর; তাই চারপাশে তাকানো হয়নি আমার। কে কি করছে, কে ছবি তুলছে এসব খেয়ালে আসেনি। যখন তাকে পূর্বের জায়গায় নিরাপদে পৌঁছাতে পারলাম তখন নিজেকে বেশ প্রফুল্ল মনে হচ্ছিল। তখন দেখি বৃদ্ধাটি নির্দিষ্ট লগ্নের ভেতর পূজা দিতে পেরে নানা ধরণের আশীর্বাদ করছে। তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিরাপত্তার কাজে লেগে যাওয়ায় বৃদ্ধাটির পরিচয়ও জানা হয়নি। বৃদ্ধ নারীটি তার জন্য অনেক দোয়া-আশীর্বাদ করেছে, এটিই তার বড়ো পাওনা বলে জানান এ পুলিশ সদস্য।
পুলিশ কনস্টেবল আফতাব উদ্দিন মহেশখালী থানায় কর্মরত। তিনি নোয়াখালীর কবিরহাট এলাকার মৃত বেলায়েত হোসেনের ছেলে।
কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিকবিয়ষক সম্পাদক অ্যাডভোকেট তাপস রক্ষিত বলেন, কিছু ঘটনা এমনই হয়। যা দিয়ে প্রমাণ পাওয়া যায় আমরা অসাম্প্রদায়িক দেশের অধিবাসী। পুলিশ সদস্য আফতাবের ঘটনাটি ধর্মকে ছাপিয়ে মানবিকতার জয়গান এনে দিয়েছে। আমরা এমনই বাংলাদেশ অব্যাহত থাকুক কামনা করি। মানবিক মানুষ হিসেবে আফতাবকে আমরা স্যালুট জানাচ্ছি।
মহেশখালী থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ বলেন, সবার নিরাপত্তায় কাজ করতে গিয়ে পরিবার-পরিজন থেকে পুলিশ সদস্যদের বছরের সিংহভাগ সময় দূরেই থাকতে হয়। এরপরও পান থেকে চুন খসলেই সমালোচনায় করা হয় পুলিশের। কিন্তু আফতাবদের মতো অসংখ্য ভালো কাজ পুলিশ নিত্যদিন করছে। কিছু নজরে আসে আর কিছু আড়ালে থেকে যায়। নজরে আসা আফতাবের মানবিক ঘটনাটি সাধারণ মানুষের মতো আমাদেরও পুলকিত করছে।