ফিচার

খালেদা জেলে যাওয়ায় রাজনীতিতে নতুন হিসাব

By Daily Satkhira

February 17, 2018

অনলাইন ডেস্ক: নির্বাচনের বছরে খালেদা জিয়া কারাগারে থাকায় দেশের রাজনীতিতে নতুন হিসাব যোগ হয়েছে। বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে, নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়া মুক্ত হলে ওই হিসাব হবে একরকম। আবার শেষ পর্যন্ত জামিনে তাঁর মুক্তি না ঘটলে পরিস্থিতি ভিন্ন রকম হতে পারে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, মুক্ত খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যাপারে দরকষাকষি এবং নির্বাচনে যাওয়া-না যাওয়াসহ সব ইস্যুতে সিদ্ধান্ত নেওয়া বিএনপির জন্য খুব সহজ হবে। একইভাবে তাঁর অনুপস্থিতিতে প্রতিটি ইস্যুতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ দলটির জন্য অত্যন্ত কঠিন।

আইনি মারপ্যাঁচে খালেদা জিয়াকে কারাগারে আটক রাখা গেলে নির্বাচনী বৈতরণী সরকার অতি সহজে পার হতে পারবে—এমন ধারণা জন্মাচ্ছে জনমনে। অনেকের মতে, এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে নির্বাচনী মাঠ থাকবে সরকারি দলের নিয়ন্ত্রণে। আর ওই ঘটনার প্রভাব অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মধ্যেও পড়বে। তারা তখন বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে না থেকে সরকারের দিকেই ঝুঁকবে, অর্থাৎ নির্বাচনে যাবে। কারণ খালেদা জিয়া নির্বাচনের মাঠে না থাকলে ওই সব দলের মধ্যে এক ধরনের আস্থার সংকট দেখা দেবে। তাদের কাছে তখন চাপ ও প্রলোভন আসবে। এমন পরিস্থিতিতে ৫ জানুয়ারির তুলনায় বেশিসংখ্যক দলের নির্বাচনে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তাঁদের মতে, এর ফলে বিএনপির নির্বাচন বর্জনও তখন কার্যকর ফল বয়ে আনবে না।

সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী মনে করেন, খালেদা জিয়ার কারাগারে থাকা-না থাকার বিষয়ে কিছু হিসাব-নিকাশ থাকলেও বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে যেতে পারে। কারণ না গেলে তাদের নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে। খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে পারলে রাজনীতির মাঠের খেলা একতরফা হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি তা মনে করি না। কারণ বাংলাদেশের মানুষ সব সময় প্রতিবাদী। সব সময় তারা নরম বা শান্ত থাকে না। মানুষের বিদ্রোহ অন্য জিনিস। ভোটের মধ্যেও বিদ্রোহ থাকতে পারে।’ তিনি আরো বলেন, ‘ওয়েট অ্যান্ড সি।’

শত নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের মতে, খালেদা জিয়া কারাবন্দি থাকায় কিছু হিসাব-নিকাশ সামনে এলেও চূড়ান্তভাবে কী ঘটবে তা বলার সময় এখনো আসেনি। তবে এটুকু বলা যায়, তাঁকে আটকে রাখা হলে নির্বাচনপূর্ব রাজনীতিতে এ ঘটনা ভয়ংকর প্রভাব ফেলবে। তিনি বলেন, জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে সরকার ভয় পাচ্ছে। তাই বিএনপি চেয়ারপারসনকে আটকে রেখে তারা নির্বাচন করে ফেলতে চায়। কিন্তু এতে খুব ভালো ফল সরকার পাবে বলে মনে হয় না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে জোর করে আটকে রাখা হলে নির্বাচন হওয়ার সুযোগ কম। তখন পরিস্থিতি অন্যদিকে টার্ন নেবে।’

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মনে করেন, খালেদা জিয়াকে কারাগারে রাখা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। তিনি জামিনে বেরিয়ে আসবেন। ফলে তাঁর অনুপস্থিতি নিয়ে যেসব সমীকরণ মেলানো হচ্ছে তা সফল হওয়ার নয়। তাঁর মতে, বড়জোর আর এক সপ্তাহ জামিন নিয়ে হয়রানি করা হতে পারে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, খালেদা জিয়াকে জেলে রাখা হলে নির্বাচনে বিএনপির আসন বেড়ে যাবে। এটি দেশের হাওয়া দেখে সরকার বুঝতে পেরেছে। ফলে সরকার তাঁকে আর আটকে রাখবে না।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন, খালেদা জিয়াকে কারাগারে আটকে রাখা দুরূহ হবে। পাশাপাশি এ ঘটনা সরকারের জন্যও উভয় সংকটে পরিণত হবে। তাঁর মতে, জোর করে আটকে রাখতে চাইলে সে ক্ষেত্রে সরকারকে অযৌক্তিক পন্থা অবলম্বন করতে হবে এবং চক্ষুলজ্জা বিসর্জন দিতে হবে। আবার এর প্রতিক্রিয়া জনমনে ব্যাপকভাবে পড়বে। জনগণ আরো বেশি ক্ষুব্ধ হবে। সে ধরনের ঝুঁকি সরকার নেবে বলে মনে হয় না। খালেদা জিয়াকে আটকে রাখার মতো নিয়ন্ত্রণ এবং কর্তৃত্বই যদি প্রতিষ্ঠা করতে পারে, সেক্ষেত্রে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার সরকারের জন্য কঠিন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, সেটি সরকার পারবে। ওই পরিস্থিতিতে একটি রাবার স্ট্যাম্প পদ্ধতির নির্বাচন করে তারা আবার ক্ষামতায় আসতে পারবে। কিন্তু এর পরিণতি শুভ হবে না।’

বিকল্প ধারার সভাপতি ও নবগঠিত যুক্তফ্রন্টের চেয়ারম্যান অধ্যাপক বি চৌধুরী বলেন, ‘কোনো কারণে বিএনপি নির্বাচনে না গেলে সরকার একতরফা সবকিছু করবে এটিও যেমন বাঞ্ছনীয় নয়, তেমনি বিএনপি নির্বাচনে না গেলে মাঠ ছেড়ে দেব এটিও করা ঠিক নয়। বিএনপিকে অনুসরণ করব কি না জানি না। তবে মনে হচ্ছে বিএনপি নির্বাচনে যাবে। বিএনপি না গেলে সরকার ইচ্ছামতো সিল মারবে। ফাঁকা মাঠে তাদের গোল দেওয়ার সেই সুযোগ দেওয়া ঠিক হবে না। চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে হবে।’ এভাবেই নির্বাচনে যাওয়ার ইঙ্গিত দেন বি চৌধুরী।

৪০টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ১২টি দল অংশ নিলেও বিএনপিসহ ২৮টি দল তা বর্জন করেছিল।

দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়টি বহুলাংশে খালেদা জিয়ার কারাগারে থাকা-না থাকার ওপর নির্ভরশীল বলে জানা গেছে। যদিও এ প্রশ্নে বিএনপির নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনো আসেনি। তবে ভেতরে ভেতরে সম্ভাব্য ওই পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।

দলীয় সূত্রে জানা যায়, বিএনপির বড় একটি অংশ ‘খালেদা জিয়ার মুক্তি’কে নির্বাচনী ইস্যু হিসেবে নিয়ে নির্বাচনে যাওয়া উচিত বলে মনে করে। তাদের মতে, জনগণ ভোট দেওয়ার সুযোগ পেলে বিএনপির পক্ষেই ভোট দেবে। গণজোয়ার সরকার ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। দলের অপর একটি অংশ খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে নির্বাচনে যাওয়ার বিরোধী। তাদের মতে, খালেদা জিয়াকে কারাগারে রাখতে সরকার সক্ষম হলে বুঝতে হবে প্রশাসন ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অভিমত সরকারের পক্ষে। তাই ওই অবস্থায় নির্বাচনে গিয়ে কিছু আসন নিয়ে বিরোধী দলে বসা ছাড়া বিএনপি আর কিছুই অর্জন করতে পারবে না। ফলে খালেদা জিয়া মুক্ত না হলে তারা নির্বাচন বর্জনের পক্ষে।

অনেকের আশঙ্কা, পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকলে নির্বাচনে যাওয়ার জন্য মামলা-হামলাসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ওপর চাপও সৃষ্টি হতে পারে। এমনকি প্রলোভন আসাও অস্বাভাবিক নয়। ওই সব চাপ মোকাবেলা করে নেতাদের টিকে থাকার পাশাপাশি দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখা তাঁদের জন্য কঠিন হবে। আন্তর্জাতিক মহলও ওই সময় তৎপর হবে। তবে তা সরকারের অনুকূলে না প্রতিকূলে তা এখনো নিশ্চিত নয়। অনেকের মতে, আন্তর্জাতিক মহলের অবস্থান অনুকূলে বুঝলে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের সর্বাত্মক আন্দোলনে যাওয়ারও সম্ভাবনা আছে। খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে বিএনপি ভেঙে যাবে বলে নানা মহল থেকে প্রচার আছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসনকে নির্বাচন করতে দেওয়া হবে না এমন অভিপ্রায় থেকে সাজা দিয়ে কারাগারে নেওয়া হবে—এটি যে সরকারের হিসাব-নিকাশ তা কেবল আমরা নই, দেশের জনগণও বোঝে। তবে তাদের ওই অভিপ্রায় বা ইচ্ছা পূরণ হবে কি না তা সময়ই বলে দেবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাজনীতির হিসাব বিএনপিরও আছে। তাদের হিসাবে বা ফাঁদে বিএনপি পা দেবে না। বিএনপি তার হিসাবেই এগোবে; খালেদা জিয়ার পরামর্শেই সবকিছু হবে। চাপ দিয়ে কিছু আদায় করা সহজ নয়।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে সরকারি দলের নেতারা ঢেঁকুর তুলছেন। মনে হয় যেন তাঁরা জয় করে ফেলেছেন। এখন নির্বিঘ্নে নির্বাচন করে ফেলবেন। কিন্তু বিষয়টি অত সহজ নয়।’ তাঁর মতে, সরকারি দলের হিসাব জনগণের কাছে দৃশ্যমান হয়ে গেছে। বিএনপি জনগণের পথেই থাকবে। সূত্র: কালের কণ্ঠ।