জ্বালানি তেল এবং গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আগামী এপ্রিলে ব্যয়বহুল এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি শুরুর পর দেশজ গ্যাসের সাথে তা মিশিয়ে বিক্রি শুরু হবে। ওই মাস থেকেই দেশীয় এবং আমদানিকৃত গ্যাসের দাম সমন্বয় করে নতুন এবং বর্ধিত দাম কার্যকর করতে চায় সরকার। তবে এ ব্যাপারে যে আইনি বাধা ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে তা কাটিয়ে কিভাবে মূল্যহার সমন্বয় করা যায় সেটি খতিয়ে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়ে তা দেশের বর্তমান বাজারদরকে ছাড়িয়ে গেছে। বিদ্যমান দরে তেল বিক্রি করে ফের লোকসান গুণতে শুরু করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। ২০১৪ সালের শেষভাগ হতে বিশ্ববাজার থেকে কম দামে তেল কিনে দেশে বেশি দামে বিক্রি করে বিপিসি। তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে বড় অংকের লাভ গোণার পর গত নভেম্বর-ডিসেম্বর থেকে ফের লোকসান পর্বে প্রবেশ করেছে তেল আমদানি ও বাজারজাতকারী একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থাটি। এই পরিপ্রেক্ষিতে তেলের দাম বৃদ্ধি করার জন্য বিপিসি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে প্রস্তাব দিয়েছে। প্রসঙ্গত, গত বছরের ১ মার্চ থেকে গ্যাসের এবং ১ ডিসেম্বর থেকে বিদ্যুতের বর্ধিত দাম কার্যকর হয়। এখন কাছাকাছি সময়ে তেল এবং গ্যাসের দামবৃদ্ধির প্রস্তাব আসায় নড়েচড়ে বসেছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। বিদ্যুত্ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, নির্বাচনী বছরে নিত্যপ্রয়োজনীয় দুই জ্বালানি পণ্যের দাম বাড়ানোর প্রভাব বোঝার চেষ্টা করা হচ্ছে। তিন বছর আন্তর্জাতিক দরের চেয়ে বেশি দামে তেল বিক্রি করার পর এখন আন্তর্জাতিক বাজারদরের সমান দামে তেল বিক্রি করার প্রস্তাবে জনমনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। আর ৫০ কোটি ঘনফুট এলএনজি আগামী এপ্রিলে জাতীয় গ্যাস গ্রিডে যুক্ত হলে গ্যাসের গড় পাইকারি দাম বেড়ে যাবে। শুল্ক এবং কর মওকুফ করে এই মিশ্রিত গ্যাসের দাম কতটুকু বাড়ানো যাবে সে বিষয়ে চলতি ফেব্রুয়ারিতেই নীতিগত সিদ্ধান্ত নিবে সরকার। কিন্তু এপ্রিলের মধ্যে গণশুনানি আয়োজন ও শেষ করে দামবৃদ্ধির ঘোষণা দেওয়া এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসির (এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন) জন্য প্রায় অসম্ভব। এ নিয়েও করণীয় ঠিক করতে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশনা চাওয়া হবে। গ্যাসের দাম সমন্বয়: জ্বালানি বিভাগ সূত্র জানায়, আগামী ২৫ এপ্রিলের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জিকে এলএনজি টার্মিনাল সম্পূর্ণ প্রস্তুত করার জন্য সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে পেট্রোবাংলা। কাতার এবং ইন্দোনেশিয়া থেকে এলএনজি আমদানিতে চুক্তিও সম্পন্ন হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে দুই তরফই প্রয়োজনীয় কাজ ও সরবরাহ প্রস্তুতি শেষ করতে পারবে বলে সরকারকে আশ্বস্ত করেছে। এপ্রিলের শেষ কিংবা মে’র শেষ সপ্তাহে এলএনজি আমদানি শুরু হলে গ্যাসের দাম কত হবে তা নিয়ে গত সোমবার এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন, জ্বালানি বিভাগ এবং পেট্রোবাংলা আনুষ্ঠানিক আলোচনা করে। বিইআরসিতে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক বিদ্যুত্ সচিব মনোয়ার ইসলাম এবং জ্বালানি সচিব নাজিমউদ্দিন চৌধুরী ছাড়াও কমিশন সদস্য, জ্বালানি বিভাগ এবং পেট্রোবাংলার কয়েকজন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। এ বিষয়ে মনোয়ার ইসলাম বলেন, আমরা চাইলেই তো আর দাম বৃদ্ধি করতে পারি না। এলএনজি আমদানিতে কি পরিমাণ ব্যয় বাড়বে তা পর্যালোচনা করে প্রস্তাব দিতে বলা হয়েছে। প্রস্তাবনা পাওয়ার পর আমরা বিষয়টি বিবেচনা করব। এলএনজি ও প্রাকৃতিক গ্যাসের মধ্যে মূল্য সমন্বয়ের জন্য বিইআরসির সদস্য রহমান মোরশেদের নেতৃত্বাধীন একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের বর্তমান বিক্রয়মূল্য দুই দশমিক ১৭ ডলার। সমপরিমাণ এলএনজির আমদানি মূল্য ৮ মার্কিন ডলার। এই সময়ে দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুট এলএনজি ২ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট দেশজ গ্যাসের সঙ্গে মিশিয়ে বিক্রি করলে রি-গ্যাসিফিকেশন চার্জ, সঞ্চালন এবং বিতরণ ব্যয় এবং সকল রকমের কর অন্তর্ভুক্ত করলে দাম পড়বে ৪ দশমিক ৩৫ ডলার। আর এলএনজি পৃথকভাবে বিক্রি করতে চাইলে দাম পড়বে ২৩ দশমিক ১১ ডলার। তবে সকল কর রেয়াত করলে এলএনজির দর পড়বে ১০ দশমিক ৪০ ডলার আর মিশ্রিত গ্যাসের দাম পড়বে ৪ দশমিক ১৪ ডলার। অর্থাত্ এখনই মিশ্রিত গ্যাসের দাম সরাসরি দ্বিগুণ হয়ে যাবে। জ্বালানি বিভাগ সূত্র জানায়, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির শুরুতেই গ্যাসের ওপর থাকা ৯৩ দশমিক ২৪ ভাগ সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এলএনজির দাম নিয়ন্ত্রণে দেশীয় গ্যাসের ওপর থাকা শুল্কও প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। শুধুমাত্র গ্যাসের ওপর ১৫ ভাগ ভ্যাট থাকবে।
তেলের দাম সমন্বয়: এদিকে বিশ্ববাজারে তেলের দামবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে জ্বালানি পণ্যটির দাম বাড়াতে জ্বালানি বিভাগে প্রস্তাব দিয়েছে বিপিসি। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়লে দেশে সমহারে বৃদ্ধি এবং কমানো হলে সমহারে কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে দামবৃদ্ধির প্রবণতা অব্যাহত থাকায় প্রস্তাব গৃহীত হলে দাম বাড়বে। গত নভেম্বরে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল (প্রায় ১৫৯ লিটার) তেলের দাম ছিল প্রায় ৫০ মার্কিন ডলার। গত দুই সপ্তাহে এ দাম ৬০ থেকে ৭০ ডলারে উঠানামা করছে। দেশে বর্তমানে প্রতি লিটার পেট্রোল ৮৬ টাকায়, অকটেন ৮৯ এবং কেরোসিন ও ডিজেল ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বিদ্যুত্ উত্পাদনে ব্যবহূত প্রতি ইউনিট ফার্নেস তেলের দাম বর্তমানে ৪২ টাকা। এ অবস্থায় বর্তমানে প্রতি লিটার ডিজেল বিক্রিতে ৩ টাকা ৯০ পয়সা লোকসান করছে বিপিসি। কেরোসিন এবং ফার্নেস তেলে যথাক্রমে ১১ টাকা ৫০ পয়সা এবং প্রায় ১০ টাকা লোকসান গুণছে। সবমিলিয়ে দেড় মাস ধরে দৈনিক ১০ কোটি টাকা লোকসান গুণছে বিপিসি। ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমায় লোকসান আরো বেশি হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বিদ্যুত্, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, এলএনজি আমদানির কারণে গ্যাসের সার্বিক দাম অনেক বেড়ে যাবে। এখন গ্রাহক পর্যায়ে কিভাবে মূল্য সমন্বয় করা যায় তা নিয়ে কাজ চলছে। বাজারব্যবস্থা এবং জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। তিনি আরো বলেন, বিপিসি এখন ফের লোকসান গুণতে শুরু করেছে। ভারতেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে তেলের দাম বেড়েছে। বিপিসিও স্বয়ংক্রিয়ভাবে তেলের দাম সমন্বয়ের একটি প্রস্তাব দিয়েছে। সবকিছু খতিয়ে দেখে সরকার সিদ্ধান্ত নিবে। তবে আওয়ামী লীগের এক জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, নির্বাচনী বছরে সরকার নতুন করে তেলের দাম বাড়াতে চাচ্ছে না। এর মূল্য সমন্বয়ে বিকল্প উপায় গ্রহণ করা হবে। আর গ্যাসের দাম বৃদ্ধির জন্য এখন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও নিয়ম অনুযায়ী তা কার্যকর করতে অন্তত ছয় মাস সময় লেগে যাবে। সেক্ষেত্রে যদি এর দাম বাড়ানো হয় তবে তা মে মাসের মধ্যে বাড়াতে হবে। সেই উপায় নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে।