সাতক্ষীরা

ডা. এমআর খান একটি ইতিহাস, একটি শিক্ষা -সুভাষ চৌধুরী

By Daily Satkhira

November 07, 2016

‘বিশ্রাম কাজের অঙ্গ একসাথে গাঁথা, নয়নের অঙ্গ যেমন নয়নের পাতা’। মাত্র কিছুদিন আগে নিজের জীবন চরিতে একথা লিখবার পর তিনিই বলেছেন ‘ কানাডা থেকে মেয়ে ডাকে , ডাকে নাতি নাতনিরা । সে সময় কই যে বিশ্রাম নেবো। বিশ্রাম নেবো একবারই। শেষ বিশ্রামের জায়গাটিও যে তৈরি হয়ে আছে’। একজন সফল মানুষের এই অভিব্যক্তি আমাদের কর্তব্য কাজের শিক্ষা দেয়। শিক্ষক হিসাবে তিনিই শিক্ষা দিয়েছেন শিশুদের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসার।  ‘আজকের দিনের শিক্ষকরা যেমন ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের একগাদা বই চাপিয়ে দিয়ে বাড়িতে পড়ে সব লেখা ও পড়ার কাজ শেষ করে আসার  তাগিদ দেন। আমাদের সময়ে বই ছিল কম। সন্ধ্যায় পড়ালেখা।  সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে পড়ালেখা। এরপর দিবাভাগে স্কুলে শিক্ষকদের সান্নিধ্যে,  বাকি সময় কেটেছে খেলাধুলা আনন্দ ফুর্তি করে। এতেই আমাদের লেখাপড়া হয়ে যেতো। এখন তার উপদেশ ‘ শিশুদের  পিঠের ভারি ব্যাগ নামিয়ে নিন। অল্প সংখ্যক বই দিন , ওদের রিক্রিয়েশনের সুযোগ দিন । ওরা সুস্থ থাকবে’। বইয়ের ভারে ওদের কুঁজো করে ফেলবেন না। জাতীয় অধ্যাপক ডা. এমআর খানের এই অভিব্যক্তি আমাদের সমাজকে নতুন করে গড়ে দিতে পারে। যেখানে শিশুরা হয়ে উঠবে  সুস্বাস্থ্যের অধিকারী । যেখানে শিশুরা তাদের সাধ্যমতো মেধার বিকাশ ঘটাতে পারবে। উপমহাদেশের কীর্তিমান পুর”ষ , আমাদের পরম শ্রদ্ধার পাত্র ডা. এমআর খান শিশু ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে শিশুদের বেড়ে ওঠার পথ সৃষ্টি করেছেন। গ্রামের নাম রসুলপুর । এই রসুলপুর অগ্নিগর্ভ। ডা. এমআর খানের নানা উপমহাদেশের বিখ্যাত রাজনীতিক , শিক্ষাবিদ, লেখক , সাংবাদিক  ও দৈনিক আজাদ এর সম্পাদক মওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁর সান্নিধ্যের কারণে এই রসুলপুরে  এসেছেন বিদ্রোহী কাজী নজর”ল ইসলাম , সঙ্গীত স¤্রাট আব্বাসউদ্দিন আহমদসহ অনেকেই। শিশুদের তিনি হৃদয় দিয়ে ভালোবেসেছেন। তাদের শারীরিক যন্ত্রণাকে নিজের যন্ত্রণা হিসাবে গ্রহন করেছেন। শিশু চিকিৎসায় পথিকৃৎ হয়ে আছেন তিনি। ১৯৫৩ সালে কলকাতা মেডিকেল থেকে এমবিবিএস ডিগ্রী অর্জন করে নিজ গ্রাম রসুলপুরে আসার পর মেডিকেল প্রাকটিস শুর” করেন তিনি। তার প্রতিবারের কনসালটেন্সি ফি ছিল চার টাকা। দরিদ্র হলে দুই টাকা অথবা ফ্রি। ডাক্তারি বিদ্যাকে তিনি মানব সেবার কমিটমেন্ট বা অঙ্গিকার হিসাবে দেখেছেন। গ্রামে তখন ডাক্তার মিলতো না।  শহরেও প্রায় একই অবস্থা। তার সময়ে কেবলমাত্র ফিজিশিয়ান নয় , একই সাথে সার্জন,আই স্পেশালিস্ট, অর্থোপেডিক সার্জন সবার কাজ করতে হয়েছে। তিনি রোগীর দাঁত তুলেছেন। দাঁত ও মাড়ির চিকিৎসা দিয়েছেন। হাড়ভাঙ্গা এমনকি গাইনোকোলজিস্ট/ অবস্ট্রাকটিশিয়ান এর ভূমিকায় ডেলিভারিও করাতে হয়েছে তাকে। ডা. এমআর খান চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিতদের এবাবেই নানামুখী  শিক্ষা দিয়েছেন। রোগীর কল পেয়ে গ্রাম গ্রামান্তরে যেতে হতো তাকে।  ১৯৫৪ সালে আট মাইল দুরের এক রোগীর কল পেয়ে তার কম্পাউন্ডারের মাধ্যমে আট টাকা ফি রফা করেন।  বাই সাইকেলে চেপে ১৬ মাইল রাস্তা যাতায়াত করে রোগী দেখে তার বাড়িতে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে রোগীকে শেষ পর্যবেক্ষন করে ফিরে আসছিলেন তিনি। এসময় তার দেয় ফি আট টাকার স্থলে রোগীর স্বজনরা কমপাউন্ডারের হাতে দুই টাকা দেন। কমপাউন্ডার তা নিতে অসম্মতি প্রকাশ করেন। ডা. খান তাকে নিবৃত্ত করে বলেন তারা গরিব মানুষ। বরং ওই দুই টাকা ফিরিয়ে দিন। ডা.  খান এর মধ্য দিয়ে তার মহানুভবতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। ১৯৮৮ সালে ডা. এমআর খান আইপিজিএমআর ( বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে অবসর গ্রহন শেষে তাকে দেওয়া বিদায় সংবর্ধনার জবাবে বলেন ‘ তোমাদের প্রতি আমার দুটি কথা। তোমরা  রোগীর কি রোগ, কতোদিনে সারতে পারে , আদৌ সারবে কিনা, চিকিৎসায় কি কি সমস্যা এসব কোনো কিছু না জানিয়ে রোগী ও স্বজনদের অন্ধকরে  রেখে থাকো।  এতে চিকিৎসা কার্যক্রম সংকটময় হয়। তাদের ভালোভাবে জানতে না দিয়ে ডাক্তার নিজেকে বিশেষজ্ঞ ভাবেন । মনে করেন তাদেরকে বলে কি লাভ । তারা তো বুঝবে না। এই মানসিকতা ত্যাগ করো। রোগীর শারীরিক প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরো। তাদের সাথে খোলামেলা হও। চিকিৎসা সহজ হবে। রোগী সুস্থ হলে তো কথাই নেই । না হলেও স্বজনরা তোর প্রতি রাগান্বিত হবে না’। শিশু চিকিৎসায় পথিকৃৎ  ডা. এমআর খান তার ‘জীবনের জলছবি’ তে লিখেছেন  ‘১৯৭১ এ অবর”দ্ধ বাংলাদেশে পাকহানাদার বাহিনীর অত্যাচার নির্যাতন ও গনহত্যাযজ্ঞের  ভয়ংকর দিনগুলির মধ্যে  গৃহবন্দী থাকা  বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ছেলে জয়কে চিকিৎসা দিয়েছিলেন ডা.এমআর খান’। সেদিনের সেই স্মৃতি  তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৮ সালে ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ ও শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন হাসপাতাল উদ্বোধন করতে এসে বলেন ‘ ৭১ এর সেই বিপজ্জনক দিনে আপনি আমার ছেলে জয়এর চিকিৎসা করার সাহস দেখিয়ে চিকিৎসক হিসাবে মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে আমাদের বাসায় এসেছিলেন। সেই দিনটাকে কিন্তু আমি ভুলিনি’। পাকিস্তানিদের কড়া সামরিক বেষ্টনীতে থাকা অবস্থায় জয়কে চিকিৎসা দিয়ে তিন প্রমান করেছেন রোগীর চিকিৎসাই প্রথম। তিনি সব ভয়কে তুচ্ছ জ্ঞান করে প্রমান করেছেন চিকিৎসা মানব সেবার জন্য। এ ঘটনা থেকে ডাক্তাররা শিক্ষা নিতে পারেন যে সেবাই ধর্ম। ডা. এমআর খান শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন গড়ে ভেবে নেন মাইক্রোক্রেডিট প্রোগ্রামের কথা। ১৯৯৩ সালে কেবলমাত্র মহিলা সদস্যদের নিয়ে তিনি শুর” করেন এই প্রোগ্রাম। মহিলারা ধান থেকে চাল বানিয়ে বিক্রি, সবজি ব্যবসা, মুড়ি বানিয়ে বিক্রি, মুদি দোকান, মাছের ব্যবসা, সেলাই মেশিন, গাভীর দুধ, হাঁস মুরগি পালন, বাঁশ বেত দিয়ে কুটির শিল্প , তাঁত শিল্প, কার”শিল্প, চুন বানানো , মিষ্টির দোকানসহ নানা ধরনের ক্ষুদ্র ব্যবসা করে স্বনির্ভর হয়ে উঠতে সক্ষম হন। কয়েক হাজার নারী সদস্য এভাবে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন ডা. এমআর খানের বদৌলতে। নিজ গ্রাম রসুলপুরে ভোকেশনাল ট্রেইনিং ইন্সটিটিউট গড়ে তুলে বৃত্তিমূলক শিক্ষায় অগনিত বেকার ও সামান্য লেখাপড়া জানা যুবকদের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছেন। সেখানে লেদ মেশিন, কার্পেটির্ং,লাইট ইঞ্জিন, টেইলারিং,ইলেকট্রিক, ইলেকট্রনিক্স,কমপিউটার, রেফ্রিজারেশন ও এয়ারকন্ডিশন বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়। বাড়ির লাগোয়া রসুলপুর হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করে তিনি শিক্ষার আলোকবর্তিকা হাতে তুলে নিয়েছেন। ঘরে ঘরে শিক্ষা পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। যারা চিকিৎসার জন্য বেশি টাকা দিতে পারেন না, যারা ঠিক মতো চিকিৎসা পান না, যারা হাসপাতালে সিট পান না তাদের নিয়ে ভেবেছিলেন তিনি।  ১৯৮৮ সালে তিনি তাদের জন্যই গড়ে তালেন সেন্ট্রাল হাসপাতাল। তিনিই গড়েছেন বাংলাদেশে প্রথম মহিলা মেডিকেল কলেজ ও  হাসপাতাল।  মহিলাদের চিকিৎসা যারা মহিলাদের দিয়েই করাতে চান তাদের জন্য এই কলেজ ও হাসপাতাল একটি বড় প্রাপ্তি। শিশু স্বাস্থ্য ও শিক্ষার উন্নতির লক্ষ্যে ডা. এমআর খান ও আনোয়ারা খান ট্রাস্ট গঠন করেন তিনি। শিশুদের কল্যাণে নিজের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকায় গড়ে তোলা এই ট্রাস্টের  বৃত্তি নিয়ে গরিব ও মেধাবীরা লেখাপড়া করছে। মায়ের স্বাস্থ্য , শিক্ষা ও আত্মকর্মসংস্থানেরও সৃষ্টি হচ্ছে। ডা. এমএর খানের দিনের শুর” হয়  ভোর ৫টায়। ফজরের নামাজ পড়া। বাড়ির ছাদে উঠে কিছুক্ষন হাঁটাহাঁটি করা। এরপর  কাক শালিক চড়–ই দোয়েল পাখিদের জন্য পানি ঢেলে রাখা। তিনি ও তার স্ত্রী নিয়মিত খাবার দিতেন তাদের। নিয়মিত রোগী দেখা তার র”টিন ওয়ার্ক। মাঝে মাঝে সমাজসেবামূলক কাজ করা।  ১৯৮৪ সালে ঢাকায় কারফিউ চলছে। সেই কারফিউয়ের মধ্যে রাত ২ টায় কলিং বেল বাজিয়ে ডা. এমআর খানের বাড়িতে ঢুকে পড়েন বাংলাদেশের একজন শীর্ষস্থানীয় অভিনেত্রী। গুর”তর অসুস্থ তার শিশুটিকে দেখে দেওয়ার অনুরোধ জানালেন তিন্ ি।  ডা. এম আর খান  এতোটুকু বিরক্ত হননি। ভীষন শ্বসকষ্টে শিশুটি কষ্ট পাচ্ছিল। ডা. খান প্রেসক্রিপসন লিখে দিয়ে তাকে বলেন ‘ আমি না হয় দেখলাম । কিন্তু এতো রাতে কারফিউয়ের মধ্যে ওষুধ পাবেন কোথায়’। উত্তরে তিনি বলেন আপনার মতো একইভাবে কোনো ফার্মেসীওয়ালাকে জাগিয়ে তুলবো’। ডা. এমআর খান এ নিয়ে ভাবনায় পড়লেন। বললেন যারা গরিব তারা কি পারবেন এভাবে একজন ডাক্তারের সহায়তা নিতে। এই প্রশ্নের মধ্য দিয়ে তিনি গড়ে তোলেন বেগম সুফিয়া কামালের দেওয়া নাম ‘ নিবেদিতা হাসপাতাল’। যেখানে থাকবেন নিবেদিত প্রাণ ডাক্তার ও নিবেদিত প্রাণ নার্সরা। সাতক্ষীরায় শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে তিনি সর্বস্তরের মানুষের ভালবাসা পেয়েছেন। কারণ তিনি শিশু চিকিৎসার পথ উন্¥োচন করে গেছেন। সাতক্ষীরায় এলে  শিশু হাসপাতালে একবার যেতেই হাজারো রোগীর ভিড় হতো।সবাই জানেন ডা. অএমআর খান শিশুটিকে স্পর্শ করলেই সে সুস্থ হয়ে যাবে।  সেই দিনগুলি আর আমাদের মাঝে ফিরে আসবে না কোনোদিন। ডা.এমআর খান একটি জীবন্ত কিংবদন্তী। একটি ইতিহাস। জীবনের ৮৮ টি বছর যিনি পার করেছেন  শিক্ষা গ্রহন এবং  শিক্ষা ও সেবা দিয়েই। সহৃদয় ,মিষ্টভাষী, সদালাপী, সমাজহিতৈষী, শিশুবান্ধব এই মানুষটি তার সততা, একনিষ্ঠতা, উদারতা, আত্মবিশ্বাস, অধ্যবসায় ও নিরন্তর সাধনা দিয়ে মানব সেবায় ব্রতী ছিলেন জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত। তিনি আজ লোকান্তরিত। তার বিকল্প কেবল তিনিই , এই বিশ্বাস নিয়েই তার স্মৃতি ও তার শিক্ষা গ্রহনই আমাদের পাথেয়। ২০১৫ সালের আগস্টে তিনি সাতক্ষীরায় মাদক বিরোধী এক মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বলেছিলেন মাদক শিশুদের  শত্র”। সবার শত্র”। আপনার শিশু রক্ষায় মাদককে চিরতরে নির্বাসন দিন। আর ১৯৮৮ সালে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে শুনিয়েছিলেন আরেক পরামর্শ। খাবার মেন্যুতে কমন থাকবে শাক, সবজি ,  ডাল, আর  ছোট মাছ । ডা. এমআর খানের মতো বিজ্ঞজনের এই পারামর্শ আমাদের জীবনকে সুস্থ থাকতে সহায়তা করবে। আর শিশুদের প্রতি ভালোবাসা ও তাদের সুরক্ষার পরামর্শ দিয়ে  এই শিশু বান্ধব  বুঝিয়েছেন সুস্থ শিশু , সুস্থ জাতি আমাদের সুখ শান্তি আর প্রগতির প্রধান দিক নির্দেশক। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের কবিতার কয়েকটি লাইন দিয়ে তিনি শেষ করেছেন তার ‘জীবনের জলছবি’। ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ণ এই বাটে, আমি বাইবোনা, আমি বাইবোনা মোর খেয়া তরী এই ঘাটে। ——-  তখন আমায় নাই বা মনে রাখলে, তারার পানে চেয়ে চেয়ে, নাই বা আমায় ডাকলে’ । লেখক: সাতক্ষীরা প্রতিনিধি, দৈনিক যুগান্তর ও এনটিভি