দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলসহ মিত্রদের ছেড়ে দেওয়া আসনগুলো ফিরে পেতে তৎপর আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারা। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হলে মিত্র দলগুলোর প্রার্থীরা বিএনপির কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হবেন—এই যুক্তিতে তাঁরা কিছু আসন ফিরে পেতে চান। এ নিয়ে দলের শীর্ষ পর্যায়ে জোর লবিং বা তদবির করছেন সংশ্লিষ্ট আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারা। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরাও মনে করছেন, বিএনপি এলে নির্বাচন হবে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। সে ক্ষেত্রে ৫ জানুয়ারির মতো মিত্রদের ঢালাওভাবে আসন ছেড়ে দেওয়া হবে না। এবার আসনওয়ারি যোগ্য প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হবে। আওয়ামী লীগসহ সংশ্লিষ্ট দলগুলোর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র মতে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, মিত্র দলগুলোর এমপিদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মী ও মনোনয়নপ্রত্যাশীদের দূরত্ব ততই বাড়ছে। এর প্রভাব আগামী নির্বাচনে পড়বে বলেও আশঙ্কা উভয় পক্ষের। বর্তমান জাতীয় সংসদে ৩০০ আসনের মধ্যে ৫০টিতে জাপা ও ১৪ দলসহ মিত্রদের প্রতিনিধি রয়েছেন। এর মধ্যে জাপা ৩৪, ওয়ার্কার্স পার্টি ৬, জাসদ ৫, জাতীয় পার্টি (জেপি) ২, বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন ২ এবং বিএনএফের ১টি আসন রয়েছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, ১৪ দলের মুখপাত্র ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘প্রথমত দেখতে হবে নির্বাচনটা কেমন হবে। বিএনপি এলে এক রকম আর না এলে আরেক রকম নির্বাচন হবে। তবে এবার আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে আসনওয়ারি শক্তিশালী প্রার্থী মনোনীত করা। যদি কোনো আসনে ১৪ দলের শরিকদের শক্তিশালী প্রার্থী থাকে তাহলে তিনি মনোনয়ন পাবেন। অবস্থান ভালো না হলে পাবেন না।’ জাতীয় পার্টির প্রশ্নে তিনি জানান, এবারের নির্বাচনে এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টি এককভাবে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, ‘যাঁরা রাজনীতি করেন তাঁরা দলের কাছে মনোনয়ন চাইতেই পারেন। জাতীয় পার্টি একটি জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক দল। তার ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার সক্ষমতা আছে। প্রস্তুতিও রয়েছে। নির্বাচনটা কিভাবে হবে, জোটবদ্ধ না এককভাবে সেটা পরিস্থিতি বলে দেবে।’ তবে তার ধারণা সব দলের অংশগ্রহণে আগামী নির্বাচন জোটবদ্ধভাবেই হবে।
ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও রাজশাহী সদর আসনের এমপি ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, দলের একক সিদ্ধান্ত অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। জোটের রাজনীতি আদর্শিক ও দেশের বৃহত্তর স্বার্থেই হয়ে থাকে। তাই নির্বাচনী জোটে সব সময় দলের শক্তি বিবেচনায় নেওয়া মুখ্য নয়। তিনি দাবি করেন, তাঁর দলের এমপিরা সরকারের উন্নয়নকাজ বাস্তবায়নসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে বিশ্বস্ততার পরিচয় দিয়েছেন। মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে এটা বিবেচনায় আসা উচিত।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বগুড়া-৬ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন জাতীয় পার্টির নুরুল ইসলাম ওমর। এবার এ আসনে দলীয় মনোনয়ন লাভের আশায় তৎপর আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা। তাঁরা হলেন জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মমতাজ উদ্দিন, কেন্দ্রীয় উপকমিটির সহসম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন শফিক, বগুড়া পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান রেজাউল করিম মন্টু প্রমুখ।
ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি সাখাওয়াত হোসেন শফিক বলেন, দলের বৃহৎ স্বার্থে এ আসনটি ফিরিয়ে নেওয়া দরকার। তিনি বলেন, স্থানীয় এমপি জাতীয় পার্টির হওয়ায় তাঁর সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সম্পর্ক নেই। তাই দলের নেতাকর্মীদের আশা, বগুড়া আর আওয়ামী লীগের হাতছাড়া হয়ে না থাকুক।
এ বিষয়ে সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম ওমর বলেন, ‘তাঁরা ভিন্ন দল করেন, তাঁরা তাঁদের দল আওয়ামী লীগের কাছে দাবিও জানাতে পারে। তবে আসন ভাগাভাগির সময় এখনো আসেনি। সময় এলে দেখা যাবে।’
সাতক্ষীরা-১ আসনের এমপি ওয়ার্কার্স পার্টির মুস্তফা লুৎফু ল্লাহ। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন তালা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল ইসলাম। পরে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের কারণে তাঁকে সরে দাঁড়াতে হয়। এবার এ আসনে নুরুল ইসলাম ছাড়াও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দাবিদার সাবেক এমপি শেখ মজিবুর রহমান, প্রবীণ নেতা বি এম নজরুল ইসলাম, কলারোয়ার উপজেলা চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমেদ স্বপন প্রমুখ।
নুরুল ইসলাম বলেন, ‘বরাবরই এ আসনটি আওয়ামী লীগের। প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হলে এখানে নৌকার বিকল্প নেই। ওয়ার্কার্স পার্টির তেমন কোনো ভোট নেই এ আসনে। ওই দলের এমপি থাকায় গত চার বছরে আমরা উন্নয়নবঞ্চিত হয়েছি। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’
এ বিষয়ে স্থানীয় এমপি মুস্তফা লুৎফুল্লাহ বলেন, ‘আমরা এমপিত্ব করার জন্য রাজনীতি করি না, রাজনীতি করার জন্য এমপিত্ব করি। আওয়ামী লীগ যদি মনে করে, এ দেশে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি করার জন্য তারাই যথেষ্ট তাহলে ১৪ দল ভেঙে দিতে পারে। এতে মনোনয়ন দেওয়া নিয়ে আর কোনো সমস্যা থাকল না।’ এলাকার উন্নয়নের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি দেখিয়ে দিতে পারি কী কী উন্নয়ন হয়েছে।’
ঢাকা-৪ আসনের বর্তমান এমপি জাতীয় পার্টির সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা। নবম জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের অ্যাডভোকেট সানজিদা খানম এ আসনের এমপি ছিলেন। সানজিদা খানম ছাড়াও এবার এ আসনে আওয়ামী লীগের শক্তিশালী মনোনয়নপ্রত্যাশী আওয়ামী লীগ সভাপতির সাবেক এপিএস ড. আওলাদ হোসেন। তিনি বলেন, এ আসনটি অত্যন্ত অবহেলিত। শ্যামপুর ও কদমতলী নিয়ে গঠিত এই নির্বাচনী এলাকায় শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা বলে কোনো কথা নেই, সব সময় জলাবদ্ধতা লেগেই থাকে। বর্তমান এমপি এলাকার কোনো উন্নয়ন করেননি। এ দুই থানার মানুষের চিকিৎসার জন্য একটা ক্লিনিক পর্যন্ত নেই। ড. আওলাদ হোসেন বলেন, ‘আবার জোটের প্রার্থী দিলে আমরা জনগণের কাছে যেতে পারব না। তাই এর পুনরাবৃত্তি চাই না।’
স্থানীয় সংসদ সদস্য সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা দাবি করেন, স্বাধীনতার পর এ অঞ্চলের সবচেয়ে বেশি উন্নয়ন তিনি করেছেন। তিনি বলেন, ‘সাড়ে তিন শ এমপির মধ্যে একমাত্র আমি এলাকায় সমবণ্টন করে কাজ করে আসছি। ৫০০ কম্বল পেলে আগে আওয়ামী লীগের কর্মীদের ২৫০ দিয়ে থাকি। অতএব আমার বিরুদ্ধে করা অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।’
ময়মনসিং-৭ আসনের এমপি জাতীয় পার্টির এম এ হান্নান মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে কারাগারে আছেন। এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চান সাবেক এমপি রুহুল আমিন মাদানী ও রেজা আলী। রুহুল আমিন মাদানী বলেন, ‘আসনটি সব সময় আওয়ামী লীগের। এখানে জাতীয় পার্টি তৃতীয় অবস্থানেও নেই। তাই আসনটি আওয়ামী লীগেরই থাকা উচিত।’
পঞ্চগড়-১ আসনের বর্তমান এমপি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল—জাসদের (আম্বিয়া) সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান। এ আসনে ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের মজাহারুল হক প্রধান। তিনি বলেন, ‘আসনটি আওয়ামী লীগের। জোটের কারণে এবং আমার নেত্রীর নির্দেশে গতবার ছাড় দিয়েছি। এবার ছাড় দেওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না।’
এমপি নাজমুল হক প্রধান বলেন, ‘আমরা জোটের শরিক দল। তাই জোটবদ্ধ নির্বাচন হলে সিট দাবি করব। সে ক্ষেত্রে জোট হলে ভালো। না হলে যেহেতু রাজনীতি করি এবং বর্তমানে এমপি তাই আমাকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতেই হবে।’ সূত্র: কালের কণ্ঠ।