নিজস্ব প্রতিবেদক: লাবসা ইউপিতে হরিলুটের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল আলীম জনগণের বিশ্বাসকে পুঁজি করে ইউনিয়নের লক্ষ লক্ষ টাকা তছরূপ করছেন বলে জানা গেছে। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, লাবসা ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল আলিম দীর্ঘদিন অত্র ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। প্রতিবার নির্বাচনের আগ মুহুর্তে ইউনিয়নের সাধারণ মানুষের গা, মাথায় হাত বুলিয়ে ইউনিয়নের বিভিন্ন উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে টানা কয়েকবার নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। কিন্তু নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর তিনি প্রতিশ্রুতি ভুলে মেতে উঠেন ইউনিয়নের লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাতে। তার এ অপকর্মে যাতে কোন ইউপি সদস্য প্রতিবাদ না করে সে কারণে কৌশলে তাদেরকে ম্যানেজ করে সুচতুর চেয়ারম্যান আব্দুল আলিম। এরপরও কেউ বিরোধিতা করলে তাকে ইউনিয়নের প্রকল্পের কাজ থেকে বঞ্চিত করা হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, লাবসা ইউনিয়নের আওতাধীন বিনেরপোতা হাট ইজারা হতে ৪৬% পায় ইউনিয়ন পরিষদ। এতে করে ইউনিয়ন পরিষদের কোষাগারে প্রতিবছর একটি বড় অংকের অর্থ জমা হয়। তবে চলতি বাংলা ১৪২৪ সালে বিগত দিনের সকল রেকর্ড ভেঙে ভ্যাট ট্যাক্স দিয়ে প্রায় ১ কোটি টাকায় ইজারা দেওয়া হয় বিনেরপোতা হাট। উপজেলা পরিষদের নিয়ম অনুযায়ী মোট টাকার ৪৬% লাবসা ইউপিতে দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী এবার বিনেরপোতা হাট থেকে ইউনিয়ন পরিষদ পায় ৩৭ লক্ষ ২৮ হাজার ৭২৩ টাকা। যা ইউনিয়ন পরিষদের আর্থিক বিধি বিধান অনুযায়ী ব্যয় করার কথা থাকলেও সেখানে এ নিয়মের কোন তোয়াক্কা করা হয়নি। বিভিন্ন ভূয়া প্রকল্প দেখিয়ে, একই কাজ বার বার দেখিয়ে এবং ভুয়া রেজুলেশন করে গত ১৩ জুন ২৩২৪০৭৪ নং চেকে উক্ত ৩৭ লক্ষ ২৮ হাজার ৭২৩ টাকা উত্তোলন করেন ইউপি চেয়াম্যান আব্দুল আলিম ও ইউপি সচিব আব্দুর রাজ্জাক। অথচ সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, উক্ত টাকার কোন প্রকল্পই বাস্তবে রূপ পায়নি। পুরো টাকাটাই ইউপি চেয়ারম্যান ইউপি সচিব আব্দুর রাজ্জাকের সহযোগিতায় পকেটস্থ করেছেন বলে ইউনিয়ন পরিষদ সূত্রে জানা গেছে। এছাড়া সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় অবস্থিত হাট বাজারের ইজারা থেকে সদরের ১৪টি ইউনিয়নের হাট বাজার সংস্কার বাবদ ১৫% টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় সদর উপজেলার নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় থেকে। সে অনুযায়ী লাবসা ইউনিয়ন পরিষদ ১৫% হিসাবে বিনেরপোতা হাট সংস্কারের জন্য ১২ লক্ষ ১৫ হাজার ৮৮৮ টাকা বরাদ্দ পান। উক্ত বরাদ্দ পত্রে মোট ৭টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করার জন্য এ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রকল্পগুলো হচ্ছে বিনেরপোতা হাটের কাপেটিং রাস্তা হতে ছোট’র আড়ৎ পর্যন্ত রাস্তা কংক্রিট ঢালাই নির্মাণের জন্য ১লক্ষ ৮৪ হাজার টাকা, বিনেরপোতা হাটের ছোট’র আড়ৎ হতে অজিত বাবুর আড়ৎ পর্যন্ত কংক্রিট ঢালাই নির্মাণ ১লক্ষ ৮৪ হাজার টাকা, বিনেরপোতা হাটের অজিত বাবুর আড়ৎ হতে অতিষের আড়ৎ পর্যন্ত রাস্তা কংক্রিট ঢালাই নির্মাণ ১লক্ষ ৮৪ হাজার টাকা, বিনেরপোতা হাটের অতিষের আড়ৎ হতে তপন বাবুর আড়ৎ পর্যন্ত রাস্তা কংক্রিট ঢালাই নির্মাণ ১ লক্ষ ৭৯ হাজার ৮৮৮ টাকা, ৫. বিনেরপোতা হাটের কণ্ঠ’র আড়ৎ হতে লিয়াকতের আড়ৎ পর্যন্ত রাস্তা কংক্রিট ঢালাই নির্মান ১লক্ষ ৮৪ হাজার টাকা, বিনেরপোতা হাটের তপন বাবুর আড়ৎ হতে সাতক্ষীরা ফিস পর্যন্ত রাস্তা কংক্রিট ঢালাই নির্মান ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা ও বিনেরপোতা হাটের সাতক্ষীরা ফিস হতে মিজানের আড়ৎ পর্যন্ত রাস্তা কংক্রিট ঢালাই নির্মাণ ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। উক্তসব প্রকল্প বাস্তবায়নের শর্ত সাপেক্ষে গত ০৫ ডিসেম্বর ’১৭ তারিখে ২৮৭৭৭১৫ নং চেকে ১২লক্ষ ১৫ হাজার ৮৮৮ টাকা উত্তোলন করেন ইউপি চেয়ারম্যান। অথচ টাকা উত্তোলনের ২ থেকে আড়াই মাস অতিবাহিত হলেও বিনেরপোতা হাটে ৭টি প্রকল্পের একটিও বাস্তবায়ন করা হয়নি। হাটের সাধারণ ব্যবসায়ীরা মনে করছেন উক্ত প্রকল্প আদৌ বাস্তবায়ন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে প্রকল্পের নামে টাকাগুলো ইউপি চেয়ারম্যান ও তার দোসরেদে পকেটে যাবে বলে তাদের ধারণা। ইতোপূর্বে হাটের সংস্কারের জন্য একাধিক বরাদ্দ আসলেও হাটের ভাগ্যে তার ছিটে ফোঁটাও জোটেনি। হাটের জরাজীর্ণ পরিবেশে ব্যবসায়ীরা হতাশ হয়ে পড়লে বাজার কমিটির নিজস্ব অর্থায়নে কিছুটা সংস্কার করা হয়েছে। এছাড়া বাজারের ব্যবসায়ীরা নিজ খরচে স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের সামনে সংস্কার করেছেন। এখানে ইউনিয়নের কোন ভূমিকা বিগত কয়েক বছরে পরিলক্ষিত হয়নি। এবিষয়ে বিনেরপোতা বাজারের সততা ফিসের মালিক রামপদ মন্ডল বলেন, প্রতি বছর এখানে থেকে অনেক টাকা ইউনিয়ন পরিষদ পেয়ে থাকে। কিন্তু বিগত ৩/৪ বছরের মধ্যে এ হাটের উন্নয়ন বা সংস্কার করা হয়নি। যেটুকু করা হয়েছে তা বাজার কমিটিই করেছে। হাট বাজারের স্বপন ফিসের মালিক প্রভাষ মন্ডল, আলী ফিসের মালিক হারুন অর রশিদ, রাসেল ফিসের মালিক ভক্ত মন্ডল ও বেতনা ফিসের মালিক গোবিন্দ একই কথা বলেন। তারা বলেন, এবাজার ইজারা দিয়ে সরকার প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করে। কিন্তু বাজারের সংস্কারের জন্য কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় না। মাঝে মধ্যে কানে আসে বাজারের সংস্কারের জন্য বরাদ্দ এসেছে, কাজ হবে। কিন্তু তা আর হয় না। যে কারণে বাজার কমিটির ফান্ড হতে বাজারের কিছু অংশ সিসি ঢালাই করা হয়েছে। এবারো নাকি ১২ লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয়েছে। দ্রুত কাজ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও কি কারণে হচ্ছে সেটি জানা নেই তবে। এবার যদি বাজারের কাজ না হয় তাহলে আমরা কঠোর আন্দোলনে যাবো। লাবসা ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের মেম্বর ও বিনেরপোতা বাজার কমিটির সভাপতি রাম প্রসাদ মন্ডল বলেন, বাজার কমিটির পক্ষ থেকে সপ্তাহে দুইবার ধোয়া হয় বাজার পরিস্কার রাখার জন। এছাড়া এবার বাজারের উন্নয়নে ১২ লক্ষ টাকা বরাদ্দ পেয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ। আগামী ১০/১৫ দিনের মধ্যে কাজ শুরু হবে। ৩৭ লক্ষ টাকার বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। লাবসা ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের মেম্বর আবু সাঈদ বলেন, ৩৭লক্ষ টাকার বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। চেয়ারম্যান কোথায় কিভাবে খরচ করেছে সেটি চেয়ারম্যান জানেন। মেম্বর আছাদুজ্জামান আছাদ বলেন টাকা কোথায় কিভাবে খরচ করেছে সেটি চেয়ারম্যান জানেন। আমাদের জানানেই। তবে শুনেছি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। আমরা শুনেছি টাকা উত্তোলনও হয়েছে। মেম্বর মনিরুল বলেন, “উক্ত টাকার কাজ হয়েছে।” কিন্তু কোথায় কত টাকার কাজ হয়েছে তিনি তা বলতে পারেননি। ১, ২ ও ৩নং ওয়ার্ডে মহিলা মেম্বর মাছুদার সাথে যোগাযোগ করলে ৩৭ লক্ষ টাকা কোথায় খরচ হয়েছে এমন প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে তিনি মোবাইলের সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করে দেন। এ ঘটনায় লাবসা ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান গোলাম কিবরিয়া বাবু বলেন, “আমার জানা মতে ১২ লক্ষ ও ৩৭ লক্ষ টাকার কোন কাজ হয়নি। তবে শুনেছি ১২ লক্ষ টাকার কাজ করা হবে। এছাড়া জনগণের টাকা কেউ আত্মসাৎ করবে সেটা হবে না। জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার উন্নয়নের সরকার। সেই সরকারের টাকা নিয়ে ইউনিয়নের উন্নয়ন না করে পকেটস্থ করতে দেওয়া হবে না।”
এঘটনায় ইউপি সচিব আব্দুর রাজ্জাকের সাথে যোগাযোগ করার জন্য তার ব্যবহৃত ০১৭১৬ ৮৪৩৭৬৫ ও ০১৭৩৩ ০৭৩৮৬২ নাম্বারে শনিবার বিকাল ৪:৩৮ টায় কয়েকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ না করায় তা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল আলিমের সাথে কথা বলার জন্য তার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ৩৭ লক্ষ টাকার কাজ তো হয়েছে। ইউনিয়নের ৩ টি কাঁচা রাস্তা সংস্কার করেছি এবং সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী খরচ করা হয়েছে। যা ইউনিয়নের প্রতিটি মেম্বর জানেন। এছাড়া বিনেরপোতা হাটে ১২ লক্ষ টাকার কাজ দ্রুত করা হবে। উল্লেখ্য, ইউপি চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আলীমের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতনের অভিযোগও রয়েছে। বিগত ২০০৪ সালে চার দলীয় জোট সরকারের সময় ইউনিয়নের মাগুরা গ্রামের নিতাই মুহুরীকে নির্যাতন করে তাকে স্বপরিবারে উচ্ছেদ করেছিলেন তিনি। এঘটনায় ভূমিহীন নেতা সাইফুল্লাহ লস্কারের নেতৃত্বে আন্দোলন সংগ্রাম চালাতে থাকে। কিন্তু সাইফুল্লাহ লস্কর ২০০৯ সালের ৫ ডিসেম্বর ওই ভূমিদস্যুদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। । যে কারণে ওই আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। এদিকে, ইউপি চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল আলিমসহ তার দোসরদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জন্য খুলনা বিভাগীয় কমিশনার, দুর্নীতিদমন কমিশন ও সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন সচেতন ইউনিয়নবাসী।