অনলাইন ডেস্ক: সুন্দরবনে এক থেকে দেড় হাজার বছরের পুরোনো মানববসতির নিদর্শন পাওয়া গেছে। নিদর্শনটি আবিষ্কৃত হয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম এই শ্বাসমূলীয় অরণ্যের পাঁচটি জায়গায়। হাজার বছর আগে ব্যবহৃত মানুষের বিচিত্র ব্যবহার্য সামগ্রীও পাওয়া গেছে বনের নানা স্থান থেকে। ইসমে আজম নামে এক গবেষকের ব্যক্তিগত ও একাগ্র অনুসন্ধানে এসব নিদর্শন উদ্ঘাটিত হয়েছে।
• খেজুরদানা, আড়পাঙ্গাশিয়া ও শেখেরটেকে সবচেয়ে বড় স্থাপনাগুলোর সন্ধান। • আরও কিছু স্থাপনার খোঁজ খোলপটুয়া নদীতীরে এবং খুলনা অংশের কটকায়। • স্থানগুলো কমপক্ষে এক হাজার থেকে বারো শ বছরের পুরোনো বলে ধারণা। • স্থাপনাগুলোতে ব্যবহৃত ইটের বৈশিষ্ট্য ও স্থাপনারীতি পাল আমলের। • বনের গভীরে বসতির চিহ্ন।
সুন্দরবনের সাতক্ষীরার শ্যামনগর অংশ থেকে নদীপথে ৮৩ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগর উপকূলের খেজুরদানা, আড়পাঙ্গাশিয়া ও শেখেরটেকে সন্ধান পাওয়া গেছে সবচেয়ে বড় স্থাপনাগুলোর। আরও কিছু স্থাপনার খোঁজ মিলেছে সুন্দরবনের সাতক্ষীরা অংশের খোলপটুয়া নদীতীরে এবং খুলনা অংশের কটকায়। ঢেউয়ের তোড়ে নদীর পাড় ভেঙে মাটির আস্তরণ সরে যাওয়ায় পুরোনো এসব স্থাপনা বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে।
এর আগেও সুন্দরবনে প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের ১৯৯৮ সালের জরিপ এবং বন বিভাগ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও মালয়েশিয়ার তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপে কিছু স্থাপনার খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক হুমায়ূন আখতার এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক বদরুল ইসলামের গবেষণার বিষয় সুন্দরবনের ভূতাত্ত্বিক গঠন এবং বিলুপ্ত লবণশিল্প। তাঁদের গবেষণায়ও বেশ কিছু পুরোনো স্থাপনা ও নিদর্শনের সন্ধান পাওয়া যায়। তবে সেসব গবেষণা ও জরিপে সুন্দরবনের প্রাচীন কিছু স্থাপনা চিহ্নিত করা হলেও সেগুলোর সময়কাল এবং সেগুলো ব্যবহারের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়নি। সেখানে মানববসতির তথ্যও কেউ দেয়নি।
সুন্দরবনের ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তন এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি নিয়ে গবেষণায় যুক্ত জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষক দল সেখানে হাজার বছরের পুরোনো লবণ উৎপাদননির্ভর একটি বড় শিল্পনগরী ও বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল বলে অনুমান করছে। একটি বন্দরের আভাসও তারা পেয়েছে।
কতটা প্রাচীন সুন্দরবনে পাওয়া প্রাচীন স্থাপনাগুলো নিয়ে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে যোগ দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক উয়ারী-বটেশ্বরখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান ও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুহাম্মদ সোহরাবউদ্দীন। তাঁদের ধারণা, স্থানগুলো কমপক্ষে এক হাজার থেকে বারো শ বছরের পুরোনো। স্থাপনাগুলো পর্যবেক্ষণ এবং সেসবের শৈলী বিশ্লেষণ করে সুফি মোস্তাফিজুর রহমান ধারণা করেন, এগুলোতে ব্যবহৃত ইটের বৈশিষ্ট্য ও স্থাপনারীতি পাল আমলের। সে হিসেবে স্থাপনাগুলো আনুমানিক এক হাজার থেকে বারো শ বছর আগের তৈরি। বাণিজ্য ও শিল্পের কাজে এসব স্থাপনা তৈরি হলেও সেখানে স্থায়ী মানববসতি ছিল বলে তাঁর অনুমান।
বাঘ গণনা ও সংরক্ষণের কাজে সুন্দরবনের দুর্গম অঞ্চলে ইসমে আজমের যাতায়াত সাত বছর ধরে। কাজ করতে গিয়ে বনের মধ্যে তিনি এসব ভগ্নস্তূপ ও মানুষের ব্যবহার্য সামগ্রী দেখতে পান। পরে সুন্দরবনের পাড় ভেঙে গেলে এবং মাটির ওপরের স্তর সরে গেলে বেরিয়ে আসা স্থাপনাগুলো তাঁর চোখে পড়ে। প্রত্নতাত্ত্বিকের মতো কৌতূহলে তিনি ব্যবহার্য সামগ্রীগুলো সংরক্ষণ করেন। এসব নিদর্শন ও স্থাপনার তথ্য-উপাত্তও সংগ্রহ করতে থাকেন।
সাতক্ষীরার শ্যামনগরের পাশ থেকেই ভারতীয় সুন্দরবনের সীমানার শুরু। গত জানুয়ারি মাসে এই প্রতিবেদক ভারতীয় সুন্দরবনের সাগর দ্বীপ, মৌসুনী দ্বীপ ও হ্যামিলটন দ্বীপের প্রাচীন স্থাপনা দেখতে পান। ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিকেরা মনে করেন, সেগুলো এক থেকে আড়াই হাজার বছর আগেকার। খ্রিষ্টপূর্বকালে বাংলা অঞ্চলে গড়ে ওঠা গঙ্গাঋদ্ধি রাজ্য সুন্দরবন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বলে ভারতীয় ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের ধারণা। তাঁদের মতে, সাতক্ষীরা অঞ্চলটি ছিল ওই রাজ্যের বন্দর ও বাণিজ্য এলাকা।
ভারতীয় সুন্দরবনের প্রত্নগবেষক ও ভারতের সেন্টার ফর আর্কিওলজিক্যাল স্টাডিজ অ্যান্ড ট্রেনিংয়ের (পূর্ব ভারত) জ্যেষ্ঠ ফেলো ড. শর্মি চক্রবর্তীর সঙ্গে এ নিয়ে প্রথম আলোর কথা হয়। বাংলাদেশ অংশের সুন্দরবনের প্রত্নস্থাপনা ও সামগ্রীর তথ্য ও ছবি পর্যালোচনা করে তিনি বলেন, ভারতীয় সুন্দরবনের প্রত্ননিদর্শনের সঙ্গে এর মিল আছে। তাঁর ধারণা, চতুর্ভুজ স্থাপনা ও ঘাটলার মতো জায়গাগুলোর বয়স ৬০০ থেকে ৭০০ খ্রিষ্টাব্দ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। অন্যান্য প্রত্ননিদর্শন ও সামগ্রী মধ্যযুগের। তবে সামগ্রিকভাবে সুন্দরবনে মানববসতির বয়স অন্তত দেড় হাজার বছর।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আরেক অধ্যাপক স্বাধীন সেন বাংলাদেশের নদীর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের গবেষক। তাঁরও ধারণা, এসব স্থাপনা ও ব্যবহার্য সামগ্রী এক হাজার থেকে বারো শ বছর আগেকার। বাণিজ্য ও লবণ উৎপাদনের কাজে বিভিন্ন সময়ে সেখানে মানববসতি গড়ে উঠেছিল বলে তিনি মনে করেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বহিঃশত্রুর আক্রমণে বারবার তা ধসে পড়েছে, আবার গড়ে উঠেছে।
গত ২৩ জানুয়ারি ভোরে প্রথম আলোর উদ্যোগে সুন্দরবনে সাত সদস্যের দলটির অনুসন্ধানী যাত্রা শুরু। সাতক্ষীরার শ্যামনগর থেকে সূর্যোদয়ের খানিক আগে রওনা দিল স্পিডবোট। ৮৩ কিলোমিটার নদীপথ পাড়ি দিলে সেই স্থাপনা। কিন্তু ডাঙায় ভেড়ার আগেই শক্ত কিছুতে আটকে গেল স্পিডবোট। চোখে পড়ল দূরে বনের কোল ঘেঁষে পড়ে থাকা ইটের স্তূপে।
বনের এ দুর্গম অংশে মানুষের বসতি নেই। শৌখিন প্রত্নতাত্ত্বিক ইসমে আজমের নির্দেশে তীরে নামলেন সবাই। পায়ের তলাতেই ঠেকল ইটের সারি। সে পথ ধরে এগোতে হলো আরও প্রায় ২০০ মিটার।
অবশেষে পৌঁছানো গেল ওই স্তূপাকার ইটের কাছে। উত্তেজনার রেশ কাটিয়ে সুফি মোস্তাফিজ ও সোহরাবউদ্দীন মগ্ন হয়ে পড়লেন ইটের স্তূপের রহস্য ভেদ করার কাজে। সরানো হলো ওপরে জমে থাকা ভাঙা ইট আর গাছের শিকড়বাকড়। সেসব সরাতেই বেরিয়ে এল চাপা পড়ে থাকা কোনো কক্ষের ছাদের মতো চতুর্ভুজ কাঠামো। ইটের মাপ নিলেন সোহরাব আর ইসমে আজম। হাতে ইট নিয়ে তার বৈশিষ্ট্য ও আকার বিশ্লেষণ করে সুফি মোস্তাফিজ বললেন, ৩২ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য আর ২৮ ইঞ্চি প্রস্থের এ-জাতীয় ইট সর্বশেষ ব্যবহৃত হয়েছে পাল আমলে। সে হিসাবে স্থাপনাটির বয়স অন্তত এক হাজার থেকে বারো শ বছরের পুরোনো। তিনি আরও বললেন, ‘স্থাপনাটির নির্মাণশৈলী দেখে বোঝা যাচ্ছে, এখানে স্থায়ী মানববসতি ছিল।’
ইটের স্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে চোখে পড়ল ৫০ থেকে ৮০ মিটার পরপর অভিন্ন বৈশিষ্ট্যের আরও দুটি স্থাপনা। পিচ্ছিল পথ ধরে পৌঁছানো গেল সেখানে। কিছু ইট সরানোর পর এখানেও পাওয়া গেল একই ধাঁচের ইটের কাঠামো। ইসমে আজম জানালেন, আরও চার-পাঁচটি এ-জাতীয় স্থাপনা এখানে আছে। সব মিলিয়ে পুরো এলাকার আয়তন হবে প্রায় পাঁচ বর্গকিলোমিটার। সাত বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানালেন, এলাকাটি আগে ছিল বনভূমি। পাঁচ-ছয় বছর ধরে ভূমির ক্ষয় ও ভাঙনে মাটির নিচ থেকে কাঠামো বেরিয়ে আসছে। খোলপটুয়া নদীর ধারেও বেরিয়ে এসেছে আরেকটি ইটের কাঠামো। তাঁর অনুমান, সেটি প্রাচীন সময়ের কোনো সমুদ্রবন্দর। কালের প্রহারে বিধ্বস্ত হয়েছে।
বন্দর আকৃতির ওই স্থাপনায় স্পিডবোটে চেপে যেতে লাগল আধঘণ্টা। এখানকার ইটের বৈশিষ্ট্য দেখেও সুফি মোস্তাফিজ মত দিলেন, স্থাপনাটির বয়স এক হাজার থেকে বারো শ বছর। পুরোনো গবেষণার অভিজ্ঞতার সূত্র ধরে তিনি বললেন, পাল, সেন, সুলতানি ও মোগল আমলে ব্যবহৃত ইটের পার্থক্য খুব সুনির্দিষ্ট। পাল আমলের ইট বড় পাটা আকৃতির। যত সময় গেছে, ইটের আকার ক্রমেই ছোট ও সরু হয়েছে। পাল আমলের পর এই আকারের ইট আর ব্যবহৃত হয়নি।
শুধু প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতামতের ভিত্তিতে কি একটি এলাকাকে হাজার বছরের পুরোনো বলা আদৌ সম্ভব? এ প্রশ্নের উত্তর দিলেন সোহরাবউদ্দীন। সুন্দরবনের ভূতাত্ত্বিক গঠন ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে জার্মানির ব্রেম্যান বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় তিনি জড়িত ছিলেন। বললেন, সুন্দরবনের কটকায় তাঁরা বেশ কিছু প্রাচীন লবণ তৈরির চুল্লি ও পাত্র পেয়েছেন। জার্মানির গবেষক দলটি কার্বন ও তাপমাত্রা পরীক্ষা করে সেগুলোর বয়স সুনির্দিষ্টভাবে বের করেছে। ওই গবেষণায় বাংলাদেশ অংশের দলনেতা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক হুমায়ূন আখতার। তাঁর গবেষণায় দেখা গেছে, কটকার লবণ কারখানাগুলোর মধ্যে তিনটির বয়স ২৫০ থেকে ৩০০ বছর, দুটির ৬০০ বছর এবং একটির এক হাজার বছর।
কটকায় এই গবেষকেরা টাইগার হিল নামের একটা ঢিবি খুঁজে পেয়েছিলেন। তাতে পানি পরিশোধনের ছাঁকনি ও বর্জিত পানি নিষ্কাশনের নালা ছিল। তাঁদের ধারণা, সেটি ছিল উন্নত প্রযুক্তির লবণ কারখানা। ২৫০ থেকে এক হাজার বছর আগে সেখানে উৎপাদিত লবণ পূর্ব এশিয়া ও ইউরোপে রপ্তানি হতো। হুমায়ূন আখতার আরও ব্যাখ্যা করে বললেন, ‘আমরা ধারণা করছি, এখন যেখানে সুন্দরবন, সেখানে একসময় লবণ তৈরির বিশাল কারখানা ছিল। অন্তত এক হাজার বছর আগে থেকে এই লবণ তো আশপাশের কোনো বন্দর থেকেই রপ্তানি হতো। খেজুরদানাসহ আশপাশের এলাকা সম্ভবত সেই প্রাচীন বন্দরের ধ্বংসাবশেষ।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক বদরুল ইসলাম এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, হাজার বছর আগে থেকে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকাজুড়ে উন্নত মানের লবণ তৈরি হতো। সমুদ্র দূরে সরে যাওয়া, ভূমি দেবে যাওয়া এবং দীর্ঘ সময়জুড়ে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে সেটি ধ্বংস হয়ে গিয়ে থাকতে পারে। শত শত বছর ধরে তার ওপর পলি পড়েছে। ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে সুন্দরবন।
এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কার হওয়ার ঘটনাটিকে বাংলাদেশের ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়ের উন্মোচন বলে মনে করছেন সুফি মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘ওই স্থাপনাগুলো নিয়ে আরও গভীরতর গবেষণা হলে সুন্দরবন এবং এই এলাকার ইতিহাস সম্পর্কে অনেক চমক লাগানো তথ্য হয়তো আমরা পাব।’ তিনি আরও বলেন, ‘পশ্চিমা ইতিহাসে খ্রিষ্টপূর্বাব্দ কাল থেকে বাংলা একটি সমৃদ্ধ সভ্যতার নিদর্শন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। হাজার বছর আগের লবণ চাষ, সমুদ্রতীরে প্রাচীন বসতি হয়তো সেই পরিচয়কে আরও স্পষ্ট করে তুলবে।’
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮।