মানুষ এখনও পৃথিবীর সম্পদ নয়
স ম তুহিন
অসংখ্য দ্যুতিময় ছোটোগল্প আর উপন্যাসের লেখক অমর মিত্র। থাকেন ইন্দ্র বিশ্বাস রোডে, কলকাতায়। নদী, দেশভাগ, সীমান্ত আর ছিটমহলকে প্রধান বিষয় করে না-ফেনানো গদ্যে জীবন এঁকেছেন সাবলীল। যখন কেউ বলেন বিখ্যাত নাট্যকার মনোজ মিত্রের ছোটভাই কথাশিল্পী…, তখন হালকা অহংকারের সাথে নিজের অস্তিত্বের উপস্থাপনটাও উপভোগ করেন− আড়চোখে আমি তা দেখেছি কয়েকবার।
অমর মিত্রের সাথে কিভাবে কিভাবে কেমন একটা সম্পর্কের জালে জড়িয়ে গেছি−এটাকে ঠিক কী ধরনের সম্পর্কের খাপে আটকানো যাবে তা বলতে বললে বলতে পারবো না। তবে এটুকু বলতে পারবো, অমর মিত্রের লেখনির ক্ষমতা অসাধারণ, অসাধারণ সম্মোহিত করার ক্ষমতাও।
‘কাহিনী শুরু করা খুব কঠিন কাজ, কোথায় মূল কাহিনী লুকিয়ে থাকে তা জানা আরও কঠিন…’ শুরু তবু করতেই হয়, শেষটা কোথায় কেমন হবে না জেনেও।
প্রিয় মানুষের সবকিছুই ভালো। অমরদা প্রিয় মানুষ। তার জন্মভিটে দেখতে আসার সময়টা, আমার-আমাদের সাথে প্রথম দেখার দিনটা আর কয়েকদিনের ঘুরে বেড়ানোর কথা ২৭ ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখের কলকাতার ‘আজকাল’-এর রবিবাসর সংখ্যায় ছাপা হয়। শিরোনাম ‘সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে’। পত্রিকার ভাষায় মনউচাটন সে সফরের কথা বলতে একখানে লিখেছেন−‘স্থল সীমান্ত দিয়ে না পার হলে সীমান্তের মহিমা ধরা যায় না’। সীমানা-সীমান্ত নিয়ে কত-শত কথা যে আছে অমরদার লেখায় তার সব কথা বলাও খুব, খুব কঠিন। তবু আরও একটু প্রস্তুতি নিয়ে সে কথা বলবো বলেও স্থির করেছি। বাংলাদেশ থেকে বের হবে তার নির্বাচিত ছোটগল্পের একটা সংকলন। নির্বাচন আর ভূমিকা আমাকে করতে হবে, এমন কথার পর খানিকটা বিপাকে পড়ে নিজেকে প্রস্তুত করতে হচ্ছে। লেখক অমর মিত্রের লেখালেখির বিষয়ে অন্য কোনো সময় অন্য লেখায় লম্বা করে বলবো। অমর দা নো-ম্যান্স ল্যা–কে ‘না-মানুষী ভূখ-’ বলেছেন। বাংলাতে এর আগে এমন নতুন শব্দ শুনিনি।
লেখক শিল্প-আলোচক শান্তি নাথ১-এর লেখায় আরও একটি নতুন শব্দ পেলাম ‘শূন্য রেখা’। লেখাটি আমার মন ছুঁয়ে গেছে। সীমান্তে, সীমান্তের পাশঘেঁষে এতো এতো করূণ গল্প ! আমি খানিকটা অস্থির হচ্ছি, এ অস্থিরতার রোগ যেন কাউকে পেয়ে না বসে। শান্তি নাথ- এর সমীক্ষাধর্মী ‘সীমান্তের হাটখোলা জীবন’ শিরোনামের লেখাটা অন্যদের সাথে ভাগ করে নিতে না পারলে অস্থিরতা আমাকে পুরোপুরি আচ্ছন্ন করে ফেলবে, আমি তা থেকে বের হতে চাই −
“পাকিস্তানের এক বধু, সীমান্তের পারেই তাদের বাড়ি, স্বামী আছে, শাশুড়ী আছে, বাড়িতে মুরগি আছে তারা ডিম পাড়ে, আবার ডিম ফুটে বাচ্চা হয়। কিন্তু সেই বউ কোনও বাচ্চা দিতে পারে না তার স্বামীকে, শাশুড়িকে−সেই বাচ্চাকে আদর করার জন্য। এই জন্য তার উপর চলে প্রতিনিয়ত অত্যাচার। স্বামীর মার তাকে খেতে হয়, এটা নিত্যদিনের ব্যাপার। শাশুড়ির গালাগালি আর মাঝে মাঝে গরম খুন্তির ছেঁকা খেতে হয়। রাগ হয় কিন্তু তার কোন প্রকাশ থাকতে নেই। দুঃখ হয়, নিঃশব্দে তার সারা শরীর কাঁদে। কিন্তু অন্তরের চোখের জল মুছিয়ে দেওয়ার কোনও পরিবেশই ছিল না তাদের বাড়িতে। সামান্য মুরগি বাচ্চা দিতে পারে আর একটা দামড়া মেয়ে বাচ্চা দিতে পারে না−স্বামী তাকে তালাক দেবে, আর একটা বিয়ে করবে। আর একটা বউ আসবে, আর সে হবে দু’নম্বরি বউ, এটা তার সহ্য হয়নি ; আঘাত পাওয়া সহ্য হয়েছিল, গরম খুন্তির ছেঁকা সহ্য হয়েছিল কিন্তু বাচ্চা না দিতে পারা দু’নম্বরি বউ, এটা হতে ইচ্ছে করেনি।
আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনও পথ খোলা ছিল না। নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিল। ঝাঁপ দেওয়ার সময় তার জানা ছিল না−সীমান্ত বলে একটা জটিল ব্যাপার আছে, মানুষের জন্য আছে বিষাক্ত কাঁটাতারের বেড়া। তা তার স্বামীর চেয়ে নিষ্ঠুর এবং তা অসহ্য তার শাশুড়ির অকথ্য ভষণের চেয়েও। তার বিচার পদ্ধতি আরও অমানবিক।
কিন্তু নদীর তো কোনও দেশ নেই, সে পৃথিবীর সম্পদ, মানুষ এখনও পৃথিবীর সম্পদ নয়, সে শুধু একটা সীমাবদ্ধ দেশের সম্পদ। বউটা ডুবেও মরল না, হতভাগীদের তাই হয়। মৃত্যুও নেই আবার শান্ত জীবনযাপন করার কোনও প্রকরণ নেই। নদী তাকে বাঁচিয়ে নিয়ে এস তুলল ভারত সীমান্তে। নদীর কান্না দেখা যায় না, শুধু জোয়ার আসে তার বুকে, তাই নদী স্তম্ভিত হয়ে দেখেছিল− নদীর পারেই সেই ধর্ষিতা হওয়া− এক ভারতীয় সেপাই দ্বারা। সুন্দরী যুবতী, এ ছাড়া তার গতি কী আছে। কতবার ধর্ষিতা হয়েছিল এটা তার জানা ছিল না। এই অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে কিছু মানুষ যাদের কাছে সীমানা কিংবা ভিনদেশ ইত্যাদি শব্দগুলো থাকে না তারা সেবা করেছিল কিন্তু আরও গাঢ়তর অসুস্থ হয়ে পড়েছিল সেই কন্যা। হাসপাতালে ভর্তি হলে তার দরকার হল একটা পরিচয়। সে বলেছিল, তার বাড়ি পাকিস্তানে। পাকিস্তান, ভিন দেশের নাগরিক−এই শব্দে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। তার স্থান হয় কয়েদখানায়। সেখানেও সে আবার ধর্ষিতা হয়। তার নারীত্বের প্রতি এই বঞ্চনা তাকে বড়ো যন্ত্রণা দিয়েছিল। তাই বিচারকের কাছে সব খুলে বলেছিল। বিচারক খুঁজে বার করতে বলেছিলেন, সেই ধর্ষক কে ? ইতিমধ্যে ঘটেছিল সময়ের অনেক ব্যাবধান−ধরা এবং জেলে থাকা, বিচার পদ্ধতির ভিতরে আসা, তার ভিতর এসে যায় এই ডাক্তারি রিপোর্ট যে− সে গর্ভবতী। পরে ধরাও পড়েছিল সেই ধর্ষক। ‘গর্ভবতী’ এই শব্দ তাকে শতচ্ছিন্ন শরীরের ভিতর আনন্দ এনে দিয়েছিল, যেন শুনতে পেয়েছিল বহু আকাঙ্খিত শিশুর মৃদু হাস্য-কলরোল ধর্ষিতা হবার চেয়েও তাকে বড়ো আনন্দ দিয়েছিল। নারীত্বের জয় ঘোষিত হয়েছিল।
তার বার বার মনে হয়েছিল− আসলে তার স্বামীই ছিল শক্তিহীন, নপুংসক। স্বামীর মুখটা মনে পড়ছিল আর তার প্রতি ঘৃণাবোধ জাগছিল। ও দিকে তার সামনেই দাঁড়িয়েছিল সেই ধর্ষক সেপাই।
−বাবু, আমরা ঘর করতে পারি না ? এই সেপাইবাবু আমাকে বিয়ে করতে পারে না ?
−না, তা হয় না। বিচারকের উত্তর ছিল। তুমি এ দেশের নাগরিক নও, তোমার পাসপোর্ট নেই, ভিসা নেই। তুমি নিষিদ্ধ এ দেশে।
অবশেষে তার জেল হয়, ধর্ষকেরও জেল হয়। দেখা হওয়ার কোনও সম্ভাবনা ছিল না। ধর্ষণ আছে কিন্তু ভ্রুণহত্যা নিষিদ্ধ, সেই নিয়মকে মানার জন্য অবশেষে জন্মায় তার কন্যা সন্তান। বাচ্চা সমেত তার জেল হয় সাত বছর। মুক্তির সময় আগত−তার বাচ্চার বয়স এখন সাত, এবার তাকে যেতে হবে ভিন্ন কয়েদখানায়, কারণ তার অভিভাবক নেই। কিংবা চলে যেতে হবে নিজের দেশে। সে তারপর আবেদন করেছিল−অন্য দেশে পাঠিয়ে দাও কিন্তু তার মেয়েকে তার সঙ্গে দিতে হবে। বাচ্চা এ দেশের নাগরিক, তার ধর্ষক এ দেশের কিন্তু গর্ভ ভিন দেশের, সে পাকিস্তানের। পাকিস্তানের গর্ভ থেকে ভারতীয় সন্তান। মা পাকিস্তানের, সন্তান ভারতীয়−মাঝে কাঁটাতারের বেড়া। এই কেস একনও ঝুলছে, সিদ্ধান্তহীন উত্তর। এর থেকে সংজ্ঞা টানা যেতে পারে, দুই দেশের বিভাজন রেখা অর্থাৎ কাঁটাতারের লৌকিক-অলৌকিক সংজ্ঞা।
কিন্তু সংজ্ঞা এত তাড়াতাড়ি বেড়া দিয়ে বেঁধে দিলে তা হবে আরও একটা শুষ্ক হৃদয়হীন অস্তিত্ব। সচল থাকবে না। কিন্তু কাঁটাতারের বেড়া চলমান জীবন্ত। একে ঘিরেই বহু জীবন নির্ধারিত হয়।
শান্তি নাথ : (১৯৫৪-) । রেলকর্মী। শিল্প-সমালোচক। জন্ম এবং অধ্যায়নপর্ব−কৃষ্ণনগর। কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে গণিতশাস্ত্রে স্নাতক। তাঁর উৎসাহের ক্ষেত্র শিল্প−বিশেষত চিত্রশিল্প। নিরন্তর মননে-অধ্যায়নে এবং কায়িক শ্রমেও পাঠ করেন শ্ল্পিগ্রাম আর শিল্পীদের কর্ম আর দর্শন। রেমব্রান্ট, বিপিন গোস্বামীর ভাস্কর্যভাবনা, নাস্তিকের লোকশিল্প, আত্মপ্রতিকৃতি : গোবর্ধন আশ− এক দিকে মনস্কতায় ধ্রুপদী এবং প্রকাশভঙ্গিমায় এক কথায় বলা যায়−প্রত্যয়ী।
. . .চলবে