সাহিত্য

ফিরিঙ্গির চরের সে এবং চন্ডিপুরের তারা

By Daily Satkhira

March 02, 2018

মনিরুজ্জামান ছট্টু ফিরিঙ্গির চরের সে এবং চন্ডিপুরের তারা

সে আবার সচকিত হয়। কান খাড়া করে। বাতাসের গতিমুখে নাক উঁচু করে ঘ্রাণ নেওয়ার চেষ্টা করে। না, কোনো মানুষের গন্ধ নয়। সে আবার খালে নামে। সরু খাল। ফিরিঙ্গির চরের এই সরু খালে আইলার আগেও সে কত মাছ পেয়েছে। দু’চারটে পারশে, কি একটা ভেট্কি, না হয় একটা কাইন। যাহোক একটা কিছু। আজ সাতদিন ধরে তার উপোষ চলছে। অথচ ক’দিন আগেও এমন অবস্থা ছিল না। মাদার ও ফিরিঙ্গি নদীর এই মোহনার চরে ঝাঁকে ঝাঁকে মিলত হরিণ। আহা, কতদিন তার পেটে হরিণের মাংস পড়েনি। হরিণের দরকার নেই। খালে যদি দু’চারটে অন্তত কাকড়া মিলত। সে তার থাবা দিয়ে অনবরত খালের কাদা ঘাটতে থাকে। কিচ্ছু পায় না। খাল থেকে উঠে সে আবার জঙ্গলে ঢোকে। অকারণ খানিক হাঁটাহাঁটি করে। ফিরিঙ্গির চরে বাস তার দীর্ঘদিনের। কত দূরের জঙ্গলেও সে গিয়েছে কিন্তু আবার সে ফিরে এসেছে এই ফিরিঙ্গির চরে। এ চরের কেওড়া বন তাকে যেন টানে।

‘মালে’ উঠে সে ঘাড় উঁচু করে যতদূর দৃষ্টি যায় দেখার চেষ্টা করে কোনো শিকারের। দৃষ্টি সীমার মধ্যে কোনোকিছুই তার নজরে আসে না। সে অকারণ তার নখ দিয়ে কিছু মাটি আঁচড়ায় এবং গলা দিয়ে হুন্ক শব্দ করে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে সে মাদার নদীর তীরে এসে দাঁড়ায়। জঙ্গল ছেড়ে এত ফাঁকা জায়গায় সচরাচর সে আসে না। মাঝ নদীতে সে চেনা কিছু জেলে-নৌকা দেখতে পায়। তবে সে সাবধান হয়। জেলে নৌকা থেকে মানুষের উৎসুক দৃষ্টি তার ওপর পড়বার আগেই সে দ্রুত জঙ্গলে প্রবেশ করে। জঙ্গলে ঢুকে সে থামে না। হাঁটতে থাকে। ঘন কেওড়া বনে বিশেষ করে এই ফিরিঙ্গির চরের জঙ্গল এতটাই ঘন যে এখানে কখনই সূর্যের আলো প্রবেশ করে না। সে ছোট ছোট আলো ছায়ায় খানিকটা অলস ভঙ্গিতে হাঁটতে থাকে। খানিকটা পশ্চিমে ঘেঁষে সে সোজা উত্তর দিক বরাবর হাঁটতে থাকে। হঠাৎ তার মাথার উপর দুটো বানর কিচ্ কিচ্ শব্দে ডেকে ওঠে। মট করে একটা ডাল ভাঙার শব্দও তার কানে আসে। সে থমকে দাঁড়ায়। নিজেকে সংকুচিত করে ফেলে। বিপদের গন্ধ পায়। চট করে একটা হেতাল ঝোপের মধ্যে নিজেকে লুকিয়ে ফেলে। বেশ কিছুক্ষণ হেতাল ঝোপের মধ্যে বসে সে আর কোনো বিপদের আলামত বুঝতে না পেরে উঠে দাঁড়ায় এবং আবার হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে সে যখন মরাদুলি চরে এসে পৌঁছায় তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। সাতদিন তার উপোষ চলছে। পেটের ক্ষিদে ছড়িয়ে পড়ে সারা শরীরে। বা দিকের থাবার নীচে বেশ কিছুদিন আগে একটা হেতাল কাঁটা বিঁধেছিল, এতদিন কিছু বুঝতে পারেনি সে। এখন বেশ ব্যথা অনুভব করে। হাঁটতে যেন কষ্ট হয়। শরীরের অন্যসব কষ্ট ছাপিয়ে তীব্র হয় তার জঠর যন্ত্রণা। এখানেও কোনো খাবার মেলে না। শিকারের কোনো সম্ভাবনা সে খুঁজে পায় না। গরাণের ঝোপটা বাঁয়ে রেখে সে আবার উত্তর দিক বরাবর হাঁটতে থাকে। খোবরাখালী নদীর তীরে এসে খানিক বিশ্রাম নেয়। খোবরাখালী অনায়াসেই সাঁতরে পার হয় সে। খোবরাখালী পার হয়ে এসে চুনকুঁড়ি ও মালঞ্চ নদীর মাঝ বরাবর জঙ্গল দিয়ে সে হাঁটতে থাকে। এখানকার জঙ্গল অপেক্ষাকৃত হালকা। মাঝে মাঝে বেশ কিছু জায়গা একেবারেই ফাঁকা। এরকম একটি শুলো বিহীন ফাঁকা জায়গায় অকারণ খানিক গড়াগড়ি খায় সে। তবে সে আবার হাঁটতে থাকে। ক্ষুধার যন্ত্রণা তাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। মালঞ্চ ও কলাগাছি নদীর মোহনাও সে অনায়াসে পার হয়। হাঁটতে হাঁটতে সে কদমতলা ফরেস্ট অফিসের কাছ দিয়ে লোকালয়ের সীমানার মালঞ্চ নদী পার হয়ে মুন্সিগঞ্জ গ্রামে ঢুকে পড়ে। তখন রাত প্রায় শেষ হয়ে আসছে। শেষ রাতের ফিঁকে অন্ধকারে সে ঘেরের পথ ধরে মুন্সিগঞ্জ বাজার পার হয়। পার হয় পানখালী গ্রামও। পানখালী গ্রাম পার হয়ে সে যখন চন্ডিপুর গ্রামে পৌঁছায় তখন সকাল হয়ে গেছে। লোকালয় তার কাছে অচেনা অজানা। এখানে জঙ্গল নেই। নিজেকে লুকানোর জায়গা নেই। তবে হঠাৎ সে খাবারের গন্ধ পায়। তার দৃষ্টিসীমার মধ্যে একটা ছাগল ধরা পড়ে। কি অনায়াস শিকার। কি সহজ শিকার। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার মুখ দিয়ে খানিক লালা গড়িয়ে পড়ে মাটিতে। ক্ষুধার যন্ত্রণা তাকে বিপদের কথা ভুলিয়ে দেয়। মানুষের গন্ধও তাকে আর সচকিত করে না। সাবধানী করে না। একটা কুঁড়েঘরকে আড়াল করে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছাগলটার উপর। কিন্তু ততক্ষণে গ্রামের মানুষ জেগে উঠেছে। ছাগলের চিৎকার আর মানুষের চিৎকারে পুরো গ্রাম জেগে ওঠে নিমিষেই। ছাগলটিকে সে খেতে পারে না। মুখে করে নিয়ে সে পালাতে চায়। কিন্তু পারে না। আট দিনের উপোষী ক্ষুধার্ত হয়েও সে মুখের খাবার ফেলে দিয়ে দৌঁড়াতে থাকে। কিন্তু দৌঁড়ে পালাবে কোথায় সে? এখানে হেতাল ঝোপ নেই। গোল বাগান নেই, আর চির চেনা ফিরিঙ্গির চরের কেওড়া বন নেই। সে দৌড়াতে থাকে। সে দিগি¦দিক ছোটে। দৌড়াতে দৌড়াতে সে আবার জঙ্গলে ফিরতে চায়। কিন্তু সে পথ পায় না। পুরো গ্রাম এখন জেগে উঠেছে। চারদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ। লাঠি হাতে মানুষ, সড়কি হাতে মানুষ, বর্শা হাতে মানুষ। শয়ে শয়ে মানুষ, হাজারে হাজারে মানুষ। সে পালাবার পথ খোঁজে, পায় না।

অকস্মাৎ ভিড় থেকে কিছু সাহসী সশস্ত্র মানুষ তার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। সে তখন তার ক্ষুধার কথা ভুলে যায়। ভীত হলেও সাহসী হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে। সবকিছু ভুলে সে কেবল অনুভব করে বেঁচে থাকার তাগিদ। সে খুব দ্রুত একজনকে আঘাত করে। দুই থাবা তার ঘাড়ে তুলে আমূল বিঁধিয়ে দেয় ক্ষুরধার নলি। লোকটি চিৎকার করারও সময় পায় না। রক্তে ভেসে যায় তার সারা দেহ, অকুস্থলের মাটি। তাকে নিয়ে ব্যস্ত কিছু মানুষ। এ সুযোগটি সে হাতছাড়া করে না। মানব প্রাচীর কিছুটা শিথিল দেখেই সে দৌড়ায়। সে কেবল দৌড়ায় আর দৌড়ায়। দৌড়াতে দৌড়াতে যেখানে যেটুকু পালাবার জায়গা পায় সেখানে সে একটু জিরিয়ে নেয়। কখনও কারোর রান্নাঘরে, বসতঘরে কিম্বা গোয়ালঘরে। কিন্তু সেটি বেশিক্ষণের জন্য নয়। উন্মত্ত মানুষের স্রোত কাছে এগিয়ে এলেই আবার সে ছোটে। দু’জন অতি উৎসাহী বন্দুকধারীও এই জন স্রোতে মিশেছে। আকাশের দিকে বন্দুকের নল উচিয়ে গুড়–ম গুড়–ম করে দুটো ফায়ার করে তাদের সরব উপস্থিতি জানান দেয়। সে কিন্তু এই ‘আগুনে লাঠিকে’ খুব ভয় পায়। এ লাঠির মুখ থেকে আগুন বের হয়। তবে বন্দুকধারীরা কিন্তু এ কম্মটি করবে না। গুলি করার মতো বোকামী তারা করবে না, গণপিটুনি এক জিনিস আর গুলি করে মেরে ফেলা আর এক জিনিস। বাদাবনের ধারে যাদের বাস তারা অন্তত এটুকু বোঝে। কেবল ভয় দেখানোর জন্যই তারা উড়ো ফায়ার করে। তবে যাকে ভয় দেখানোর এই আয়োজন সে কিন্তু সত্যি সত্যি ভয় পায়। ভয়ে সে একটা গোয়ালঘরের মধ্যে যেয়ে আশ্রয় নেয়। আট দিনের উপোষী শরীরটাকে সে আর টানতে পারে না। গোয়াল ঘরের মেঝেতে সামনের দু’পা মেলে দিয়ে বসে পড়ে হাফাতে থাকে। ইতোমধ্যে পুরো গোয়ালঘরটা হাজার হাজার সশস্ত্র মানুষ ঘিরে ফেলে। সে অবশ্য আর পালাবার চেষ্টাও করে না। তবে গোয়ালঘরের গরাণের বেড়ার ফাঁক দিয়ে যখন সে দূরের জঙ্গলের রেখা দেখতে পায় তখন তার আবার পালাবার ইচ্ছা জাগে। ঐ তো মালঞ্চ নদী। নদীটা পার হলেই জঙ্গল। তার প্রিয় বাদাবন। সে আবার ফিরে যেতে পারে তার প্রিয় ফিরিঙ্গির চরে। সেখানে না মিলুক শিকার, না মিলুক কোনো খাবার। সে জানে তার মুখের গ্রাস কারা কেড়ে নিয়েছে। বাদার হরিণ মেরে খেয়েছে তারাই, খালের মাছ ধরে নিয়ে গেছে তারাই, জঙ্গলের বৃক্ষরাজি কেটে উজাড় করেছে তারাই-যারা তাকে এখন বন্দী করে রেখেছে। সে আর পালাবার চেষ্টা করে না। চেষ্টা করে লাভও নেই। গোয়াল ঘরের চারপাশে সশস্ত্র মানব প্রাচীর তাকে অবরুদ্ধ করে রাখে। কিছু অতি উৎসাহী সাহসী যুবক উপায়ন্তর না দেখে গোয়ালঘরের চালে উঠে পড়ে।

গোলপাতার চাল ফাঁক করে একটা ফাঁস আস্তে আস্তে নামিয়ে দেয় তার মাথা লক্ষ্য করে। প্রথমবার ব্যর্থ হলেও অসহায়, ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত, শ্রান্ত ফিরিঙ্গির চরের প্রতাপশালী সেনাপতির গলায় একসময় ঠিকই আটকে যায় ফাঁসটি। তারপর অতি দ্রুত শত শত ধারালো কুঠোরের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয় তার দেহ। গ্রামময় তখন উল্লাস ধ্বনি। পানখালী, কদমতলা আর চন্ডিপুরের হাজার হাজার মানুষ তখন নিষ্ঠুরতার আনন্দে, মৃত্যুর জান্তব উল্লাসে ফেটে পড়ে। হাজারো মানুষের সেই বিজয়ের উল্লাস আর চিৎকার মালঞ্চের তীর ঘেঁষা বাদাবনে বাঁধা পেয়ে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে চন্ডিপুর গ্রামে।