বাবলু ভঞ্জ চৌধুরী তিনটি মৃদুহাসি
আমাকে যখন গুলি করা হল, সে তখন ছবি তুলছিল। এ সব ছবি নাকি ভাইরাল হয়। অন্তর্জালে বিক্রি হয়, টাকা আসে। বেকার যুবকের এটাই নাকি বাঁচার পথ।
হাসপাতাল থেকে ফিরেছি। এ ফেরাটা অস্বাভাবিক। ঘোলাটে। আমার জীবনে দুটো ‘ঘোলাটে’ ছিল। এখন তিনটে হ’ল। অন্যদুটো বলা দরকার। এক. বেঁচে থাকতে আমি বাঁচার আশা করি। মরণের সময় করিনা। স্পষ্ট মনে আছে, গুলির সময়―আমার মধ্যে অন্য কেউ বাঁচার আশা করেছিল। সে কে―তা আমি জানিনে। এখন আমি জানি, মরণে বাঁচার আশা করে সে। তার আশার মধ্যেই মানুষ নিথর হয়ে যায়। প্রতি অনুক্ষণে এমন ‘নিথর’ ঘটছে । তাই বোধহয় পৃথিবী জেগে থাকে। দুই. আমি খুব কচিৎ স্বপ্ন দেখি। দেখি―আমি পড়ে যাচ্ছি। অনেক উঁচু থেকে আমি পড়ে যাচ্ছি। তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে বসি। ভাবি, পৃথিবী কি আমাকেশুদ্ধু পড়ে যাচ্ছে? মহাকাশে গ্রাভিটি আছে। কোনো মহাগ্রাভিটির টানে আমরা পড়ে যাচ্ছি? অনন্ত কাল ধরে পড়ছি নিয়ত? কার কাছে শুনব এর উত্তর? আমি জানি , কেউ এর উত্তর দিতে পারেনা। ঠিক করেছি―আমিই সবচেয়ে ভালো উত্তরদাতা। আর কেউ নেই। তাই উত্তর খুঁজতে খুঁজতে ঘুমিয়ে পড়ি আবার।
আমার শয্যাটা বেশ! ময়লা তেলচের মধ্যে আমার নিজের গন্ধটা বেশ শক্তিশালী। ভালোলাগে যে, অন্তত একটা ‘শক্তিশালী’র সাথে আমি আছি। সে এত শক্তিশালী যে , ফাগুন বাতাসে ভেসে আসা মৌ-মৌ গন্ধকে মুহূর্তেই খেয়ে ফেলে।
মানুষ নাকি নিজের মুখ নিজে দেখতে পারে না। আগে বিশ্বাস করতাম। এখন করিনা। এখন আমি নিজের মুখ নিজে দেখতে পারি। গুলি লাগার পর আমি অনেক কিছু পারি। আমার ঠোঁটের কোণে হাসি আসে। সব সময় না। কিছু কিছু মুহূর্তে। সেই হাসি দেখার জন্য,আমি নিজের মুখ দেখতে শিখেছি। কারণ কোনো আয়নায় সে হাসি ধরা পড়েনা। আমি ভয়ানক এক পরিণতি জেনেছি। আমার ঠোঁটে তিনবার মৃদুহাসি ফুটবে। তিনটেই আমি দেখতে পাব। তিনবার যেদিন পুর্ণ হবে―সেদিন আমি মরে যাব। ভয়ানক? না, যা সত্য –তা ভয়ানক হয় না। তা সাবলীল। তা মানতে হয়। আমি মানার চেষ্টা করি। নানা, আমি তলস্তয় এর ‘ মানুষ কীভাবে বাঁচে’ গল্পের মতো বলছিনা। আমি এঞ্জেল না। আমি মানুষ। কিন্তু আমি জানিনা―আমার মৃদুহাসিটা মানুষী কিনা। আমি এখনো দেখিনি।
পত্রিকায় ছবিতোলা যুবকের সাক্ষাৎকার এসেছে। সাংবাদিক প্রশ্ন করে, আততায়ীকে আপনি নিবৃত্ত করতে পারতেন, কেন করলেন না? যুবক উত্তর দেয়, নিজে বাঁচব বলে। একজনের মৃত্যুর দৃশ্য ধারণ করে আমি বিকোব বলে। আমি টাকা পাব বলে।
যুবক সম্পর্কে প্রতিদিন খবর আসছে। একজন মনোচিকিৎসক বলছেন, ডারউইন পড়েন নি? এটা জৈবিক । তবে অতি-জৈবিক।
একজন দার্শনিক বললেন, আসলে নিছক কার্যকারণ। বাঁচা। এছাড়া কোনো মানে নেই। পৃথিবীটা আসলে নিছক কার্যকারণের। যেমন বীজতলায় ধান ফেললে চারা হয়―তেমনি। কোনো উদ্দেশ্য নেই। কেউ কেউ এই দার্শনিককে নৈরাশ্যবাদী বললেন।
একজন কবি বললেন, আমি অনেক ভেবেছি, আসলে বাঁচাই যখন আসল, অন্যের মৃত্যু সেখানে মামুলি।
আমি পড়ি । আমি ঠোঁটের কোণে হাসি দেখতে পাই! একবার। আর দুবার। তাহলেই শেষ! আমি আর পড়িনা।
আমাকে উঠোনে রাখা হয়েছে। রোদে আমি ভাসি। আকাশের নীলে চোখ রাখি। আকাশ এখানে নীল। ওখানে নীল নয়। যেখানে নীল নয় ―আমি মনে মনে সেখানে যাই। একই আকাশে যাই। আমার অসম্ভব গতি। আলোর চেয়েও গতি। তা নাহলে একজন্মে মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে আমি যাব কী করে? ভাবি, শরীরই কী সব? আমাকে কী যেতেই হবে? গ্যালাক্সি থেকে গ্যালাক্সীতে কি যেতেই হবে? আর কেউ কি আসবে? যে অযুতবর্ষ আয়ু পাবে! যে আলোর চেয়ে গতি পাবে!
মাথার কাছে এসে পড়ে একটা ঘুড়ি। লাল কাগজের ঘুড়ি। ঘুড়ি কথা বলে। আমি শুনতে পাই। বলে, মাটিতে তাকাও। নিজের দিকে তাকাও। আকাশ তোমার সাধ্যাতীত। বিশ্বের সকল বৈশিষ্ট্য তোমার মধ্যে। তোমার মধ্যে সকল উত্তর। ছোটর মধ্যেই সব বড় আছে। ছোটকে দেখ। আমি ছোটকে দেখার ইচ্ছা করি। দেখি ছোট অনেক বড়। তার কাছে আমি অনেক ছোট। আমি ঠোঁটের কোণে হাসি দেখতে পাই। আবার হাসি! আর একবার! আমি আর ভাবিনা।
ঘুড়ির ছেলেটা দৌড়ে আসে। চোখ পিটপিট করে। ঘুড়িটা নেয়। বলি, ঘুড়ি যদি ছিঁড়ে ফেলতাম! ছেলেটা হাসে। বলে, বিশ্বাস করিনা। তোমার হাত নেই, বাতাসের ভয় ছিল, বাতাস ছিঁড়তে পারত।
সত্যি আমার হাত নেই। ছেলেটা জানে। যে দুটো হাত আছে― তা বাড়তি। এখন বোঝা। আকার থাকলেই হাত হয় না। তা অন্যকিছু। কাজ না করলে , পরিচয় অর্থহীন।
ছেলেটা সুতো পেঁচায়। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঘুড়ির মাথায় সুতো পেঁচায়। আমি আবার ঠোঁটের কোণে হাসি দেখতে পাই। তৃতীয় বার! এবার আমি মরে যাব! দ্বৈবকথা ফলে! আমি ছেলেটিকে দেখতে পাচ্ছি না। এখনই কী মরে যাব? আমি কি মরে গেছি? আমি চিমটি কাটি। আমার গায়ে চিমটি কাটি। জোরে চিমটি কাটি। খুব জোরে। আমার মাথা বলে, চিমটি কেট না, ব্যাথা লাগে।