অপারেশন থিয়েটারে শুয়ে আছি, মাথার ওপর উজ্জ্বল আলো। আমাকে ঘিরে ডাক্তার-নার্স, তার সঙ্গে অনেক মানুষ, অনেকে আকুল হয়ে কাঁদছে। ডাক্তার-নার্স সবাইকে বের করার চেষ্টা করতে করতে আমাকে বললেন, ‘আপনার ইনজুরিটা কতটুকু গুরুতর বোঝার জন্য, রক্ত বন্ধ করার জন্য আপনাকে জেনারেল এনেসথেসিয়া দিতে হবে। আমি একবারও জ্ঞান হারাইনি, মাঝে মাঝে যখন মনে হয়েছে অচেতন হয়ে যাব দাঁতে দাঁত কামড়ে চেতনা ধরে রেখেছি। কেন জানি মনে হচ্ছিল অচেতনার অন্ধকারে একবার হারিয়ে গেলে আর ফিরে আসব না। আমি অবুঝের মতো ডাক্তারদের বললাম, না আমাকে জেনারেল এনেসথেসিয়া দেবেন না, যা করতে চান এভাবেই করুন। ডাক্তার বললেন, অনেক কষ্ট হবে। আমি বললাম, হোক। ডাক্তার বললেন, সেই যন্ত্রণালয় আপনি এমনিতেই জ্ঞান হারাবেন। আমার হাতে-পায়ে সুচ ফুটিয়ে তখন রক্ত স্যালাইন দেওয়া শুরু হয়েছে। তার সঙ্গে তারা অন্য কিছু দিলেন, আমি কিছু বোঝার আগে অচেতন হয়ে গেলাম। এক সময় আবছা আবছাভাবে চোখ খুলে তাকিয়েছি, আবছা অন্ধকার, মুখের কাছে বুকে কেউ কিছু একটা বলছেন, শুনতে পাচ্ছি কিন্তু বুঝতে পারছি না। ভালো করে তাকালাম, মানুষটি আমাদের শিক্ষামন্ত্রী। আমি তাকে নাহিদ ভাই ডাকি। আমি তার কথা বোঝার চেষ্টা করলাম, তিনি আমাকে সাহস দিচ্ছেন। বলছেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে ঢাকা নেওয়ার জন্য হেলিকপ্টার পাঠিয়েছেন। আমি চেতনা এবং অচেতনার মাঝে ঝুলে আছি। টের পেলাম আমাকে স্ট্রেচারে শুইয়ে কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমাকে কোথায় জানি তোলা হলো, আশেপাশে সামরিক পোশাক পরা মানুষ। আমার কম বয়সী সহকর্মীদের কেউ কেউ আছে। আবছা অন্ধকারে হেলিকপ্টারের ইঞ্জিনের গর্জন শুনতে পেলাম। গর্জন বেড়ে উঠল-নিশ্চয়ই আকাশে উড়তে শুরু করেছি। ঘুমিয়ে আছি না জেগে আছি জানি না। আবছা অন্ধকারে অনেকে চুপচাপ বসে আছে। তার মাঝে শুধু ইঞ্জিনের গর্জন। যাচ্ছি তো যাচ্ছি। মনে হয় বুঝি যোজন যোজন পার হয়ে গেছে। এক সময় ইঞ্জিনের শব্দ থেমে গেল। নিশ্চয়ই ঢাকা পৌঁছে গেছি। মানুষজন ছোটাছুটি করছে। আমাকে নামানো হয়েছে। হেলিকপ্টার থেকে নামিয়ে আমাকে একটা ট্রলি বা স্ট্রেচারে শোয়ানো হয়েছে। উপরে খোলা আকাশ। সেই আকাশে একটা ভরা চাঁদ। এই যে আমি সেই চাঁদটির দিকে বুভুক্ষের মতো তাকিয়ে রইলাম। পৃথিবী এত অবিশ্বাস্য সুন্দর? খোদা আমাকে এই অবিশ্বাস্য সুন্দর পৃথিবীটিকে আরও কয়দিন দেখতে দেবে?