অনলাইন ডেস্ক: দেশের ৬৪ জেলায় অর্ধলাখের বেশি পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকারের নামের তালিকা পাওয়া গেছে। তবে মেট্রোপলিটন এলাকা থেকে এখনও মেলেনি এ সংক্রান্ত তালিকা। ওই তালিকা হাতে পাওয়ার পর পাকিস্তানি হানাদার ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী রাজাকারদের নামের তালিকা প্রকাশ করবে সরকার। জরুরি ভিত্তিতে এদের নামের তালিকা চেয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) তদন্ত সংস্থা। পাশাপাশি হানাদার ও তাদের সহযোগীদের হাতে নির্যাতিত লোকের সংখ্যা ও নাম-ঠিকানা চাওয়া হয়েছে। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি চিঠি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে আইসিটি। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
রাজাকারদের তালিকা প্রকাশ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের সহযোগী আলবদর-রাজাকারদের তালিকা তৈরি হচ্ছে। সব জেলা প্রশাসক ও সংশ্লিষ্টদের কাছে তালিকা চাওয়া হয়েছে। বিষয়টি আইসিটির তদন্ত সংস্থা দেখভাল করছে। সারা দেশের তালিকা হাতে পাওয়ার পর তা জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে।’
আইসিটির তদন্ত সংস্থা থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে সম্প্রতি এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী বাহিনীর আত্মসমর্পণের আগ পর্যন্ত ওই বাহিনীর কমান্ডার ও তাদের অন্য সদস্যদের মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রাথমিক তদন্তের জন্য তথ্য প্রয়োজন। তারা গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, ধর্মান্তরিতকরণ, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠনের মতো অপরাধ করেছে। সব জেলার তথ্য পাওয়া গেলেও মেট্রোপলিটন এলাকার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। জরুরি ভিত্তিতে তৎকালীন সেনা ক্যাম্পের নাম, স্থায়িত্বকাল, কমান্ডারের নাম, পদবি, সংশ্লিষ্ট ক্যাম্পে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মরত আনুমানিক সদস্য সংখ্যাসহ প্রয়োজনীয় আনুষঙ্গিক বিভিন্ন তথ্য দিতে বলা হয় চিঠিতে। কমান্ডার ছাড়াও অন্যান্য সিনিয়র অফিসার, জেলাওয়ারি আনসার ও রাজাকার ক্যাম্পের নাম দিতে বলা হয়। এছাড়া আনসার ও রাজাকার ক্যাম্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত অ্যাডজুটেন্ড/কমান্ডারদের নাম, ঠিকানা ও তাদের বর্তমান অবস্থান, জীবিত না মৃত- এমন তথ্যও চাওয়া হয়। তাদের হাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের নির্যাতন কেন্দ্রের নাম, স্থায়িত্বকাল, নির্যাতিত লোকের সংখ্যাও চাওয়া হয় চিঠিতে।
এ প্রসঙ্গে আইসিটির তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক (আইজপি পদমর্যাদায়) মুহ. আবদুল হান্নান খান পিপিএম বলেন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান দখলদার সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগীদের দ্বারা সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের তথ্য-উপাত্ত চাওয়া হয়েছিল দুই বছর আগে। সব জেলার তথ্য পেলেও মেট্রোপলিটন এলাকার তথ্য এখনও মেলেনি। বিষয়টি অবহিত করে এবং এ সংক্রান্ত তথ্য চেয়ে এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। জেলাগুলো থেকে কী পরিমাণ স্বাধীনতাবিরোধীর নাম এসেছে জানতে চাইলে আবদুল হান্নান খান বলেন, ‘এখনও চূড়ান্তভাবে হিসাব করা হয়নি। তবে কোনো কোনো উপজেলায় একশ’ থেকে দেড়শ’ নামের তালিকা পাওয়া গেছে।’ তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইসিটির এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এ পর্যন্ত স্বাধীনতাবিরোধীদের যে তালিকা পাওয়া গেছে তার সংখ্যা ৫০ হাজারেরও বেশি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধে জড়িত চিহ্নিত পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসরদের বিচার করছে আইসিটি। এর অংশ হিসেবে ২০১৬ সালের ২৫ জানুয়ারি পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসরদের মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের তথ্য চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাধ্যমে ডিসি ও কারা মহাপরিদর্শককে চিঠি দিয়েছিল আইসিটি। এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত পাকিস্তানি সেনাদের নামের তালিকা তৈরি করা হবে। সেখানে আগে চিহ্নিত ১৯৫ জন ছাড়াও আরও নাম অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। একই সঙ্গে তৈরি করা হবে পাকিস্তানি হানাদারদের সহযোগী রাজাকারদের হালনাগাদ তালিকাও। পর্যায়ক্রমে তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে।
রাজাকারের তালিকা প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বেসামরিক নাগরিক থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধকালীন চাকরিতে থাকা এবং বেতন-ভাতা গ্রহণকারীদের তথ্য নেয়া হয়েছে। এমনকি যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের সহায়তা দিয়েছিলেন, তাদেরও নাম থাকছে এ তালিকায়। আর তথ্য সংগ্রহের এ কাজটি সমন্বয় করছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। প্রশাসন ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের মাধ্যমে তথ্য যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা এসব তথ্য সংরক্ষণ করছে। মোট ছয় ধরনের অপরাধীর তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্যদের নামের তালিকা। এসব বাহিনীর সদস্য কর্তৃক নিহত শহীদদের তালিকা। জেলার অধিক্ষেত্রে বধ্যভূমি, গণকবর, রাস্তা ও নদী চিহ্নিত করে প্রস্তুত মানচিত্র। মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং বীরাঙ্গনার তালিকা। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে অগ্নিসংযোগকারী, অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি, সেতু-কালভার্ট ইত্যাদির তালিকা এবং ওই সময়ে রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্য কর্তৃক জেলা ট্রেজারি থেকে স্বাক্ষর করে বেতন-ভাতাদি উত্তোলনকারীদের তালিকা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আইসিটির সমন্বয়ক মুহ. আবদুল হান্নান খান বলেন, সংগৃহীত তালিকা ধরে মামলা করা হচ্ছে। তৃণমূলেও যদি রাজাকার, আলবদর, আলশামস বা তাদের সহযোগী কাউকে পাওয়া যায়, তাদের বিরুদ্ধেও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা করা হবে। মেট্রোপলিটন এলাকার তালিকা প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, এসব এলাকার বেশিরভাগ রাজাকারই ছিল ভাসমান। তাদের পরিচয় পাওয়া খুবই কঠিন। এ কারণেই সম্ভবত দেরি হচ্ছে।
এর আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কারা মহাপরিদর্শককে দেয়া আইসিটির এক চিঠিতে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগী শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশের সব এলাকায় যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, ধর্মান্তরিতকরণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধ শেষে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যরা আত্মসমর্পণ করে। এ সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কমান্ডার বা অফিসার ও সদস্যদের অনেককেই গ্রেফতার করে জেলহাজতে পাঠানো হয়। সে মোতাবেক তাদের ওই সময় যেসব কারাগারে আটক রাখা হয়েছিল, সেখানে তাদের বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। এমন বিবেচনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এসব পাকিস্তানি সেনার নাম-পরিচয় ও জেলখানার নাম, মামলা নম্বর ও অন্য তথ্যাদি চায় আইসিটি।