অনলাইন ডেস্ক: সাতই মার্চের ভাষণের আগে-পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তৎকালীন ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খানের কথোপকথন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন তার সঙ্গে দ্বিমত জানিয়েছেন জাসদের একাংশের নেতারা।
শনিবার জাসদের এই অংশের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া ও সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধানের এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতা ঘোষণা করতে দাবি জানানো ও ভাষণের পর তা নিয়ে কথা বলা দেশবাসী তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রযোদ্ধা ছাত্র-তরুণদের দুর্বার আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন মাত্র।
“আর ছাত্র-তরুণদের আকাঙ্ক্ষাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সব সময়ই সযত্নে লালন করেছেন। ষাটের দশক থেকে বঙ্গবন্ধু ও নিউক্লিয়াস সংগঠকদের মধ্যে এ ধরনের বহু কথাবার্তা, অনুযোগ, তর্ক-বিতর্ক ঘটেছে; যা কখনও বঙ্গবন্ধু ও নিউক্লিয়াসের সম্পর্কে ন্যূনতম চিড় ধরায়নি। “এগুলো কখনই ষড়যন্ত্র ছিল না, ছিল স্বাধীনতার দুর্বার আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ।”
শুক্রবার এক সেমিনারে বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের আগে-পরে তার সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের কথোপকথন তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। তিনি জানান, ওই ভাষণেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন সিরাজুল আলম খানসহ তার সহযোদ্ধারা এবং ভাষণে সে ঘোষণা না আসায় ‘জনগণ নিরাশ হয়ে চলে গেছে’ বলে বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন তিনি। ৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে বিশ্বে কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার পাশাপাশি দেশের মানুষ পাকিস্তানিদের ভয়ানক হামলার মুখে পড়ত বলে মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা।
সেদিনই স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে দলের ভেতরে ওই চাপের উদ্দেশ্য কী ছিল- সেই প্রশ্ন তুলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “কিছু লোক বক্তৃতার আগে পরামর্শ, বক্তৃতার পরে এই কথা বলার পেছনে কী রহস্যটা থাকতে পারে, সেটা ৭৫ এর পরে বা পরবর্তীতে তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দেখলে এখন মনে হয়। তারা যে সব সময় একটা ষড়যন্ত্রের সাথে ছিল; সেটা কিন্তু বোঝা যায়।”
তার এই বক্তব্যে দ্বিমত জানিয়ে জাসদ নেতারা বলেছেন, “ওই কথোপকথন একান্তই বঙ্গবন্ধু ও নিউক্লিয়াস বিশেষ করে সিরাজুল আলম খানের পারস্পরিক বোঝাপড়ার ব্যাপার। নিউক্লিয়াস গঠন থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত এ বন্ধন ছিল অটুট।
“স্বাধীনতার পরে মত ও পথের ভিন্নতা টেনে এনে সে সম্পর্ককে বিতর্কিত ও কটাক্ষ করা হলে তা মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকেই কেবল অসম্মানিত করে না, ইতিহাসকেও অন্ধকারে ঠেলে দেয়।”
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনায় তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদের নেতৃত্বে ষাটের দশকের প্রথমার্ধে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বা স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস গঠিত হয়। পরবর্তীতে ছাত্র-তরুণদের আন্দোলন সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তারা। বঙ্গবন্ধুরও ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে ছিলেন এই ছাত্রনেতারা।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনির সঙ্গে বিরোধের জের ধরে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ভেঙে দুই ভাগ হয়। এরপর ১৯৭২ সালে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে রাজনৈতিক দল জাসদ প্রতিষ্ঠা হয়।
নুরুল আম্বিয়া ও প্রধানের বিবৃতিতে বলা হয়, “মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিতে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস যে ধারাবাহিক প্রয়াস চালিয়েছে, তার ফলশ্রুতিতেই ১৯৭১ সালের ১ মার্চ ইয়াহিয়ার ঔদ্ধত্যপূর্ণ বেতার বক্তৃতার সাথে সাথেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছাত্র-জনতা রাজপথে নেমে এসে স্বাধীনতার রণহুংকার তোলে।
“১৯৭১ সালের ১ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত নিউক্লিয়াসের পরিচালনায় স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন, ইশতেহার পাঠ, জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন, রাজপথে প্রকাশ্য সামরিক কুচকাওয়াজ ও প্রশিক্ষণ ইত্যাদির মাধ্যমে সারা বাংলাদেশে জনগণের ইস্পাতসম ঐক্য গড়ে তোলে। তার ফলে ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা শুরুর মুহুর্ত থেকেই দ্বিধাহীন চিত্তে সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ ‘যার যা আছে তাই নিয়ে’ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।”
বিবৃতিতে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধে নিউক্লিয়াস, স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, প্রবাসী সরকার ও উপদেষ্টা পরিষদ, বাঙালি সেনা সদস্য, সাংস্কৃতিক কর্মী, কূটনীতিকসহ সব পক্ষের ভূমিকা মিলিয়েই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির বিজয় অর্জিত হয়।
“নিউক্লিয়াস ছিল ৬ দফা থেকে স্বাধীনতার ১ দফা আন্দোলনে পরিণত করার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রথম ও প্রধান হাতিয়ার। নিউক্লিয়াস তথা সিরাজুল আলম খানের ভূমিকাকে খাটো করলে তা জাতির জন্ম ইতিহাসকেই খণ্ডিত ও বিপথগামী করবে মাত্র।”