সাহিত্য

সিকান্দারের নারী সিকান্দারের প্রেমের কবিতা-শুভ্র আহমেদ

By Daily Satkhira

March 27, 2018

শুভ্র আহমেদ সিকান্দারের নারী সিকান্দারের প্রেমের কবিতা

রোশফুকো১ বলেন, প্রেম ভূত-প্রেতের মতোই একটা কিছু। রোশফুকোর আপত্তির কারণ প্রায় সকলে প্রেমের কথা বলতে পছন্দ করলেও প্রেম জিনিসটাকে প্রায় কেউ দেখতে পায় না। রোশফুকো অবশ্য ‘কেহই’ শব্দটি ব্যবহারের মধ্যদিয়ে এটাকে সার্বজনীন করে তুলেছিলেন। লিখটেনবার্গ প্রেমের অস্তিত্বই অস্বীকার করেছেন; প্রেমের সত্যতা, প্রেমের স্বাভাবিকতা সম্পর্কে তিনি শেষ পর্যন্ত নিঃসংশয় হতে পারেননি। তবে আধুনিক ইউরোপীয় দর্শনের প্রবর্তক শোপেনহাওয়ার প্রেমের সত্যতা, প্রেমের স্বাভাবিকতা, প্রেমের অস্তিত্ব ইত্যাদি বিষয়ে নিঃসংশয়ী ছিলেন, বা বলা যায় নিঃসংশয়ী হয়ে ওঠেন এই কারণে যে, ‘নাটক মাত্রেইÑতা ট্রাজেডী বা কমেডি, রোমান্টিক বা ক্লাসিক, ভারতীয় বা ইউরোপীয় যাই হোক না কেনো ওই প্রেমই প্রধান ভাববস্তু। মহাকাব্য বা গীতিকাব্য কিংবা যত প্রকার কাব্য ও রোমঞ্চকর কাহিনী এত শতাব্দী ধরে প্রতিবছর পৃথিবীর ফলশস্যের মতো সভ্য দেশসমূহে উৎপন্ন হচ্ছে তার অধিকাংশের খোরাক যোগাচ্ছে ওই এক নর-নারীর প্রেম। সেগুলি আর কিছুই নয় ওই প্রবল হৃদয়াবেগের দীর্ঘ বা সংক্ষিপ্ত বর্ণনাÑতারই নানাভঙ্গি ও নানাভাবের কাহিনী।’ শোপেনহাওয়ার দৃঢ়চিত্তে এমনটাই বলেন, প্রেম সত্য, প্রেম স্বাভাবিক, প্রেম কোনো আষাঢ়ে কল্পনা নয়।

শোপেনহওয়ার খুব জরুরী একটা প্রশ্ন তোলেন এ উপলক্ষে। বিশ্বসাহিত্যের একটি উপকরণ, উদাহরণ হিসাবে বিবেচনায় নিয়ে তিনি দেখান সর্বযুগের কবিরা একাগ্র আগ্রহে যে চিত্র অঙ্কন করেছেন তা হচ্ছে ‘প্রেম’ আর পাঠক ততোধিক নিষ্ঠা ও বিশ্বাস নিয়ে যেটিকে ধারণ করেছেন, পাঠ করেছেন, বরণ করেছেন তাও হচ্ছে ‘প্রেম’। শোপেনহাওয়ার কবিদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে লক্ষবস্তুর দিকে এভাবেই গুলি ছুড়েছেন, ‘একথা মনে রাখতে হবে যে, কারুশিল্পে, কাব্যে, নাটকে যা সুন্দর হয়ে ওঠে তা সত্য না হয়ে পারে না।’

তাহলে মেনে নিতেই হয় প্রেম বলে কিছু একটা রয়েছে। যা মানুষকে আবেশিত করে, আলোড়িত করে, ক্ষেত্রবিশেষে ধ্বংসও। তারচেয়ে সত্য যে, প্রেম নামক ঘূর্ণিচক্রের বাও-বাতাস থেকে কেহই রেহাই পান না, হোক তিনি দলত্যাগী মার্ক এন্টনি, বিচারক প্যারিস, রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড, দিল্লীশ্বর শাহজাহান, নষ্টপুরুষ হিটলার ও মুসোলিনি, কবিদের কবি বোদলেয়ারÑরবীন্দ্রনাথ-এলিয়ট-নজরুল-জীবনানন্দ-শামসুর রাহমান এমনকি কবি গীত রচয়িতা সাংস্কৃতিক সংগঠক সিকান্দার আবু জাফরও।

তবে প্রথাবিরুদ্ধ হুমায়ুন আজাদের কাছে অবশ্য প্রেম অতিশায়িত করে দেখা রোমান্টিক আন্দোলনÑ উত্তরকালের পুরুষের স্বভাব বলে মনে হয়েছে। তাই প্রেম ক্ষণস্থায়ী আর কাম স্থায়ী বলেই মনে করতেন তিনি। স্পষ্টতই তিনি ফ্রয়েড ভাবনায় তাড়িত না হয়েও সেই আলো অন্ধকার থেকেই তিনি তার সিদ্ধান্তগুলো ছুড়েছেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে একথাও ঠিক যে, প্রেম স্থায়ী না হলেও অনিবার্য আর সে কারণেই প্রেম আসে বারবার কারণে অকারণে। যেমন এসেছে সিংহ পুরুষ সিকান্দার আবু জাফরের (১৯১৯-১৯৭৫) ছাপ্পান্ন বছরের যাপিত জীবনে। তিন নারী : প্রেমে, কামে২, পরকীয়ায় প্রেম শেষ পর্যন্ত নারী পুরুষের লিপ্ততার গল্প। প্রেমের অছিলায় যুদ্ধ, রক্তপাত, রাজপুরুষের সিংহাসন ত্যাগ, সমাধিনন্দন নির্মাণ ইত্যাদি কতকিছু তারপরও শেষ পর্যন্ত সাহিত্যিক ও সাহিত্যই প্রেমের শেষ আশ্রয়। তাইতো দান্তের বিয়াত্রিচ, শেকস্পিয়ারের ওথেলো-ডেসডিমনা শেলীর এমিলিয়া, কীটস এর ফানি ব্রাউন, আরব্য রজনীর মজনু লাইলী, মধ্যযুগের কৃষ্ণ-রাধা, মধুসূদনের রেবেকা-হেনরিয়েটা, রবীন্দ্রনাথের কাদম্বরী-ওকাম্পোÑলাবণ্য, মায়াকোভস্কির এলসা, জীবনানন্দের বেবী, সুনীলের নীরা আজও অমর কখনো যাপিত জীবনের অন্তরঙ্গতায়, কখনো সাহিত্যের মলাটবন্দী অক্ষরের দাড়ি-কমায়।

সিকান্দার আবু জাফর তখনো পুরুষ হয়ে ওঠেননি। হয়ে ওঠেননি বীরত্বের বেশ পরিধেয় দুরন্ত যুবক। তবু প্রেম এসেছিল। প্রেম এসেছিল নীরবে। তারপর জানাজানি। সিকান্দারের অন্তরঙ্গজন মুন্সী আকরামুজ্জামান মধু মিয়ার৩ কাছ থেকে শোনা যাক পুরানো সেই দিনের বিষাদকথা : ‘গ্রামের এক প্রান্তে ছিলো সিকান্দার আবু জাফরের ফুফুর বাড়ি। তার ফুফু আম্মার বেনু নামের এক পরমা সুন্দরী মেয়ে ছিলো। মেয়েটি ছিলো নিখুঁতভাবে সুন্দরী, যাকে বলে সর্বাঙ্গীন সুন্দর। গায়ের রং ছিলো হলুদ বরণ। সিকান্দার আবু জাফরের কৈশোরের সাথী ছিলো এই বেনু। কৈশোর বয়স থেকে উভয়ের সখ্য গড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে এই সখ্য প্রেমের রূপ নেয়। …বেনুকে সিকান্দার আবু জাফর ভালোবাসতেন এবং সমগ্র অন্তর দিয়েই ভালোবাসতেন। যে ভালোবাসায় কোনো ভেজাল ছিল না, তো ছিলো অকৃত্রিম ও পবিত্র। এই বেনুর ভালোবাসাই তো তাকে কবি বানিয়েছিলো’।

প্রত্যেক মানুষের মস্তিষ্কে প্রেম-মানচিত্র৪ থাকে। সাম্প্রতিক বিজ্ঞানীরা এমনটাই মনে করছেন। শিশুকাল থেকে বয়ঃসন্ধি অবধি ঘটা নানা সুন্দর ঘটনা, নানা সুন্দর ভালোবাসার মানুষের টুকরো টুকরো প্রতিচ্ছবি জুড়ে তৈরি সেই প্রেম মানচিত্রে আঁকা থাকে একটা মুখ। সেই মানচিত্রে আঁকা মুখটার সাথেই হয় প্রেম। বিবর্তন, জীববিজ্ঞান ও রসায়নবিদ্যা এই তিন পায়ার গোলটেবিলে দাঁড়িয়ে থাকে প্রেম। যার শুরু প্রায় চল্লিশ লক্ষ বছর আগে মস্তিষ্কের এক বিশেষ নিউরোকেমিকেল ক্ষরণ থেকে। প্রেম মানচিত্রের মানব/মানবী অঙ্কনে এগুলো কাজ করে রং-তুলি-ক্যানভাসের মতো।

সভ্য সমাজে এক জোড়া নারী পুরুষকে এক সঙ্গে ধরে রাখার বন্ধন মাধ্যম হিসেবে প্রেমের স্থান সবার আগে। ব্যতিক্রম ছাড়া প্রত্যেক মানুষ সমস্ত জীবনে ছয়বার প্রেমে পড়েন যার শুরু তেরো/চৌদ্দ বছর বয়সে। বলাবাহুল্য এটি স্থায়ী প্রেম নয়। যদি এই প্রেম- প্রেম ভাবসময় আরো অন্তত চার বছর এগিয়ে যায় তবেই প্রকৃত প্রেমের সূচনায় সিক্ত হন প্রেমিক প্রেমিকা।

যেহেতু আমরা বেনুর সাথে সম্পর্কের পূর্বে আর কোনো কিশোরী/রমনীর সাথে সিকানদারের লিপ্ততার কোনো সূত্র খুঁজে পাচ্ছি না তাই বলতে পারি বেনুই প্রথম মানবী যার মুখচ্ছবির সাথে সিকান্দারের প্রেম-মানচিত্রে আঁকা মানবী মিলেমিশে একাকার হয়েছিল। বিবিধ প্রসঙ্গের রবীন্দ্রনাথকে মনে পড়ছে: ‘এ ভাবগুলির সহিত তোমাকে আরও কিছু দিলাম, সে তুমিই দেখিতে পাইবে। সেই গঙ্গার ধার মনে পড়ে? সেই নিস্তব্ধ নিশীথ? সেই জ্যোৎ¯œাালোক? সেই দুইজনে কল্পনার রাজ্যে বিচরণ, সেই মৃদু গভীর স্বরে গম্ভীর আলোচনা? সেই দুজনে স্তব্ধ হইয়া বসিয়া থাকা? সেই প্রভাতের বাতাস সন্ধ্যার ছায়া। একদিন সেই ঘনঘোর বর্ষার মেঘ, শ্রাবণের বর্ষণ, বিদ্যাপতির গান? তাহারা সব চলিয়া গিয়াছে। কিন্তু আমার এই ভাবগুলির মধ্যে তাহাদের ইতিহাস লেখা রহিল। এই লেখাগুলির মধ্যে কিছুদিনের গোটা কতক সুখ-দুঃখ লুকাইয়া রাখিলাম, এক এক দিন খুলিয়া তুমি তাহাদের øেহের চক্ষে দেখিও, তুমি ছাড়া আর কেহ তাহাদীগকে দেখিতে পাইবে না। আমার এই লেখার মধ্যে লেখা রহিলÑএক লেখা তুমি আর আমি পড়িব, আর এক লেখা আর সকলে পড়িবে।’ বেনুর পছন্দের টুকটুকে লাল রং এর পেয়ারা, বিশালাকৃতির দুটি আম গাছ, বাঁশিতে ভোরের ভৈরবী কিংবা গভীর রাতের বেহাগ এগুলোর সাথে সম্পর্ক সিকান্দারের, তাই বৈপরীত্য সত্ত্বেও মিল অমিলে রবীন্দ্রনাথের এই লেখা হতে পারতো পরবর্তী প্রজন্মের কবি সিকান্দার আবু জাফরেরও। এ প্রসঙ্গকে আরো দীর্ঘায়িত করতে হবে। তার আগে আবার সিকান্দার প্রসঙ্গ: ‘সিকান্দার আবু জাফর ও বেনুর এই প্রেম কাহিনী উভয় পরিবারের সকলে জেনেছিলেন এক পর্যায়ে। বেনুকে সিকান্দার আবু জাফর সমগ্র অন্তর দিয়েই জীবন সঙ্গিনী করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাঁধার সৃষ্টি করলেন তার ছোট চাচা সৈয়দ শরফদ্দিন হাশেমী। তিনি কিছুতেই এ বিয়ে হতে দিলেন না। তড়িঘড়ি করে বেনুকে অন্যত্র বিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করলেন। বিয়ের দিন স্থির হলে বেনু বিষ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়। তার অভিভাবকরা সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার আনলেন, ডাক্তারের আপ্রাণ চেষ্টায় বিষক্রিয়া থেকে মুক্ত হলো বেনু। কিন্তু দারুনভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লো। সেই অসুস্থতা থেকে সে আর মুক্ত হতে পারলো না। শ্বশুর বাড়িতেই মাস তিনেকের মধ্যে ধীরে ধীরে সেই বিষক্রিয়ার প্রভাবে সে মৃত্যুর বুকে হারিয়ে গেলো।’… বেনুর মৃত্যুর পর শামসুজ্জামান৫ সিকান্দার আবু জাফরকে খুঁজতে থাকেন। এক সময় ১১/বি পার্ল রোডের একটা ভাড়াটিয়া বাসায় তাকে পেয়ে যান। বেনুর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে সিকানদার শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়েন।’

পূর্বে উল্লেখিত বিবিধ প্রসঙ্গের লেখা প্রকাশের পর রবীন্দ্র অভিভাবককুল নতুন বৌঠান ‘কাদম্বরী দেবী’র সাথে কিশোর রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক নিয়ে বিশেষ চিািন্তত হয়ে পড়েছিলেন। এই জটিলতার দ্রুত অবসান প্রয়োজন ছিল ঠাকুরবাড়ির আভিজাত্য এবং সামাজিক মর্যাদার প্রশ্নে। রবীন্দ্রনাথের সাথে ভবতারিনীর বিয়ের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্র অভিভাবককুল সমাজ অস্বীকৃত পরিণয় সম্পর্কের সমাধান খুঁজেছিলেন। কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যায় শেষ পর্যন্ত এই নাটকীয় অঙ্কের সমাপ্তি ঘটেছিল।

বেনুর সাথে সিকানদারের সম্পর্ক জটিলতায় রবীন্দ্র-কাদম্বরীর সম্পর্কের সমান ছিল না কিন্তু সিকান্দারের অভিভাবক বিশেষ করে ছোট চাচা এই সম্পর্ক কিছুতেই মেনে নিলেন না। সম্ভবত পরিবারের অন্য সদস্যদেরও এতে মত ছিল। পরবর্তীতে বেনুর আত্মহননের চেষ্টা, পরিনামে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সিকানদার- বেনু নাট্যাংশের অন্তিম পর্দার পতন যেনো পূর্বেবর্ণিত ঠাকুরবাড়ির ঘটনারই পুনর্নির্মাণ।

যদি বেনুর অসময়ে বিয়ে না হতো, যদি বেনু আত্মহত্যায় ব্যর্থ হয়েও শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর অচেনা মরুতীর্থে হারিয়ে না যেতো তাহলে কী এই প্রেম শেষ পর্যন্ত স্থায়ী হতো? এটা বলা কঠিন। কারণ উত্তরকালের একাধিক ঘটনাবলীর একত্র সেলুলয়েডিক মিথক্রিয়ার বিশ্লেষণ আমাদের ‘না’সুচক হাইপোথেটিক্যাল সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে দেয়। কিন্তু ঘটনা ঘটল। বেনুর মৃত্যু হলো। বেনু এক বিশাল কষ্টের প্রগাঢ় ছায়ায় ঢেকে দিতে সক্ষম হলো অস্থির-চঞ্চল-বেপরোয়া প্রায়যুবক সিকান্দার আবু জাফরকে। যার একের পর এক স্মৃতি সাক্ষী হয়ে থাকলো সিকান্দারের কবিতা ও গানে। সে সমস্তের শৈল্পিক চেহারা কেমন তা নিয়ে আমরা পরে আলোচনা করবো।

গোপন সুড়ঙ্গের মতো সুবিপুল জীবনের গভীরে অনুভবের অস্তিত্ব একবার প্রবাহিত হলে তা যে সামান্য মৃত্যুতে শেষ হয় না, বিশেষ করে যদি তারা হন অনুভূতির বরপুত্র, সৃষ্টির বিচিত্রিতায় একক স্রষ্টা সেতো নতুন কিছু নয়। অনুভবের যে গাঢ়তা নতুন বৌঠানকে একাধিক গ্রন্থ উৎসর্গের প্রেরণা যোগায় রবীন্দ্রনাথের এও যেন ঠিক একই অনুভূতির অক্ষরশিল্প, সিকানদার আবু জাফরের ছোটগল্পের বই ‘মাটি আর অশ্রু’র উৎসর্গ পত্র:

‘মৃত্যুর কষ্টি পাথরে জীবনকে তুমি যাচাই করে গেছ। পৃথিবীকে কিছু দাওনি। শুধু আকাশে এঁকে গেছ গোধুলির আল্পনা। তোমার অশ্রু ভাগিরথীতে আমার নিস্ফল বেদনার এই ক্ষীণ উপলদ্ধিটুকু যেন পথ খুঁজে পায়।’ কবিতায়-গানে-গদ্যে, নতুন মানবীর সাক্ষাতে সে পথ হয়ে উঠেছিল আরো বর্ণিল। সেই উপলদ্ধির রং ছিল কালো। কালো রং কেবল বেদনার নয় শোকেরও। ঝড় ছিল স্বল্প সময়ের, কিন্তু সে ঝড় ছিড়ে নিয়ে গেলো বৃন্ত ছিড়ে সবচেয়ে সুন্দর ফুলটিকে। যে-মুহূর্তে এতোটুকু সূর্যের ইঙ্গিত এলো প্রাণে, যে-মুহূর্তে হৃদয়ের প্রান্তদেশ ভরে গেলো গানে সে-মুহূর্তে কালো অন্ধকার বন্ধ করে দিয়ে গেলো প্রদোষের দ্বার।… তখনি বৈশাখী এসে দিয়ে গেছে ছিড়ে জীবনের পুষ্পবৃন্তটির (সৌর পৃথিবী, প্রসন্ন প্রহর) কিন্তু জীবন স্থবির নয়। বৃন্ত ছেড়া ফুল আর ফেরে না। কিন্তু রেখে যায় ভাবনার আদিগন্ত ক্ষেত। বেদনার রং এক সময় ফিকে হয়। নতুন প্রজাপতির ওড়াউড়ির চেষ্টায় নতুন ফুল ক্রমশ পাপড়ি ছড়ায়: সেই নিরানন্দ ঝড় তবু নহে একান্ত বিফল কিন্তু সেতো রেখে গেছে চিন্তার সম্বল। (সৌর পৃথিবী, প্রসন্ন প্রহর) বেনুর বিয়ের খবর একেবারেই শেষ সময়ে জানতে পেরেছিলেন সিকান্দার। কলকাতা থেকে ফিরেও এসেছিলেন। কিন্তু রাতের অন্ধকার সরিয়ে লাঠিয়ালদের বিনিদ্র পাহারায় বেনু শ্বশুরবাড়ি চলে গেলো। সেই রাত ছিল অন্ধকারের অধিক। সে রাত ছিল শীতল। উষ্ণতার প্রয়োজনে কবি ছটফট করেছিলেন সে রাতে। মুক্তি মেলেনি।

দ্বিজাতি তত্ত্বের পাকিস্তানও আলো ফোটাতে পারেনি রাজনীতি-সংস্কৃতি-মানবিক বোধে উদ্দীপ্ত সিকান্দারের মনে। ১৯৪৭ পরবর্তী রাতগুলোই তাই সিকান্দারের কাছে ছিল বেনুর শ্বশুরবাড়ি যাত্রার রাতের মতো নিরানন্দ, অস্থির, অন্ধকার ও বেদানবহ। কিন্তু তার হৃদয় ছিল বিক্ষুব্ধ। প্রসন্ন প্রহর কাব্যগ্রন্থের ‘সেইরাত্রি’ কবিতা: প্রথম পাঠ: প্রসঙ্গ প্রেম মুন্সী আকরামুজ্জামান (মধু মিয়া) ‘যে রাত্রিতে বেনুর বিয়ে হলো এবং শ্বশুর বাড়ি চলে গেলো, সে রাত্রির কথা তিনি (সিকান্দার আবু জাফর) লিখেছেন একই গ্রন্থের (প্রসন্ন প্রহর) সেই রাত্রি কবিতায়Ñ সে রাত্রির নীরবতা রোমাঞ্চ আনেনি রক্তপায়ী শকুনেরা দিয়েছিলো হানা, বিবেকের সুন্দরের সম্ভ্রম জানেনি সর্বজয়ী হয়েছিলো উদ্ধত বাসনা। সে রাত্রির আলিঙ্গন বসন্ত আনেনি এনেছিল শ্মশানের চরম রিক্ততা।

দ্বিতীয় পাঠ: প্রসঙ্গ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতা অধ্যাপক আবদুল হাফিজ, ‘কবি কোথাও সাম্রাজ্যবাদ কথাটি উচ্চারণ করেননি, করতে চাননি। কিন্তু আর্টের সীমানা না ডিঙিয়ে তিনি তার বক্তব্য রেখেছিলেন নির্দ্বিধায়।’ আগামী দিনের কবি গাথায় কথায় সঙ্গীতে জাগিয়ে রেখো সে-দুঃসহ ব্যাথা আগামীকালের শিল্পী শোনিত স্বাক্ষরে হৃদয়ের প্রেক্ষাপটে এঁকো সেই কথা। উপরোক্ত দুটি পাঠের তুলনামূলক বিশ্লেষণ আমাদের এই সত্যে উপনীত হতে সাহায্য করে যে, সিকান্দারের কবিতার বহুমাত্রিক পাঠ সম্ভব, বিশেষত প্রেমের কবিতাগুলো। বাংলা একাডেমির প্রকাশ সিকানদার আবু জাফর রচনাবলির সম্পাদক আব্দুল মান্নান সৈয়দ মনে করেন কুড়ি বছর বয়সে সিকান্দার প্রথম সার্থক কবিতা নির্মাণে সফল হন। কৈশোরে পদ্যচর্চা একেবারেই করেননি এমনটা না হলেও তিনি সে সময় মূলত গদ্য সাহিত্যেরই চর্চা করে এসেছেন। সিকান্দার চল্লিশের দশকের কবি। পঞ্চাশ ও ষাটে বিস্তার। ১৯৬৫ তে ‘প্রসন্ন প্রহর’, তিমিরান্তিক, বৈরী বৃষ্টিতে’ এই ত্রয়ী কবিতার বইয়ের মধ্য দিয়ে কবি হিসাবে স্বতন্ত্র রং ছড়িয়েছেন সাহিত্যিক পরিম-লে। ত্রিশের স্বেচ্ছা নির্বাসন ও বিচ্ছিন্নতার পাল নামিয়ে চল্লিশের মুসলমান কবিরা সমসাময়িক হিন্দু সমাজের শৈল্পিক-সামাজিক-মানবিক প্রেক্ষাপটে আধুনিক হয়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আশা-আকাক্সক্ষা-আবেশ-অনুভূতির অনুবাদকের ভূমিকা গ্রহণ করে কবিতাকে করে তোলেন সমাজমনস্ক, জনকল্যাণমুখী এবং এই অর্থে আধুনিক। সাম্যবাদের ডাক শেষ পর্যন্ত তাদেরকে সাম্যবাদী না করলেও দুর্ভিক্ষ, দুঃশাসন, দাঙ্গা, দেশ ভাগ ইত্যাদির বিষ ছোবলের বিরুদ্ধে তাদেরকে করে তুলেছিলো প্রতিবাদী, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের কবি।

সিকান্দার আবু জাফর এর ব্যতিক্রম নয়। ‘প্রসন্ন প্রহর’র রচনাকাল একুশ থেকে উনত্রিশ বছর বলে হয়তো, কিংবা বেনুর আত্মহনন চেষ্টা ও মৃত্যু অথবা অন্য কোনো অজানা কারণে সিকান্দার প্রবলভাবে দেশ-কাল চেতন হয়েও নিরন্তর একই সাথে লিখে গেছেন প্রেমের অমর কবিতা। প্রেমের সেইসব পদাবলির সাথে ব্যক্তি জীবন মিলিয়ে পাঠ নেয়া যেমন সম্ভব তেমনি প্রেমের কবিতায় রহস্যময়তাও আমাদের দিকচক্রাবলে শিল্পের সুলুকসন্ধানে ব্রতী হতে কখনো কখনো উৎসাহিত করে। সিকান্দারের জীবনে নিরন্তর নারীর প্রবেশ তার পরবর্তী কবিতা গ্রন্থে সন্নিবেশিত ‘প্রেমের কবিতার’ উৎস, মূল চালিকাশক্তি কিনা সেটা যেমন এখনও নির্ণিত হয়নি তেমনি মুন্সী একরামুজ্জামান কথিত বেনু কাহিনীই যে সিকান্দারের প্রেমের কবিতার একমাত্র প্রতœ-পটভূমি তাও সত্যের কষ্টিপাথরে যাচাইকৃত নয়। মেয়েদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে থাকেন যে সমস্ত পুরুষ কেমন তারা? পছন্দের তালিকার শীর্ষে এই অর্থে আদর্শ পুরুষের চিত্র অংকন করতে পারতেন নারীরাই শুধু। তা হয়নি অবশ্য। মেয়েদের কাছে পুরুষের রূপের কদর বিয়ের আসরেই সীমাবদ্ধ, এটা একটা পুরাতন প্রবাদ। শ্লোকটিÑ কন্যা বর যতে রূপম মাতা বিত্তং পিতা শ্রুতিং বান্ধরা: কলুমিচ্ছন্তি মিষ্টান্ন মিতরে জনা

কিন্তু এটিকে নির্ভেজাল সত্য ধরে নিতে কষ্ট হয়। কারণ এটির রচয়িতা যেমন একজন পুরুষ তেমনি এটি বিশেষ কোনো গবেষণার প্রাপ্ত ফল নয়। তবে সন্দেহ নেই হবু বরকে পাত্রী অবশ্যই কামের দৃষ্টিতে, কামের দৃষ্টি দিয়ে একবার পরোখ করে নেন। এর সাথে যে বুদ্ধির দীপ্তি চৌকষ বলা-চলা, মানবিক গুণাবলীর অহং, রসবোধে স্বতন্ত্র ইত্যাদি গড়পড়তা বাঙালি নারীর চেয়ে কিছু বেশি শিক্ষিতা, সুন্দরী, সুরুচি সম্পর্না নারীদের পছন্দ, সিকান্দার ছিলেন সম্ভবত তেমনই।

কলকাতার জীবনে সিকান্দার প্রায় সময় বন্ধু পরিবেষ্টিত থাকতেন। এদের মধ্যে নারীর সংখ্যাও ছিল উল্লেখযোগ্য। এদের সকলের সাথেই যে সিকান্দারের বন্ধুত্ব ছিল তা অবশ্য নয়। অনেকে ছিলেন তার আশ্রিতা সম্পর্কিতও। সুরুচি, শিক্ষিতা-সুন্দরী, অগ্রবর্তী সংস্কৃতির অধিকারী এই সকল রমনীকূলের সাথে তার সম্পর্ক ছিল খুবই সহজ, আনন্দের। ১৯৪৬ এ সিকানদার যখন কলকাতার মেয়ে ‘পুষ্প যেন’ কে বিয়ে করেন তখন তিনি এতটাই নারীলিপ্ত ছিলেন যে, ‘সিকান্দার কলকাতায় মিনি পতিতালয় চালাতেন’ এমন একটি অসত্য-অসতর্ক-ভ্রম মন্তব্য সাহিত্যিক, কবি, সৈয়দ আলী আহসান তার আত্মজীবনীতে লিখে গেছেন। পুষ্প সেন সিকান্দারের পূর্ব পরিচিত ছিলেন। বিয়ের প্রয়োজনে ধর্মান্তরিতও হয়েছিলেন। নার্গিস খানমÑএই নতুন নাম গ্রহণ করেছিলেন। উপরোক্ত ঘটনাগুলো যদি ঠা-া মাথায় বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে আমরা দেখতে পাবো প্রথমত: পুষ্প যেন ও সিকান্দারের মধ্যে এক দীর্ঘ সাংস্কৃতিক ঐক্য ছিল। দ্বিতীয়ত: পুষ্প সেনই প্রথম নারী যিনি প্রেমে ও কামে ছিলেন সিকানদারের প্রেম মানচিত্রের প্রথম সম্পূর্ণ ও যোগ্য মানবী।

পত্রিকায় প্রকাশযোগ্য খবর সংগ্রহের চেয়ে সুন্দরী নারী জোগাড় করা সিকানদারের কাছে অধিকতর সহজ ছিল।৭ এটা তার সকল সহকর্মী বন্ধু বা পরিচিতজন মাত্রই জানতেন। তা সত্ত্বেও একথা ভাবলে আশ্চর্যই হতে হয় যে, ১৯৭১ সালের পূর্ব পর্যন্ত নারী লিপ্ততায় আর কোনো বিশেষ খবরের শিরোনাম হননি সিকানদার। প্রেমে ও কামে পুষ্প সেনই এই সময়, এই দীর্ঘ দুই যুগ সিকানদারকে নিরন্তর সঙ্গ দিয়েছেন, সিকান্দারের কলমে শিল্পের সব পুষ্পকে নিজের মতো করে বিকশিত করার সুযোগ করে দিয়েছেন। ঘরে বাইরে থেকেছেন বন্ধুর মতো, গৃহীর মতো ছায়া-প্রচ্ছায়ায় চির নতুনের মতো। প্রেমেÑসংরাগেÑসংগ্রামে, সাফল্য-ব্যর্থতায় প্রবল সিকান্দারকে পুষ্প সেনই একমাত্র ধারণ করতে পেরেছিলেন এই সময়ে। প্রেমের কবিতায় সিকান্দার এসবের চিহ্নকে এড়িয়ে গেছেন। প্রেমের কবিতাগুলো বিরহের এক কল্প জগতে ক্রমাগত ঠাঁই খুঁজে পেয়েছে শেষ পর্যন্ত। বলে রাখি সিকানদারের কবিতায় এটাই অবশ্য একমাত্র নয় যে কেবল বিরহেই তিনি সীমাবদ্ধ ছিলেন। শিল্পের দাঁড়িপাল্লায় সিকান্দারের প্রেমের কবিতা নজরুলের কবিতার ভাবঐক্যে আত্মীয় এমনটাই মনে করেন গবেষক প্রাবন্ধিক মাহবুবা সিদ্দিকী।৮ কিন্তু সূচকে নজরুল একমাত্র নন। যেমন নন কিশোরী বেনু, পূর্ণ যৌবনা পুষ্প সেন কিংবা কাজী রোজী, পরকীয়ার শাসনে-বাঁধনে যিনি সিকান্দারকে জড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন দ্বিতীয় স্ত্রীর মর্যাদায়।

বিয়ে হচ্ছে দুজন নারী-পুরুষের কিছু শর্ত সাপেক্ষে একত্রে বসবাসের সামাজিক অঙ্গীকার। বিয়ের কারনে দুটি হৃদয় বা দুটি শরীর পাস্পরিক দাসত্বে এক হবে এমনটা মনে করা ভুল। বিয়ে কাউকে কারও উপর প্রভূত্ব করার অধিকার নেয় না। চুক্তির শর্ত মেনে দু’জন নারী পুরুষ একত্রে ঘরকন্যা করলেও মানুষ হিসেবে তারা তাদের মৌলিক স্বাধীনতা হারায় না। সুতরাং বৈবাহিক সম্পর্কের ভেতরে ও বাইরেও আসতে পারে প্রেম, নারী অথবা পুরুষের জীবনে স্বতন্ত্রভাবেই। আর প্রেম যখন আসে তখন সে বিবাহিত অথবা অবিবাহিত এরকম হিসাব নিকাশের সময় থাকে না। এমনকি সামাজিক অনুশাসনও এ ক্ষেত্রে শত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির ক্ষমতা রাখলেও তা প্রেমিক প্রেমিকার কাছে হয়ে ওঠে একান্তই গৌন। সুতরাং জীবনে কখনো কখনো এমন বাস্তবতা তৈরি হয় যে ‘পরকীয়া প্রেম’ হয়ে ওঠে খুব জরুরি কোনো কিছু। সিকানদার বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ‘বাঙালির ম্যাগনাকার্টা’ ছয় দফার সমর্থক ছিলেন। কিন্তু রাজনীতির সুনামিস্রোতে তিনি অংশ নেননি। হারিয়ে যাননি। ছয়দফা কেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক জাগরণে সকল মানুষকে অংশে, প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ করাই ছিল তার প্রচেষ্টা। যখন তিনি সাংস্কৃতিক অভিভাবকত্বের প্রসিদ্ধ পুরোহিত তখন পরকীয়ায় জড়িয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী কাজী রোজীর সাথে। কাজী রোজী ছিলেন সিকান্দারের আত্মীয় এবং রোকেয়া হলের আবাসিক। নারী বদলের শিল্পী হিসেবে সুখ্যাতি ছিল পিকাসোর। পিকাসোর জীবনে নারীর আগমন ও প্রস্থান ছিল জোয়ার ভাটার মতো প্রাকৃতিক। থেরেসা মে ছিলেন তাদেরই একজন, তবু তিনি সৌন্দর্যে, শিল্প ও পিকাসোর প্রতি আনুগত্যে ছিলেন অনন্য। নিজের অনিন্দ্য সুন্দর মুখশ্রীকে পুড়িয়ে কুৎসিত করতে চেয়েছিলেন পিকাসোর জন্য। পিকাসোর ছবির প্রয়োজন। কিন্তু একথাও সত্য থেরেসাই একমাত্র নারী যিনি পিকাসের অনিচ্ছা সত্ত্বেও পিকাসোকে পরিত্যাগ করেছিলেন কোনো এক সময়। পুষ্পসেন সিকান্দারের প্রতি আনুগত্য, সৌন্দর্য, সহনশীলতা ও পূর্ব পুরুষের যাবতীয় সংস্কার ত্যাগে ছিলেন থেরেসার চেয়ে অভিজাত, নক্ষত্র পুঞ্জের মতো দীপ্তিময়। কাজী রোজীর সাথে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ার কারণে নার্গিস সিকান্দারকে ত্যাগ করেননি, ভৎসনা করেননি বরং সিকান্দারের মৃত্যুর পরেও তিনি সিকান্দারের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও মননশীলতাকে সযতেœ লালন ও প্রচারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। এসব সত্ত্বেও কেনো সিকান্দার কাজী রোজীর সাথে পরকীয়ায় জড়িয়েছিলেন, বিয়ে করেছিলেন, আবার শেষ পর্যন্ত প্রকৃত দাম্পত্য সম্পর্ককে দীর্ঘায়িত করেননি তা এখন পর্যন্ত রহস্যাবৃতই রয়ে গেছে। একথাও সত্য সিকানদারের কবিতায় বিশেষত তার যে কবিতাগুলোর প্রধান ভাব প্রেম যেখানেও জীবনের এইসব আলো অন্ধকারের ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথে ‘কবিতার সত্য জীবন সত্যের’ সাথে সমান্তরাল এগিয়েছিল। এমনকি শেষ পর্যন্ত তারা এক বিন্দুতেও মিলেছিল শেষ অবধি। সে কারণে দুর্বলতা ও দুর্ধর্ষতায় যে রবীন্দ্রনাথকে পাই আমরা ব্যক্তিসত্ত্বার বিপুল বৈভবে তাকেই আবার পাঠ করতে পারি তার সৃষ্টির মরু-পর্বত সমতলে। কিন্তু সিকান্দারের কবিতার সত্য সব সময় কি জীবনসত্যের সমান্তরাল ছিল? সবক্ষেত্রে যে নয় সেটা নিয়ে লুকোছাপা চলে না। কিন্তু কেনো? জীবনের দীপালোকে সিকান্দার সমাজ সচেতন, গণমুখী চেতনার ধারক, সাম্রাজ্য ও কর্তৃত্ববাদ বিরোধিতায় প্রতিবাদী ছিলেন জীবন সত্যে এবং কবিতার সত্যেও। কিন্তু তার উচ্ছলতা, উজ্জ্বলতা, মেজাজী বেপরোয়া চিত্তের বিপরীতে আশা-নিরাশায় সংক্ষুব্ধ দোলায়িত চিত্তবৃত্তির কারণে তার হৃদয়ের যে গহনশূন্যতা যেখানে শেষ পর্যন্ত কি কেউ প্রবেশ করতে পেরেছিলেন? প্রতিটি বিপ্লব সংগ্রামে সমাজ এগিয়ে যাবে সিকান্দার এমনটাই মনে করতেন, কিন্তু যখন এই গতি হয়েছে শ্লথ, বিপরীতমুখী তখনই সিকান্দারের মনে তৈরী হয়েছে হাহাকার, সেই হাকাকারই কি প্রতিরূপ পেয়েছে নাটকীয় বিরহ যন্ত্রণার ইস্পাত কুসুমিত চরণে। সিকান্দারের প্রেম বিষয়ক কবিতা পাঠ ও পর্যায়ক্রমিক বিবেচনায় আমার তো তেমনটাই মনে হয়েছে।

প্রেমের কবিতা পাঠ: স্বপ্ন-কল্পনা, প্রেম-বিরহ রাগ-অভিমান-ক্ষোভ, লক্ষবস্তুর নতুন নিশানা বিরহ নিয়েই বাংলা সাহিত্যের উদ্বোধন ঘটেছে। (চন্দন আনোয়ার ৬৩)৯, রাধা-কৃষ্ণের প্রণয় লীলা, ময়মনসিংহ গীতিকা, মধ্যযুগের অনুবাদ সাহিত্য, মঙ্গলকাব্য সর্বত্রই বিরহই মূল আকর্ষন।

তাই বলা চলে বিরহই প্রেম-সাহিত্যের পাওয়ার হাউস। সাহিত্যের বিষয় হিসাবে প্রেম শুধু যে প্রাচীন, চিরন্তন তাই নয়, নদীর মতো বহমান বাঁক বদলে বদলে চিরনতুনও। মধ্যযুগের সাহিত্যে বিরহ প্রধানতম মান্য বিষয় না হয়ে উপায় ছিল না। কারণ দেবতার হস্তক্ষেপে প্রেমের স্বাভাবিক বিকাশ ছিল রুদ্ধ। দেবতাগণ মর্তের লীলার পর এক সময় আবার স্বর্গে ফিরে যেতো সাধারণ নমুনায়নে রাধাকৃষ্ণ আখ্যানটি এ প্রসঙ্গে পুনরুক্তি করতে পারি। রাধা-কৃষ্ণের যাবতীয় সম্পর্ক একান্তই মানবিক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেবত্ব আরোপ করতে যেয়ে জীবাত্মা ও পরমাত্মা বিষয়ক ধোঁয়াশা ডেকে আনা হলো। কচ ও দেবযানী উপাখ্যানও একই সত্য বহন করে। কচ তার পার্থিব শিক্ষা শেষ করার পর গুরু কন্যা দেবযানীর প্রেম উপেক্ষা করে স্বর্গে ফিরে যায়, দেবযানীর অভিশাপ সাথে করে। এটাই রবীন্দ্রনাথে পাই। অবশ্য আমাদের সৌভাগ্য বাঙলা সাহিত্যে অন্যান্য সকল ক্ষেত্রের মতোই রবীন্দ্রনাথই প্রেমকে একই সাথে করে তুললেন জীবনমুখী ও বিশ্বজনীন। শারীরিক ও স্পর্শহীন হলেও সে প্রেম একান্তই মানুষের রূপ অরূপের বিনির্মাণ।

এরপর গোবিন্দ দাস, মোহিতলাল মুজমদার, নজরুল ইসলাম, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ হয়ে বাংলা সাহিত্যে প্রেম দাঁড়িয়ে গেলো নতুন ভূমির উপর। রবীন্দ্রনাথের মানস সুন্দরী ছিল নিরুদ্দেশের যাত্রী। নজরুলের প্রেমিকারা লিবিডো চেতনায় রঙে রাঙানো রক্ত মাংশের জীবন্ত মানুষ। আরো স্পষ্ট করে বললে বলতে হয় রক্ত-মাংশের নারী। তবে নজরুলের নারী আকাক্সক্ষার আড়ালে যে প্রেম তা মূলত প্রেমের সার্বভৌম শক্তির উদ্বোধন। যৌবন শক্তির উদ্যমতায় বসন্তের ধুপছায়ায় নজরুলের প্রেম সর্বদাই পরিবর্তনের ঝড় তোলে প্রেমিক-প্রেমিকার মনে। জীবনানন্দ দাশের প্রেম ও লিবেডিক কিন্তু আপাদ মস্তক বিষন্নতায় মোড়া। এই প্রেম একান্তভাবেই মর্তের। মর্তের তবে দৈহিক ভোগ সর্বস্ব ত্রিশের প্রেম থেকেও অনেকটা ভিন্ন। সিকানদার আবু জাফরের প্রেমের কবিতা এই জায়গাতেই নজরুল থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং বহুলাংশে জীবনানন্দীয় ঘরানার। সুতরাং পূর্ববর্তী গবেষকরা৯ যেভাবে সিকানদার আবু জাফরের প্রেমের কবিতাকে আপাদ-মস্তক ঐক্যে নজরুলের কবিতার সাথে তুলনা করেছেন তা সম্পূর্ণ সঠিক নয়। এটা ঠিক বৈচিত্রের পুষ্পহার সত্ত্বেও সিকান্দার আবু জাফরের প্রেমের কবিতায় মূল সুর বিরহ। নজরুলেরও তাই কিন্তু সিকান্দার কোনোভাবেই নজরুলের উত্তরাধিকার নয়। বরং উভয় কবিই সার্থকভাবে বাংলা কবিতার ঐতিহ্যকে, বিরহ বন্দনাকে নিজ নিজ ক্ষমতায় তাদের কবিতায় প্রয়োগ করেছেন। কবি সিকান্দার আবু জাফর তার প্রিয়াকে বিশেষ কোনো নামে ডাকেননি। এমনকি তার চেহারা দেখতেও চান না। কবি শুধু এটুকু জানেন মেয়েটি পর্দার ওপারে বসে রোজ গান করে। কেমন তার গান? কবির কাছে তার গান ‘গলার দরজা খোলা খাঁচা থেকে একঝাক পায়রার বাইরে বেরিয়ে আসার মতোই সাবলীল। তবে সবকিছুর পরও কবি তার প্রিয়ার মাঝে চাষা বৌয়ের রূপ খুঁজে পেতে চান: মেয়েটিকে দেখিনি। হয়তো সে কদাকার হয়ত তার বয়স আমি যা চাইব তার চেয়ে অনেক বেশী, অথবা অনেক কম। পাঁচহাতি জড়ানো শরীরের দিকে তাকিয়ে চাষা বৌয়ের রূপ দেখা যাবে কি? (‘তেতলার মেয়েটি’ তিমিরান্তিক)

কবির প্রিয়া আধখানা পর্দা-ঢাকা জানালা দিয়ে নানান রূপে বারবার আত্মপ্রকাশ করুক এটাই কবির প্রার্থনা তাই জন্যে কবি প্রিয়ার মুখ দেখতে চান না। কবি প্রেমের ছলা-কলা জানলেও প্রেম নিবেদনে থাকতে চান সাধারণ, নিরাভরণ। ‘…অনুশীলনের পথে পথে ঘুরে সাহস কুড়িয়ে নিজেকে লুকিয়ে হঠাৎ কখন গোপনে বলার পরিচিত প্রথা তাও যে মানিনি; শুধুই বলেছি সহজ গলায় নিরুত্তাপেই তোমাকে বলেছি যে কথা বলার কত না দিনের কঠিন প্রয়াস।’ (‘নিরাভরণ’ বৈরী বৃষ্টিতে)

শত দুঃখ, হাজারও কষ্টের সীমায় দিশেহারা কবি তার প্রিয়াকে তাই সাহস না হারিয়ে এতটুকু না বাড়িয়ে অথবা রঙ ফলিয়ে তার ভালোবাসার কথা প্রকাশ করেন। সম্মতির জন্য কবি অস্থির হয়ে ওঠেন প্রিয়াকেও অস্থির করে তোলেন। প্রতিশ্রুত সন্ধ্যায় চূড়ান্ত সম্মতি পাননি কবি কিন্তু তিনি হতাশ নন, দায়ী করেন না তার প্রিয়াকে, কারণ তিনি জানেন: ‘আমরা যে সমাজের জীব তারই ধারায় তুমি ভাসমান তৃণ। ইতিহাস পরিবর্তনের দিন এলে হৃদয় নিয়ে তুমি খেলবে না,…’ (‘গতানুগতিক’ তিমিরান্তিক) মানুষ মাত্রেই তো ভিখারি। কেউ আলোর কাছে কেউ বা অন্ধকারের। কেউ বা প্রকৃতির কাছে কেউবা প্রেমের। কবি প্রেমের ভিখারি। তাই তো কবি তার প্রিয়াকে জন্মদিনের উপহার পাওয়া গাড়িতে যোগ্যতম বন্ধুর পার্শ্ববর্তিনী দেখেও আশা করেন জীবনের সুখ-দুঃখ-আঘাত- বেদনা-দারিদ্রকে তার প্রিয়ার সাথে ভাগ করে নিতে, এভাবেই তিনি কাছে পেতে চান তার প্রিয়াকে: ….যা আসে আসুকÑ আছি তো আমরা দু’জনে ভাগ করে নেবো দু’জনেই। স্বচ্ছ আকাশে ঘন মেঘ নিশিবর্ণ রচে যাবে কভু বিহ্বল প্রেতরাত্রি, তাই ভেবে যত অর্থবিহীন কম্পন, কাজ নেই কাজ নেই, যা হবার হবেÑ আছি তো আমরা দু’জনে ভাগ করে নেবো দু’জনেই। (‘দুজনে’ তিমিরান্তিক)

শুধু এভাবেই নয়। কবি লিবিডো প্রেমের স্পর্শও প্রত্যাশা করেন তার প্রেমিকার কাছে। প্রেমিকার শরীরে দেখতে পান ‘অনাদি কালের আবিষ্কার অসম্ভব কুবেরের ভুলুণ্ঠিতব্য ধনাগার’। সেই ধনাগারের ছবি: ‘…তোমার ঠোঁটের বৃত্তে আবর্তিত আত্মহত্যার প্ররোচনা তোমার পীনস্তনের ভারে বিধ্বস্ত শূন্যতা অবয়বহীন আকুল দু’টি হাত নিতম্বের মাত্রাবব্ধ গতির সঙ্গীতে সমস্ত বিবর্ণ মুর্ছা মুহূর্তে জঙ্গম তোমার নিটোন জঙ্গার প্রহরা আড়ালে অনাদিকালের আবিষ্কারÑঅসম্ভব কুবেরের অলুন্ঠিতব্য ধরাগার’। (‘সম্পূর্ণ তোমাতে’ বৈরী বৃষ্টিতে) সব বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে, নদী-সমতল-পাহাড়-সমাজ ডিঙিয়ে কবি এক সময় তার প্রিয়ার সাথে মিলিত হন একান্তে। কবি তার প্রিয়ার কাছ থেকে এমন সবকিছু পান যা কবির নেই, ছিল না কোনো দিন, কবির অপেক্ষার দিন শেষ হয়ে গেছে। শেষ হয়েছে বিরামহীন ক্লান্ত-স্বপ্নে রাত্রি জাগা প্রহরগুলোর, কবির সকল স্বপ্নে তখন বসন্তের প্রস্তুতি। সেই প্রস্তুতির শেষে আত্মদানের উদ্দামতা: মধু যৌবনা হাজার ফুলের বধুঁর ভূমিকা শেষে লজ্জাবিহীন দক্ষিণ সমীরণ মনটা যখন হঠাৎ রাঙিয়ে দিল তৃষ্ণা এবং তপ্ত সুরার সুনিবিড় সম্পর্কে ভাবনাগুলোকে আদিম নেশার আগুনে ঝলসে নিয়ে তাকাতেই দেখি নাগালের গন্ডীতে ইঙ্গিত আঁকা অমৃত-কুম্ভ তুমিই প্রথমে মেলেছো আমন্ত্রণ। মুহূর্তে তুমি প্রিয়া, এবং তোমাকে আত্মদানের তখুনি উদ্দামতা। (‘সম্ভাবনা’ বৈরী বৃষ্টিতে) উদ্দামতার শেষে অনিমেষ তৃপ্তি: ….চোখে মুখে বুকে তার ¯িœগ্ধ স্পর্শ টেনে সমস্ত অস্তিত্ব যেন হঠাৎ মর্যাদা পেলো তৃপ্ত জীবনের। আমার আকাশ দুই খন্ড শুভ্র-স্ফীত মেঘের নরম আমার চেতনা আর হৃদয়ের দ্রুতত্রস্ত ধ্বনি একাকার হল এক দেহে। (‘অবশেষে’ কবিতা ১৩৭২)

একালের একজন প্রসিদ্ধ মার্কিন কবি আমিরী বারাকা কবিতা প্রসঙ্গে লেখেন, কবিতা জীবনের কথা লেখে আর জীবন লেখে তার প্রাপ্তি অপ্রাপ্তিকে। কবি সিকান্দার আবু জাফরের প্রেমের কবিতায় আমরা এই প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কথা দেখতে পাই বেলা শেষের বারবেলাতে। কবি নরকে যেতে চান। কারণ তার প্রেমিকারও নরক বাস নিশ্চিত। যদিও স্খলনের পূর্ণদায়ভার চাপাতে চান তার প্রেয়সির কাঁধে ঃ ‘নিষিদ্ধ পুরুষ আমাতে তোমার প্রেমশুদ্ধ তপ্ত ছায়া ফেলেছিলে। তোমার শরীর থেকে চেটে চেটে সে গন্ধের মদ রসে কতবার পরিতৃপ্ত-তৃষ্ণা সমাজ নাবিক; সেই মদ প্রেমের গেলাসে ভরে আমার অধরে তুলে ধরেছিলে অবারণ পূর্ণিমার নিয়ন্ত্রণে? স্খলনের পূর্ণ দায়ভাগী তুমি অতএব আর তাই সুনিশ্চিত নীতিবাক্যে বিজ্ঞাপিত নরকে তোমার গতি। (‘গন্তব্য নরকে’ কবিতা ১৩৭৪)

প্রেমিকার সাথে এই নিষিদ্ধ মেলামেশায় কবির বিক্ষত হৃদয় নিখাদ সুবর্ণে রূপান্তরিত হয়। নরকে বিধি নিষেধের শাস্ত্রী থাকে না। কবি তখন সম্রাটের মতো ‘মৃগ কস্তরী সলিলে অশেষ গহন মত্ত আনন্দ মরাল হয়ে’ মিলবেন প্রেমিকার সাথে। বস্তুত এই নরকে কবি শুধু তার সেই প্রেমিকাকে প্রত্যক্ষ করেন, যিনি সমাজ স্বীকৃত নয়। এই প্রেম কবির পূর্ববর্তী প্রেম ভাবনা থেকে একেবারেই অন্যরকম।

১৯৭২ সালে প্রকাশিত ‘কবিতা ১৩৭৪’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো বিশেষত ‘গন্তব্য নরকে’ কবিতাটি রচিত হয় ১৯৭০-৭১ সালের কোনো এক সময়ে। এর আগেই সিকান্দার নতুন প্রেম, পরকীয়ায় জড়িয়েছিলেন কাজী রোজীর সাথে। তখন সম্পর্কের অন্তিম পর্ব প্রায়। আমি পূর্বে উল্লেখ করেছি এবং দেখিয়েছি সিকান্দারের জীবনতরীতে মুখ্যত যে তিনজন নারী পাল উড়িয়েছেন তাদের প্রভাব সিকানদার তার কবিতায় যেনো সচেতন ইচ্ছাকৃত এড়িয়েছেন। তবে জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীর ছবি যখন বিবর্ণ হয়ে, ফ্রয়েডিয় মনোবিশ্লেষণ তত্ত্বে যেটাকে বলা হচ্ছে অবচেতন, সেখানে চলে যায় তখন কবির অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেসব ছবি ভাসতে থাকে কবিতায়। এগুলোকে ব্যতিক্রম হিসাবে চিত্রিত করা হয়ে থাকে। ‘গন্তব্য নরকে’ সিকান্দারের এমনই একটি ব্যতিক্রম প্রেমের কবিতা যা তার প্রেমছোঁয়া কবিতার মূল স্রোতের মধ্যে না যেয়েও সৌন্দর্য ও শিল্পসুষময় উজ্জ্বলতীব্র। শেষ পর্যন্ত আমাদের সিদ্ধান্ত নিতেই হয় ‘গন্তব্য নরকে’ পরকীয়া ভাবনার কবিতা এবং সে পরকীয়া গহন কবি মনের, ব্যক্তি জীবনের নয়। কবি সিকানদার আবু জাফরের প্রেমমানস বুঝতে হলে আমাদের বারবার যে কবিতার দারস্থ হতে হয় সেটি হচ্ছে ‘কখনো স্মরণে এলে’ এটি ‘কবিতা ১৩৭৪’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। এটি একটি কনফেকশনাল কবিতা। প্রকৃতির দোহাই পেড়ে কবি এখানে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। তার স্বীকারোক্তি বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই যখনই কোনো প্রেম বন্ধন তৈরি করে তখনই তার ভিতরে এক ধরনের যন্ত্রণা/অস্বস্তি তৈরি হয় এই যন্ত্রণা/অস্বস্তি তাকে প্ররোচিত করে নতুন সম্পর্ক স্থাপনের। বলাবাহুল্য পুরাতন সেই সম্পর্ক যাকে তিনি স্বেচ্ছায় ত্যাগ করেন, প্রেমিকার উপর দোষ চাপিয়ে তিনি এক ধরনের বিরহের আস্বাদ নেন এবং এভাবেই তিনি তার নতুন সম্পর্কটির যৌক্তিকতা তুলে ধরতে চান তার পাঠকের কাছে। একথা বলা নিশ্চিয় সিকান্দার আবু জাফরের প্রতি অবিচার করা হবে না যে, তিনি প্রেমিক হিসাবে ব্যক্তি জীবনে এবং রচিত কবিতায় কখনই বিশ্বস্ত ছিলেন না। কবি প্রেমের সিস্ফনি রচনায় মোটেই বিশ্ব¯স্ত নন তাই প্রেমিকার ভালোবাসা তার কাছে সবসময় পুরাতন মিথ্যা ছলনাময় বলেই মনে হয়:Ñ মেহেদী রাঙানো হাতের ছাপের প্রণয় স্মারক বহুদিন মুছে গেছে। মন যে উধাও পৃথিবী ছাড়িয়ে জরিপ চলেছে আয়তন তারকার মনের ঠিকানা পুরনো বস্তী সেখানে কে আর বাসিন্দা হতে যাবে। (‘পুরোনো বস্তী’ কবিতা ১৩৭৪) ‘যে ভাবতে জানে যে বিরহে ভাসতে জানে’ রাজনীতি, সংস্কৃতি, প্রেম ইত্যাদি নিয়ে কবির ভাবনা অনিশেষ কবি তার সকল বিরহের কবিতায় প্রেমিকাকে যে সমস্ত দোষে দোষী করেছেন তার একটা ছক করা যাক: ক. কবির ভালোবাসায় একাত্ত হতে ব্যর্থ ‘আমার জানালা থেকে নিষ্ফল আগ্রহে ফিরে ফিরে যে আকাশ দেখি তোমার জানালা থেকে ব্যকুল দৃষ্টিতে সে আকাশ কখনো দেখোনি।’ (‘আকাশ’ প্রসন্ন প্রহর)

খ. কবির ভালোবাসার প্রতিদানে প্রেমিকা তাকে কিছুই দেন না। দেখেছি তোমার কালো চোখে স্বপ্নের আলোকে ইঙ্গিতের ডানামেলা দুটি নীল পাখী আমার বসন্তে তারা বাঁধল না কোনদিন হৃদয়ের রাখী। (‘অশ্রুর স্বাক্ষর’ প্রসন্ন প্রহর)

অবশ্য কবি কখনও কখনও আত্ম সমালোচনাও করেন। অসাফল্যের দায় কাঁধে নেন পরোক্ষে। কবি সর্বদাই নতুনের প্রত্যাশী। কী জীবন জিজ্ঞাসায়, কী প্রেমে। প্রত্যেকটি প্রেমপর্ব শেষে তিনি পুর্নর্বার শরীর মনে বসন্তের শিহরণ অনুভব করেন। বিরহ তাই স্থায়ী হয় না। বিরহ হারিয়ে যায় প্রেমে প্রেমে। প্রেমিকাকে ফিরে পাওয়ার প্রত্যাশা বিরহের সুসমাচার নিয়ে এলেও তা যে কেবল পুরাতনের জন্য একথা ভাবতে দ্বিধাই জাগে। কবির স্বীকারোক্তি, কবির স্বেচ্ছাচারী মনের অন্তরালে অন্য এক মন রয়েছে কবির দুঃখ সেই মনের সন্ধান কেউ করতে চায় না, অথচ কবি তাকেই চান যিনি এটা করবেন কবি বারবার বলতে চান সেই নতুনের খোঁজে তিনি হয়ে উঠেন স্বেচ্ছাচারী। আর এমনই দুর্ভাগ্য যে এই স্বেচ্ছাচারী রূপের কারণেই তিনিও একাত্ত হয়ে থাকতে পারেন না তার প্রিয় মানুষীর সাথে। এ কারণেই বারবার প্রেমিকার বদল এ যেনো এক গোলক ধাঁধা। ‘আমাকে দেখোছো তুমি ক্ষমাহীন ক্ষিপ্ত স্বেচ্ছাচারী দেখোনি আমার চোখে অবিশ্রান্ত বেদনার ঝরঝর বারি সে মন দেখোছো যার বক্ষতলে মরুর প্রদাহ সে মন দেখোনি যার দিকে দিকে উচ্ছ্বসিত আনন্দ প্রবাহ।’ (‘দুই ধারা’ প্রসন্ন প্রহর)

লক্ষণীয় সিকান্দার আবু জাফরের এই সংকোচ স্বীকারোক্তি ’৬০ এর অন্যতম প্রধান কবি সুনীলসহ অন্যান্যের কনফেকশনাল কবিতা থেকে বেশ একটু ভিন্নতায় নতুনের বার্তাবাহী। কবি, গীতিকার, কথাশিল্পী, সাংস্কৃতিক সংগঠক তারপরেও সিকানদার আবু জাফর সমকাল সম্পাদক। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী। প্রজ্ঞা ও মেধার সাহসী ব্যবহারে নেতৃপ্রতীম। আমাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রার সহযাত্রী তার কবিতা। কবি হিসাবে অসম্ভব জনপ্রিয়তার কারণও সেটি। কাব্য পরিক্রমার মূল নৈবেদ্য দেশ-কাল-চেতনার সাথে সংযুক্ত। তার রচিত প্রেমের কবিতা তার অতি বিচিত্র নারী লিপ্ততার সমান্তরাল হয়তো নয় তবে ঐতিহ্যের আত্মীকরণে, জীবন জটিলতায়, আধুনিকতার উদ্বোধনে, শব্দ ও ছন্দের সচেতনতায় এগুলো বাংলা কবিতার অতুলনীয় সম্পদ।

তথ্যসূত্র ১. লা রোশফুকো (১৬১৩-১৬৮৩) এর পরিচিতি একজন মরালিস্ট হিসেবে। যদিও তিনি একজন দার্শনিকও বটে। জন্মসূত্রে ফরাসি। মূলত তার লেখা ম্যাক্সিমগুলোর জন্য তিনি আজও সাহিত্য, দর্শন ও জ্ঞানের ক্ষেত্রে আলোচিত। ম্যাক্সিম হলো ‘মনুষ্যহৃদয়ের এক আলেখ্য’ এবং এ গুলোর আধুনিকতা বর্তমান শতকের মানুষদেরও স্তম্ভিত করে দেয়। বাংলায় রোশফুকোর ম্যাক্সিমগুলোর অনন্য সাধারণ অনুবাদ করেছেন চিন্ময় গুহ। ২. কাম সম্পর্কে বেদে বলা হয়েছে ‘কাম’ শুধু যৌনাকাক্সক্ষা নয়, মঙ্গলাকাক্সক্ষাও। মহাভারত এবং পুরান মতে সৃষ্টিতে মনকে শৃঙ্খলিত এবং ইন্দ্রিয়কে সংযত রাখা বিশেষ প্রয়োজন। কারণ ক্রমাগত কামনার বৃদ্ধি মানুষকে ক্ষত-বিক্ষত এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে ধ্বংসও করতে পারে। কামনার যেহেতু ধ্বংস হলেও মৃত্যু নেই, এটি আবার বেঁচে ওঠে তাই একে পরিবর্তিত করতে পারার মধ্যে আধ্যাত্মিক চেতনার বিকাশ সম্ভব। মৎস্য পুরান মতে কামের জন্মস্থল ব্রহ্মার হৃদয়। অথর্ব বেদ মতে কাম শ্রেষ্ঠ দেবতা। সুতরাং জন্মের পর কাম যতই অজাচার করুক না কেনো মানুষের অসীম সৃষ্টি ক্ষমতার প্রতি শেষ পর্যন্ত আস্থা রাখা হয়েছে। বিস্তারিত জানতে শামীম আহমেদের ‘মহাভারতে যৌনতা’ গ্রন্থটি দেখা যেতে পারে। ৩. মুন্সী আকরামুজ্জামান সিকান্দার আবু জাফরের বাল্য বন্ধু তার স্মৃতি কথাটি কাজী মুহম্মদ অলিউল্লাহর সিকান্দার আবু জাফর নামক গ্রন্থটিতে সংকলিত আছে। এটির প্রকাশক হাতেখড়ি। ৪. এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে তাহা ইয়াছিন সম্পাদিত কথা প্রকাশের ‘প্রেম’ নামক বইটি দেখা যেতে পারে। ৫. মোঃ শামছুজ্জামান বেনুর ভাই। ৬. অগ্রসর পাঠক ‘জীবনের শিলান্যাস’ নামক সৈয়দ আলী আহসানের স্মৃতিকথাটিতে খোঁজ খবর করতে পারেন। ৭. বিখ্যাত সাংবাদিক এবং গ্লোব নিউজ এজেন্সির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সত্যেন মজুমদার। সিকান্দারের সাথে এর বিশেষ সখ্যতা ছিল। সত্যেন মজুমদারের অনুরোধে সিকান্দার আবু জাফর অল্প কিছুদিনের জন্য গ্লোব নিউজ এজেন্সিতে সংবাদ সংগ্রহের কাজ করেছিলেন। সম্ভবত সিকান্দার এই কাজে বিশেষ মনোযোগী ছিলেন না। উক্ত মন্তব্যটি তারই করা। সত্যেন মজুমদারের মূল স্মৃতিকথাটি আমি দেখিনি। প্রাসঙ্গিক অংশটি রয়েছে ‘সমকাল ১৩৮২’ তে প্রকাশিত ‘নেতৃচরিত্র বন্ধু সিকানদার আবু জাফর’ শীর্ষক সৈয়দ আলী আহসানের লেখাটিতে। ৮. প্রসঙ্গে মাহবুবা সিদ্দিকীর বাংলা একাডেমির প্রকাশ ‘সিকান্দার আবু জাফর : কবি নাট্যকার’ গ্রন্থটি দেখা যেতে পারে। ৯. নজরুল সাহিত্য : প্রসঙ্গ প্রেম, চন্দন আনোয়ার। গতিধারা প্রকাশিত বইটি বিস্তারিত জানতে সাহায্য করবে।