জাতিসংঘকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে নিরস্ত্র ফিলিস্তিনি বিক্ষোভাকারীদের ওপর গুলি ছুঁড়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। গুলি ছোড়ার পূর্ব ঘোষণা উপেক্ষা করে এদিন গাজার পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তে শুক্রবারও (৬ এপ্রিল) বিক্ষোভে নামে ফিলিস্তিনিরা। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিয়েছে, তারা তাদের গুলি ছোড়া নীতি থেকে সরবে না। তা সত্ত্বেও ১৫ মে পর্যন্ত টানা ছয় সপ্তাহ ভূমি দিবসের বিক্ষোভ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণায় অনড় ফিলিস্তিনিরা। এই অবস্থায় সেখানে ভয়াবহ রক্তপাতের আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।শুক্রবারের নতুন সহিংসতায় ৩ জনের নিহত হওয়ার খবর দিয়েছে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম হারেৎজ। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে উদ্ধৃত করে দেড় শতাধিক মানুষের আহত হওয়ার কথাও জানিয়েছে তারা।
ভূমি দিবস উপলক্ষে ফিলিস্তিনিদের টানা ছয় সপ্তাহের বিক্ষোভের দ্বিতীয় পর্বে শুক্রবার দিন জোরালো বিক্ষোভের কর্মসূচি সফল করতে আগে থেকেই প্রস্তুতি নেয় ফিলিস্তিনিরা। বৃহস্পতিবার (৫ এপ্রিল) ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী আভিগদর লিবারম্যান বৃহস্পতিবারই গুলি ছোড়া অব্যাহত রাখার হুমকি দিয়ে রাখেন। এদিন তিনি বলেন, ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ নীতিমালায় পরিবর্তন আনার কোনও ইচ্ছে নেই। ইসরায়েলের সরকারি রেডিওতে তিনি বলেন, ‘কোনও ধরনের উত্তেজনা দেখা গেলে গত সপ্তাহের মতো করেই কঠোরভাবে জবাব দেওয়া হবে।’
তবে হুমকি উপেক্ষা করে ভূমি দিবসের কর্মসূচি সফল করতে মাঠে নামে ফিলিস্তিনিরা। গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এদিন গাজা সীমান্তের নিরাপত্তা বেড়ার পাঁচটি স্থানে বিক্ষোভে সামিল হয়। হারেৎজের খবরে বলা হয়েছে, পশ্চিম তীরের নাবলুস, আল-বিরেহ, রামাল্লাহ ও হেবরন এলাকায় সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমটির খবরে দাবি করা হয়েছে, ফিলিস্তিনিদের বিক্ষোভে থেকে ইসরায়েলের সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধে পাথর ও মলোটোভ ককটেল ছোঁড়া হয়। সেনাবাহিনী গুলি ছুঁড়ে পাল্টা জবাব দেয়।
ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ আন্দোলনকে ‘সংগঠিত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ আখ্যা দেয় ইসরায়েল। সহিংসতার জন্য গাজা এলাকা নিয়ন্ত্রণে নির্বাচিত সংগঠন হামাসকে দায়ী করে দেশটি। তবে এই অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেছে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনের সংগঠনটি।
এক বিবৃতিতে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী বৃহস্পতিবার জানায়, ইসরায়েলের বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা দেওয়া নিরাপত্তা অবকাঠামো ও বেড়ার কোনও ক্ষতি তারা বরদাস্ত করবে না। এধরণের আক্রমনের সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে হুমকি উপেক্ষা করেই বিক্ষোভে নামে ফিলিস্তিনিরা। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, দেশটির প্রতিরক্ষা বাহিনীর হিসাবে শুক্রবারের অন্তত ৫০ হাজার ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারী জড়ো হয়েছেন। ভূমি দিবস উপলক্ষে টানা ছয় সপ্তাহের বিক্ষোভে শামিল হতে ইসরায়েলের সীমান্ত ঘেঁষে তাবু ফেলে ওই এলাকায় জড়ো হয়েছেন তারা। গত সপ্তাহে এই বিক্ষোভে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গুলি ছুঁড়লে অন্তত ১৮ জন নিহত হয়। ‘গ্রেট মার্চ অব রিটার্ন’ নামের এই বিক্ষোভ চলাকালে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় আহত হয় আরও ১৫০০ মানুষ।
গত শুক্রবারের বিক্ষোভে ১৮ জনের প্রাণহানির পরও আজকের (শুক্রবারের) কর্মসূচির আগেই সেখানে দুই ফিলিস্তিনি নাগরিক নিহত হয়। কর্মসূচিকে সামনে রেখে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সতর্কতা জারি করা হয়। এক বিবৃতিতে জাতিসংঘ মহাসচিব অান্তোনিও গুতেরেস বলেন, বিশেষত ইসরায়েলকে বল প্রয়োগের ক্ষেত্রে হতাহতের ঘটনা এড়াতে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করার আহ্বান জানাই। অবশ্যই বেসামরিক নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের অধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। আমি মাঠে থাকা সব পক্ষকেই সংঘর্ষ থেকে বিরত থেকে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানাই।
জাতিসংঘের সতর্কতা উপেক্ষা করে চালানো হামলায় আহতদের মধ্যে অন্তত ১০৭ জন সরাসরি ইসরায়েলি বাহিনীর গুলির শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে ৫ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদের মাথা ও শরীরের ওপরের অংশে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তাদেরকে গাজার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অন্য আহতদের বেশিরভাগ ধোঁয়ার কারণে শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হয়েছেন। নিহত দুইজনের নাম প্রকাশ করেছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তারা হলেন ৩৮ বছর বয়সী ওসামা খামিস ও প্রায় একই বয়সী মাজদি সাবাত। নিহত অপর এক কিশোরের নাম জানা যায়নি।
রাজনীতি বিশ্লেষক মোহসেন আবু রমজান মনে করেন, ফিলিস্তিনের নিরস্ত্র নাগরিকদের নিশানায় পরিণত করাটা ইসরায়েলের বিশেষ করে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন সরকারের ‘পুরনো নীতির নতুন উপস্থাপন’ মাত্র। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘আমার আশঙ্কা, বিক্ষোভে অংশগ্রহণ ঠেকাতে এ ভয়ঙ্কর নীতির আওতায় যত বেশি সংখ্যায় পারা যায় ফিলিস্তিনিদেরকে নিশানায় পরিণত করা অব্যাহত থাকবে।’
আবু রমজান মনে করেন, ইসরায়েল বিক্ষোভকে সামরিক সংঘাতের দিকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে। তিনি বলেন, ‘বিক্ষোভের শান্তিপূর্ণ ধরন ইসরায়েলকে সংশয়ী করে তুলেছে। সম্প্রতি গাজা সীমান্তে ইসরায়েল সেনা সংখ্যা এবং বিস্ফোরক ডিভাইসের প্রদর্শনী বাড়িয়েছে। বিক্ষোভকারীদের মধ্যে বন্দুকধারী রয়েছে বলেও ধারাবাহিকভাবে দাবি করে যাচ্ছে তারা। ফিলিস্তিনিদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে টেনে আনার জন্য এমনটা করা হচ্ছে; এ যুদ্ধক্ষেত্রে ইসরায়েল আধিপত্য দেখাতে পারে।’ হামাসের মুখপাত্র আব্দেল লতিফ বলেছেন, ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতে জড়ানোর জন্য এ আন্দোলন করা হচ্ছে না। এ বিক্ষোভকে জনগণের বিক্ষোভ উল্লেখ করে তিনি বলেন, অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি হামাসও এ বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে। সামনের দিনগুলোতে নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য বিক্ষোভকারীদের সংখ্যা আরও বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
গাজার উম্মাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান আবু আমির মনে করেন, ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদেরকে মুক্তভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে দেবে না। আল জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে ইসরায়েল এ বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার চেষ্টা করবে।’
উল্লেখ্য, ১৯৭৬ সাল থেকে প্রতিবছর ৩০ মার্চ ইসরায়েলের দখলদারিত্বের প্রতিবাদে ‘ভূমি দিবস’ পালন করছে ফিলিস্তিনিরা। ওইদিন নিজেদের মাতৃভূমির দখল ঠেকাতে বিক্ষোভে নামলে ইসরায়েলি সেনাদের হাতে ৬ ফিলিস্তিনি নিহত হন। তাদের স্মরণেই পালিত হয় ভূমি দিবস। ২০০৭ সাল থেকে গাজা অবরুদ্ধ করে রেখেছে ইসরায়েল। সেখানকার ৭০ শতাংশ মানুষই ফিলিস্তিনের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিতাড়িত হয়ে সেখানে এসে বাস করছেন। এবছর ওই দিনটি স্মরণে বিশাল বিক্ষোভের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগামী ১৫ মে পর্যন্ত এই বিক্ষোভ চলবে। দ্য গ্রেট রিটার্ন মার্চ’ নামে এই বিক্ষোভটি প্রতি বছর আয়োজিত হলেও এবার এতে ভিন্নতা রয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরায়েরেলের রাজধানী স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা এবারের ভূমি দিবসকে ভিন্নতা দিয়েছে।