অনলাইন ডেস্ক: আটবার বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাসান। শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারেননি। গেল বছর শেষ হয় সরকারি চাকরির বয়সসীমা। এখন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য চেষ্টা করছেন।
একাডেমিক শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার আগেই চাকরির পেছনে ছুটেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী। শ্রেণিকক্ষে না গেলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে যাওয়া হতো প্রতিদিন। পাঠ্যবইয়ে চোখ না রেখে চাকরির প্রস্তুতির জন্য বিভিন্ন গাইড বই পড়েই দিনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে তার। বয়সসীমা শেষ হওয়ার আগে মরণপণ চেষ্টা করেছিলেন। তাতেও ‘বিসিএস ক্যাডার’ নামক সোনার হরিণ দেখা দেয়নি। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে পাস করে হাসান এখন অনেকটাই হতাশাগ্রস্ত। বলেন, মনে হয় যৌবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট করলাম। এত শ্রম দিয়ে কী লাভ হলো! এখন মনে হচ্ছে, শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য থেকে অনেক দূরে সটকে পড়েছি। ‘কোন দেশের রাজধানী কী, আর কোন দেশের টাকার মান কত’ এরকম শিক্ষাতেই যেন আটকে থাকলাম। অথচ কত কিছুই না জানার ছিল। লাইব্রেরিতে লাখ লাখ বই। তা ছুঁয়েও দেখিনি কোনোদিন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৫ সালে মাস্টার্স করে চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন খাদিজা সুলতানা। তিনবার বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। ক্যাডার হওয়া হয়নি এখনও। তবুও বিসিএস-ই ধ্যানজ্ঞান তার। বলেন, জানি না স্বপ্ন পূরণ হবে কি না। কিন্তু হাল তো ছাড়তে পারি না। তবে নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস রেখে খাদিজা বলেন, আজকের উচ্চশিক্ষিত বেকারদের যে সমস্যা, তার জন্য মূলত শিক্ষাব্যবস্থা এবং নিয়োগ ব্যবস্থাই দায়ী। একজন মেধাবীকে পরিকল্পিতভাবে এই অভিশপ্ত জীবনের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। এর জন্য রাষ্ট্রকেই দায়ী করছি। রাষ্ট্র আমার অধিকার হরণ করছে। খাদিজা বা হাসানের মতো জীবনকথা এখন লাখ লাখ উচ্চশিক্ষিত তরুণের। সবাই যেন মরীচিকার পেছনে ছুটছেন। রাষ্ট্র কর্তৃক সৃষ্ট কথিত সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই উচ্চশিক্ষিতদের এমন দৌড়। সরকারি চাকরি মানেই ‘সোনার হরিণ’। মেধা, অর্থ, সময় সব ঢেলে দিচ্ছেন সরকারি চাকরির প্রত্যাশায়। অসুস্থ এই প্রতিযোগিতা-ই যে দুর্নীতি, অনিয়মকে উসকে দিচ্ছে, তা-ও যেন সবাই ভুলে গেছেন। বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) সাবেক চেয়ারম্যান ড. সা’দত হোসাইন। এই প্রতিবেদকের কাছে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, শিক্ষাব্যবস্থায় ত্রুটি আছে। যে প্রস্তুতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্রের শ্রমশক্তিতে যোগ দিচ্ছে, তা সঠিক বলে মনে করি না। এভাবে চাকরি পেয়ে অনেক আমলা ইংরেজিতে একটি চিঠি লিখতে পারেন না। তিনি বলেন, মেধার মূল্যায়নে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছিলাম আমার সময়ে। ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছিলও। কিন্তু সম্ভব হয়নি। জানা যায়, ৩৮তম বিসিএস পরীক্ষায় দুই হাজার ২৪টি পদের বিপরীতে তিন লাখ ৪৬ হাজার ৫৩২ জন প্রার্থী আবেদন করেন। একই চিত্র সরকারি অন্যান্য চাকরির বেলাতেও। যেন এগিয়ে যাওয়া বিশ্বে পিছিয়ে পড়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে দেশের উচ্চশিক্ষিত তরুণরা। আর রাষ্ট্রই যেন সে প্রতিযোগিতায় ঠেলে দিচ্ছে উচ্চশিক্ষিতদের। অন্তত এমনটিই মনে করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাস করা মেহেদী হাসান। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় পড়া শেষ করে ছয় বছর সরকারি চাকরির পেছনে ছুটেছি। এখন বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। মেহেদীর ক্ষোভ ‘চাকরির প্রস্তুতির সময় যা শিখেছি, তা এখন খুব কাজে লাগছে বলে মনে করি না। অথচ ছয়টি বছর জীবন থেকে চলে গেল, যা শেখার কথা, তাও শিখতে পারিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে।’ চাকরির পেছনে ছুটতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের মেধা বিশেষ এক জায়গায় আটকে যাচ্ছে কি না- এমন প্রশ্ন করা হলে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বলেন, প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়েই বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে। প্রস্তুতি নিয়েই চাকরির প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, সে প্রতিযোগিতাটা আসলে কী? চারুকলার একজন শিক্ষার্থী তার শিল্পচর্চা রেখে তো বিসিএস পরীক্ষার জন্য উঠেপড়ে লাগতে পারে না। একই প্রশ্ন তোলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। বলেন- ‘বিষয়টি আমিও খতিয়ে দেখেছি। বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিতে নিয়মিত শিক্ষার্থীরা এখন বসতে পারে না। সাবেক শিক্ষার্থীরা চাকরির পড়া পড়তে সকাল থেকেই লাইন ধরে। বিসিএস পরীক্ষাই একমাত্র পন্থা তাদের কাছে। অবাক করার মতো বিষয়। চাকরিতে পদের সংখ্যা কম। এ কারণেই এই প্রতিযোগিতা। কিন্তু এভাবে উচ্চশিক্ষিতদের মেধা আটকে যেতে পারে না। চাকরি নিয়ে শিক্ষার্থীদের চিন্তার পরিবর্তন আনতে হবে। আর এই পরিস্থিতির জন্য রাষ্ট্রকেই আগে ভাবতে হবে।’