নিজস্ব প্রতিবেদক: সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের দুর্নীতিবাজ প্রশাসনিক কর্মকর্তা এসএম মাহাবুববর রহমান অবশেষে চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। জেলা পরিষদের পুকুর ও খেয়াঘাট ডাকে অনিয়মসহ বিভিন্ন দুর্নীতির প্রতিবাদে সদস্যদের কাছে ক্ষমা চাওয়ার এক পর্যায়ে বৃহষ্পতিবার বিকেল ৫টার দিকে তিনি পরিষদ চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত সহকারী শাহানা পারভিনের কাছে এ পদত্যাগপত্র জমা দেন। সাতক্ষীরা জেলা পরিষদ সদস্য অ্যাড. শাহানাজ পারভিন মিলি জানান, অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে জেলা পরিষদ প্রশাসক এসএম মাহাবুবর রহমানকে বিগত জেলা পরিষদ নির্বাচনের পরদিন স্থানীয়রা অফিসে এসে লাঞ্ছিত করে। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে আব্দুর রউফ কমপ্লেক্সে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে জেলা পরিষদের টাকা খরচ করার অভিযোগে তদন্ত হয়। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্তে নেমেছ দুদক। বদলি সংক্রান্ত হাইকোর্টের খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে মাহাবুবর রহমান সুপ্রিম কোর্টে গেলে কোন সুবিধা করতে না পেরে আবারো বহাল থাকেন সাতক্ষীরা অফিসে। একপর্যায়ে বৃহষ্পতিবার দুপুর ২৯টি পুকুর ইজারা সংক্রান্ত টে-ার ও বিকেল চারটায় মাসিক মিটিং আহবান করেন মাহাববুর রহমান। শ্যামনগরের নওয়াবেকী খেয়াঘাট ইজারার নামে ছয় লাখ টাকা নেওয়াসহ বিভিন্ন খেয়াঘাট ও পুকুর ইজারা দেওয়ার নাম করে বহু টাকা নিয়ে তিনি তার ব্যক্তিগত খরচ করেছেন এমন বিষয় জানতে পেরে বৃহষ্পতিবার দুপুর আড়াইটার দিকে সদস্যদের সঙ্গে তার বচসা হয়। এসময় তার উপর চড়াও হলে তিনি ক্ষমা চেয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে চাকরি থেকে অব্যাহতি নেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। একপর্যায়ে বিকেল ৫টার দিকে মাহাবুবর রহমান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত সহকারীর কাছে তার ইস্তফা পত্র জমা দিয়ে চলে যান। তবে আগামী মাসিক সভায় আব্দুর রউফ কমপ্লেক্সে জেলা পরিষদের টাকা বন্ধ করে দেওয়ার ব্যাপারে সদস্যরা সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানান। জানতে চাইলে জেলা পরিষদ প্যানেল চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম বাবু মোবাইল ফোনে মাহাবুবর রহমানের ইস্তফার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। প্রসঙ্গত, সদর উপজেলার মাটিয়াডাঙা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রউফের ছেলে এস,এম মাহবুবুর রহমান ১৯৯০ সালের ২৯ এপ্রিল সাতক্ষীরা জেলা পরিষদে ষাটলিপিকার (টাইপিষ্ট) হিসাবে অস্থায়ী নিয়োগ পান। পরবর্তীতে অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে একই অফিসের প্রশাসনিক কর্মকর্তার দায়িত্ব পেলে তাকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ২০০১ সালের ২৬ জুন পঞ্চগড় জেলা পরিষদে বদলী করেন। হাইকোর্টে বদলী আদেশ স্থগিত হলেও পরবর্তীতে তিনি প্রত্যাহার করে নেন। ২০০৫ সালের ১৪ জুন তাকে জামালপুর জেলা পরিষদে বদলী করলে তার যোগদানপত্র গৃহীত হয়নি। অপরদিকে গত ২০০৫ সালের ১৯ আগস্ট সাতক্ষীরা জেলার চার জন সংসদ সদস্য এস, এম মাহবুবের বিরুদ্ধে শ্যামনগর উপজেলা পরিষদের মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটের ৬৪টি গৃহ বন্দোবস্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে অর্ধ কোটি টাকা উৎকোচ গ্রহণ, জেলার বিভিন্ন খেয়াঘাট লক্ষ লক্ষ টাকা উৎকোচ গ্রহণের মাধ্যমে পূর্ববর্তী ডাকের চেয়ে কম ডাকে ইজারা দেওয়া, নিজের এলাকার ও নিজ আত্মীয় স্বজনদের জেলা পরিষদে চাকুরি দিয়ে সি-িকেটের মাধ্যমে গডফাদার হিসেবে আত্মপ্রকাশ, একজন নিম্নমানের কর্মকর্তা হয়েও প্রধান নির্বাহীর মত উচ্চ মানের কর্মকর্তাকে হয়রানি ও হেনস্তার মধ্য দিয়ে বদলী করার কথা তুলে ধরে স্থানীয় সরকার ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে ডিও লেটার দেন। সাংসদরা আরো উল্লেখ করেন যে, অনেকগুলো অভিযোগকারীর অভিযোগের ভিত্তিতে তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোঃ জসিমউদ্দিন তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে এক প্রতিবেদন দাখিল করেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা মাহবুবর রহমানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণসহ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসক স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেন। ডিও লেটারে মাহাবুবর রহমানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ অথবা তার বিরুদ্ধে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি গঠনের মাধ্যমে তদন্ত করার জন্য দাবি জানানো হয়। কিন্তু কোন এক অদৃশ্য কারণে তার বিরুদ্ধে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ২০০৫ সালের ১৪ জুন বদলি আদেশ চ্যালেঞ্জ ও একই বছরের ১৯ আগস্ট চার সাংসদের উদ্দেশ্য প্রণোদিত ডিও লেটারের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মাহবুবর রহমান হাইকোর্টে -৬৯১৭/২০০৫ নং রিট পিটিশন দায়ের করেন। সেখানে সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী ভুইয়া মোঃ আতাউর রহমানের ২০০৩ সালের ১৭ জুনের একটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। প্রতিবেদনে সাতক্ষীরা জেলা ন্যাপ এর সাধারণ সম্পাদক কাজী সাঈদুর রহমানের অভিযোগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করা হয়। ১২ সেপ্টেম্বর আদালত শুনানীন্তে উক্ত আদেশের উপর রুল জারী করেন এবং বদলী আদেশ স্থগিত করেন। স্থগিতাদেশ থাকা অবস্থায় পরবর্তীতে তিনি সাতক্ষীরা জেলা পরিষদ থেকে তাহার বেতন ভাতা এবং রীট নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত চাকুরীতে যাহাতে স্থিতিবস্থা বজায় থাকে সে জন্য তিনি ২০০৫ সালের ৮ অক্টোবর একটি আবেদনপত্র দাখিল করেন এবং তা’ মঞ্জুর হয়। যাহা পরবর্তীতে খারিজ হয়ে যায়। এদিকে বদলী সংক্রান্ত একটি রীট পিটিশনের কার্যক্রম চালু থাকার পরও ২০০১ সালের ৮ মে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপ সচিব স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে প্রশাসনিক কর্মকর্তা এস,এম মাহবুবুর রহমানকে বগুড়া জেলা পরিষদে বদলী করেন। একটি বদলীর আদেশের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত রিট পিটিশনের কার্যক্রম চালু থাকার পরও নতুন করে দেওয়া বদলি আদেশেকে চ্যালেঞ্জ করে এসএম মাহবুবর রহমান বিষয়টি সংশ্লিষ্ট আদালতকে অবহিত না করে পুনরায় ৭৩৩৩/২০১৬ নং রিট পিটিশন দায়ের করেন। যা’ ২০১৬ সালের ১৩ জুলাই খারিজ হয়ে যায়। এদিকে জেলা পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এসএম মাহবুবর রহমানের বিরুদ্ধে ২০১২ সালের ১৮ আগষ্ট ‘গৃহ নির্মাণের তালিকা তৈরিতে দুর্নীতির অভিযোগ’ অনিয়ম সংক্রান্ত এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তাতে জলবায়ু ট্রাস্ট ফা-ের আওতায় গৃহণির্মাণের তালিকা তৈরিতে প্রশাসনিক কর্মকর্তা মাহবুবর রহমান ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা উৎকোচ গ্রহণ করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া ২০১৬ সালের ৮ আগস্ট জেলা পরিষদের আওতাধীন এডিবি ও নিজস্ব অর্থায়নে মন্দির, মাদ্রাসা, স্কল ভবনসহ জেলায় এক কোটি ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৪টি প্রতিষ্ঠান তৈরির জন্য উৎকোচের মাধ্যমে দরপত্র দলিল আহবানের ক্ষেত্রে তঞ্চকতা করেছেন মাহাবুবর রহমান। ফলে হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া দু’ শতাধিক ঠিকাদার দরপত্র সংগ্রহ করতে পারেননি। এ ব্যাপারে এসএম মাহাবুবর রহমানের কাছে বৃহষ্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে জানতে চাইলে তার ০১৭১১-৩৫২৭২০ মুঠো ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।