দেবহাটা

দেবহাটা উপজেলার ৫ শ্রেষ্ঠ জয়িতার সাফল্যের কাহিনি

By Daily Satkhira

April 27, 2018

কে.এম রেজাউল করিম, দেবহাটা ব্যুরো: দেবহাটা উপজেলার ৫ জন শ্রেষ্ঠ জয়িতার সফলতা ও স্বাবলম্বী হওয়ার কাহিনী। সবাই এখন নিজ নিজ কর্মে আর্ত্ম সামাজিকভাবে ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী। জয়িতা অন্বেষনে বাংলাদেশ শীর্ষক কর্মসূচির আওতায় ব্যাপক প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে দেবহাটার ৫টি ইউনিয়ন থেকে ৫ ক্যাটাগরিতে ২৫ জন শ্রেষ্ঠ জয়িতা বাছাই করার পরে উপজেলা কমিটি দেবহাটা উপজেলার ৫ শ্রেষ্ঠ জয়িতা নারীকে বাছাই করে। ইতোমধ্যেই যারা কঠোর পরিশ্রম আর প্রচেষ্টায় নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করেছেন। বর্তমানে তারা মর্যাদার সাথে সুখে শান্তিতে পরিবারের সদস্যদের সাথে বসবাস করছেন। কঠোর পরিশ্রম আর প্রচেষ্টায় নিজেদের ভাগ্য উন্নয়ন ঘটানোর কথা জানিয়েছেন জীবন যুদ্ধে জয়ী উপজেলার ৫ শ্রেষ্ঠ জয়িতা নারী। অর্থনৈতিক ভাবে সফল জয়িতা নারী সাজু পারভীন: উপজেলার সখিপুর ইউনিয়নের সখিপুর গ্রামের আব্দুর রহমানের কন্যা সাজু পারভীন অর্থনৈতিকভাবে সফল জয়িতা নির্বাচিত হয়েছেন। জন্মের পূর্ব থেকে তার পিতার পরিবারে অভাবের মাত্রা বেশি হওয়ায় ৮ম শ্রেণির পর আর লেখাপড়া করার সুযোগ হয়নি। এরপর তাকে বাল্য বিবাহে আবদ্ধ করা হয়। কিন্তু বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতেও দারিদ্রতা থাকার পরেও সংসার করার জন্য কাউকে কিছু না বলে স্বামীর বাড়িতে সংগ্রাম শুরু করেন। শ্বশুর বাড়ির লোকেদের চাহিদা মত টাকা পয়সা দিতে না পারায় দিনে দিনে নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকে সাজুর উপর। এরমধ্যে বছর ঘুরতে না ঘুরতে প্রথম সন্তানের জননী হন সাজু পারভীন। নির্যাতন সহ্য করে সাজু স্বামীর পরিবারে টিকে থাকায় গাত্রদাহ হতে থাকে সে পরিবারের সদস্যদের। ততোদিনে হয়ে গেছেন দ্বিতীয় সন্তানের জননী। নির্যাতনের এক পর্যায়ে কেরোসিন ঢেলে দিয়ে আগুন লাগিয়ে দিয়ে মারার পরিকল্পনা করে তারা। কিন্তু সাজুর বুদ্ধিমত্তাই বেঁচে যায় সে। অসুস্থ অবস্থায় সাজুর বাবা মা তাকে নিয়ে আসে হাসপাতালে। দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে অনেকটা সুস্থ হয় সাজু। বাপের বাড়িতে ফিরে তিনি নিজের ভরণপোষন ও বাচ্চাদের দেখা শোনার জন্য ঋন নিয়ে কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেন। অপরদিকে তার স্বামী গোপনে ২য় বিবাহ করেন। তার সাথে সকল প্রকার যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এরপর গ্রামে গ্রামে গিয়ে কাপড় বিক্রয় করে সংসার পরিচালনা শুরু করেন। কিছু দিন যেতে না যেতে ব্যবসায় লাভ হওয়ায় একজনকে নিয়োগ করে ভ্যানে করে কাপড়ের ব্যবসা করতে থাকেন সাজু। বর্তমানে তিনি সখিপুর মোড়ে একটি কাপড়ের দোকান দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। বর্তমানে সাজুর কন্যা ৫ম শ্রেণিতে এবং পুত্র ৩য় শ্রেণিতে লেখাপড়া করছে। ব্যবসার পাশাপাশি আনসার ভি.ডি.পি‘র প্রশিক্ষনটিও শেষ করে ফেলেছেন। সাজুর সংসার থেকে অভাব কেটে আলোর মুখ দেখেছে। সাজু নিজের মত অন্যদের ভাগ্য পরিবর্তনে কাজ করে যাচ্ছেন। শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী আফরোজা পারভীন: উপজেলার পারুলিয়া ইউনিয়নের পারুলিয়া গ্রামের তৌফিকুল ইসলামের স্ত্রী আফরোজা পারভীন উপজেলার শিক্ষা ও চাকুরীর ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচিত হয়েছেন। তাকে এস.এস.সি পাশের পর পিতা লেখাপড়ার খরচ যোগাতে না পেরে এক বেকার ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দেন। স্বামীর সংসারে ছিল খুব অভাব। স্বামী তার ও পরিবারের কোন দায়িত্ব নিতে রাজি ছিল না। তখন তিনি ঠিক করলেন তাকে আরো শিক্ষিত হতে হবে। তাই তো তিনি এলাকার ছেলে-মেয়েদের প্রাইভেট পড়ানোর দায়িত্ব নিলেন। সেই খরচ দিয়ে নিজে আবারো লেখাপড়া শুরু করলেন। কঠোর পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে এইচ.এস.সি পাশ করে ব্র্যাকের স্বাস্থ্য সেবা প্রকল্পে চাকুরী শুরু করেন। চাকরীর বেতন ভাতা দিয়ে তিনি সংসারের অভাব দুর করে পরিবারে শান্তি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন জয়িতা আফরোজা। শ্রেষ্ঠ সফল জননী সুফিয়া ঃ- দেবহাটার রতœগর্ভা মা সুফিয়া খাতুন। তিনি উপজেলার আস্কারপুর গ্রামের রজব আলীর স্ত্রী। তিনি ছিলেন সমাজ সচেতন, শিক্ষানুরাগী এবং আত্মপ্রত্যয়ী। নিজে নিরক্ষর হয়েও শিক্ষার প্রতি ছিলেন অদ্যম অনুরাগী। কোন প্রতিকুলতা তাকে হার মানাতে পারেনি। ২ ছেলে এক মেয়ের গর্বিত জননী তিনি। স্বামী ছিলেন দিনমুজুর। ৩ সন্তান নিয়ে অভাবের সংসারে স্বামী তাকে রেখে ২য় বিবাহ করে। এতে তিনি দিশেহারা হয়ে পড়েন। পরিবারের হাল ধরতে এলাকায় প্রাইভেট পড়ানো এবং বাড়িতে হাঁস-মুরগি পালন শুরু করেন সুফিয়া খাতুন। এই উৎস থেকে উৎপাদিত অর্থ দিয়ে ছেলে-মেয়েদের খাতা-কলম কিনে দিতেন। একই বই পর্যায়ক্রমে সবাই পড়ত। তার সন্তানেরা স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করে উচ্চ শিক্ষায় সর্বোচ্চ মেধার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছেন। বড় ছেলে শামিম হোসেন ঢাকার একটি ব্যাংকে অডিট অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন। ছোট ছেলে সাতক্ষীরা সড়ক উন্নয়ন দপ্তরের সিনিয়র সার্ভেয়ার এবং মেয়ে রেহেনা আক্তার কালিগঞ্জ উপজেলার মাগুরালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে কর্মরত আছেন। নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে নতুন জীবন শুরু করেছেন নাসিমা ঃ- উপজেলার পারুলিয়া ইউনিয়নের এছাহাক আলী কন্যা নাসিমা খাতুন নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে নতুন উদ্দ্যমে জীবন শুরু করেছেন। নাসিমার পিতা ছিলেন ভূমিহীন দিনমুজুর। ৮ বছর আগে তার বিয়ে হয় এক দিনমুজুর পরিবারে। নাসিমার পিতা বর পক্ষের চাহিদা মত যৌতুক দিতে না পারায় বেড়ে যায় নির্যাতনের মাত্রা। একবছর পরে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন তিনি। সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে সব নির্যাতন সহ্য করতে থাকে। এক পর্যায়ে সন্তান নিয়ে বাপের বাড়িতে চলে এসে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকে জানালে তিনি মিমাংশার জন্য উভয়পক্ষ কে ডাকে। স্বামী তাকে নিয়ে সংসার করতে রাজি না হয়ে ডিভোর্স দিয়ে দেয়। এসময় তার পাশে দাঁড়ানোর মত কেউই ছিল না। তার মাও তখন বিধবা জীবন যাপন করছিলেন। তখন তিনি নিজের চেষ্টায় মাকে নিয়ে হাঁস-মুরগী ও গাভী পালন শুরু করেন। বর্তমানে তার খামারে ৫৫টি হাঁস-মুরগী ও ৫টি উন্নত জাতের গরু রয়েছে। পূর্বের তুলনায় সংসারে অনেক উন্নয়ন হয়েছে তার। সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখা জয়িতা সুফিয়া ঃ- উপজেলার সদর ইউনিয়নের টাউনশ্রীপুর গ্রামের মৃত রিয়াজউদ্দীনের স্ত্রী সুফিয়া খাতুন। সংগ্রাম করে চলছে যার জীবন। ১৯৮০ সালে বিয়ে হওয়ার পর থেকে সমাজের বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থায় জীবন নির্বাহ করে চলেছেন তিনি। ২০০০ সালে তার স্বামী মারা যায়। দারিদ্রের কারণে মেয়েকে লেখাপড়া করাতে না পারলেও ছেলেকে সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ৪র্থ বর্ষে লেখাপড়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে স্বক্ষম হয়েছেন। সংসার পরিচালনা করতে তিনি ব্র্যাকের সহযোগিতায় টাউনশ্রীপুর পল্লী সমাজের সদস্য হিসেবে কাজ শুরু করেন। এক পর্যায়ে সমাজের নানাবিধ কুসংস্কার ও বাঁধা বিপত্তি দূরীকরণের জন্য এলাকায় নারীদের নিয়ে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। ২০১১ সালে তার সংগঠনটির নাম দেওয়া হয় টাউনশ্রীপুর বহুমূখী পল্লী সমাজ ফাউন্ডেশন। ২০১২ সালে সংগঠনটি মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে রেজিষ্ট্রেশন প্রাপ্ত হয়। বর্তমানে সেখানে ৮০জন মহিলা সদস্য রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি থেকে ২০১৬ সালে ৪টি এবং বর্তমান পর্যন্ত মোট ২৩টি বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছে। রয়েছে স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি। এছাড়া চোরাচালান, মাদক, মানব পাচার প্রতিরোধ, জঙ্গী-সন্ত্রাসী কর্মকান্ড থেকে যুব সমাজকে সচেতনতা বৃদ্ধি সহ নানা কর্মসূচি। শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে প্রশাসনের সাথে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। গত ৯ ডিসেম্বর ২০১৭ বেগম রোকেয়া দিবসে উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ এই ৫ জয়িতা নারীকে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর এবং দেবহাটা উপজেলা প্রশাসন যৌথভাবে সম্মাননা প্রদান করে এই জয়িতাদের। তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় উপহার, ক্রেস্ট, সনদপত্র ফুল এবং খাবার। ইউনিয়ন পর্যায় থেকে আসা বাকী ২০ জন জয়িতাকেও সম্মাননা প্রদান করা হয়।