অনলাইন ডেস্ক: দুই লাখ ৮০ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সাজা হয়েছিল পাঁচ বছর। ওই সাজার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল দায়ের করেন তিনি। তবে আপিলের শুনানি চলাকালীন মামলার নথি তুলতে ব্যর্থ হন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী। কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, হাইকোর্ট থেকে নথিই গায়েব। তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপনে ব্যর্থ হওয়ায় শেষমেষ অভিযোগ থেকেই অব্যাহতি পান তিনি।এখন পর্যন্ত তিনি সাতটি বিয়ে করেছেন। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) সিনিয়র সহকারী সচিব তোফাজ্জল হোসেনের বিরুদ্ধে দায়ের করা দুদকের মামলার ক্ষেত্রে এমনটি হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, আদালতের দুই কর্মচারীকে মোটা অংকের অর্থ দিয়ে মামলার নথি নাকি তোফাজ্জল হোসেন গায়েব করিয়েছেন! সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) এ সংক্রান্ত একটি অভিযোগ দায়ের হয়েছে। অভিযোগটি প্রাথমিকভাবে গ্রহণ করেছে কমিশন। শিগগিরই শুরু হবে প্রাথমিক তদন্ত। তোফাজ্জল হোসেন বর্তমানে অবসরোওর ছুটিতে (পিআরএল) আছেন। জামালপুরের বিশেষ আদালতের তথ্য অনুযায়ী, তোফাজ্জল হোসেন ১৯৮৭ সালে পূবালী ব্যাংকে চাকরিরত অবস্থায় দুই লাখ ৮০ হাজার টাকা ক্যাশ থেকে আত্মসাৎ করেন। দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে চলা ওই মামলার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০০১ সালে জামালপুরের স্পেশাল জর্জ কোর্ট তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড, একই সঙ্গে ১২ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেন। ওই দণ্ডের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করেন তোফাজ্জল। আদালত প্রথমে ছয় মাস এবং পরবর্তীতে তিন মাসের জন্য দণ্ডাদেশ স্থগিত করেন। উচ্চ আদালতে মামলাটির বিচারকালীন আসামিপক্ষ (দুদক) মামলার পক্ষে কোনো নথি না দেখাতে পারায় অবশেষে অব্যাহতি পান তোফাজ্জল হোসেন।
দুদকের কাছে নতুন করে তোফাজ্জল হোসেনের বিরুদ্ধে দায়ের করা অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি হাইকোর্টের অফিস সহকারীপর্যায়ের দু’জনকে ম্যানেজ করে অর্থের বিনিময়ে তাদের দ্বারা মামলার গুরুত্বপূর্ণ নথি চুরি করান এবং তার দুই সহোদর মো. দুলাল হোসেন ও মো. মহর আলী নথিগুলো নিজ হাতে কোর্ট থেকে নিয়ে বেরিয়ে যান। এ বিষয়ে তার বিরুদ্ধে পুনঃতদন্তের আবেদন করা হয়েছে।
দুদকে আসা অভিযোগের ভিত্তিতে জাগো নিউজের পক্ষ থেকে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় খোঁজ নেয়া হয়। প্রশাসনিক ভবন- ৩ এর তৃতীয় তলায় নথি ঘেটে মামলার তথ্য পাওয়া যায়। ২০০১ সালের রেজিস্ট্রার বইয়ে (ভলিউম) ২০০১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর মামলার আপিল নম্বর ৩৫২৯ অন্তর্ভুক্ত করা ছিল। কিন্তু শাখার কর্মকর্তারা সেখানে খোঁজ নিয়ে ওই মামলার কোনো নথি খুঁজে পাননি। এ বিষয়ে জানতে তোফাজ্জল হোসেনকে ফোন দেয়া হয়। তিনি বলেন, ‘আমার কোনো বক্তব্য নেই। আমি কিছুই জানি না।’ একপর্যায়ে তিনি উল্টো প্রশ্ন রাখেন, ‘আপনাকে (দুদকে দেয়া অভিযোগ) এগুলো কে দিয়েছে? তার নামটা বলেন…’ অভিযোগকারীর নাম প্রকাশে অস্বীকৃতি জানালে তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। আদালত থেকে ফাইল সরিয়ে ফেলাসহ তোফাজ্জল হোসেনের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ জমা পড়েছে দুদক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরে।
অর্থ নিয়ে চাকরি না দেয়ার অভিযোগ অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, তোফাজ্জল হোসেনের নিজ বাড়ি জামালপুরের সরিষাবাড়িতে। তার বিরুদ্ধে অর্থ নিয়ে চাকরি না দেয়ার অভিযোগ করেছেন আব্দুল আজিজ। সম্পর্কে তিনি তোফাজ্জলের আত্মীয়। তিনি জানান, তোফাজ্জল হোসেন ও তার বোন ফারজানা আফরোজ আমার মা’র আপন মামাতো ভাই-বোন। ফারজানা আফরোজ রিচিং আউট অব স্কুল চিলড্রেনের (রস্ক) ট্রেনিং কো-অর্ডিনেটর। তিনি বলেন, ফারজানার সঙ্গে আমার বোনের পরিচয় থাকায় তার মাধ্যমে আমি তোফাজ্জল হোসেনের কাছে একটি চাকরির জন্য যাই। তখন তিনি পুলিশে চাকরি দেয়ার নামে আমার কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করেন। ২০১২ সালে জামালপুরের দৌলভিটীতে তোফাজ্জলের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে তার হাতে টাকা দেই। কিন্তু পাঁচ বছরেও চাকরি না পেয়ে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে তার বাড়িতে যাই। তিনি আমাকে পাঁচ লাখ টাকার একটি চেক দেন। ব্যাংকে চেক জমা দিয়ে দেখি অ্যাকাউন্টে কোনো টাকা নেই। পরে ব্যাংকের চেকটি নিয়ে আমি তোফাজ্জল হোসেনের বাড়িতে যাই। তার বোন আমার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত চেকটি ফেরত নেন এবং আমার স্ত্রীকে মারধর করেন। হাতে চেক না থাকায় তার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারছি না। সম্প্রতি এ বিষয়ে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরে একটি লিখিত অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন। জামালপুরের সরিষাবাড়ির অপর চাকরিপ্রত্যাশী ইদ্রিস আলী। তিনি অভিযোগ করেন, তার কাছ থেকে ২০১৫ সালে আট লাখ টাকা নেন তোফাজ্জল হোসেন। কিন্তু তাকেও চাকরি দেয়া হয়নি। এখন টাকা ফেরতের জন্য ফোন দেয়া হলে তিনি রিসিভ করেন না। চাকরিপ্রত্যাশীদের অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তোফাজ্জল হোসেন এ প্রতিবেদকের ফোন কেটে দেন।
মামলা নিষ্পত্তির নামে স্থানীয়দের জমি লিখে নেয়ার অভিযোগ সরিষাবাড়ির লেবু নামের এক ব্যবসায়ীর ‘কোম্পানির মালিকানা’ পুনরুদ্ধার করে দেবেন- এমন আশ্বাস দিয়ে তার কাছ থেকে ১৫ শতাংশ জমি লিখে নেন তোফাজ্জল হোসেন। ব্যবসায়ী লেবু মিয়া অভিযোগ করে বলেন, ‘আমি আক্তার গ্রুপের (আক্তার ফার্নিচার) মালিক। আমার কয়েকজন কর্মী কাগজপত্র জাল করে প্রতিষ্ঠানটি হাতিয়ে নেয় এবং নিজেদের বলে ব্যবসা পরিচালনা করতে থাকে। প্রতিষ্ঠানটি ফিরিয়ে দেয়ার আশ্বাস দিয়ে তোফাজ্জল হোসেন আমার কাছ থেকে ১৫ শতাংশ জমি লিখে নেন। কিন্তু দুই বছরেও তিনি আমার প্রতিষ্ঠানটি ফিরিয়ে দিতে পারেননি।
তোফাজ্জল হোসেনের সম্পদের বিবরণ দুদকে আসা অভিযোগ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তোফাজ্জল হোসেনের মোহাম্মদপুরে দুটি ফ্ল্যাট, মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে দুটি প্লট, বগুড়া শহরে তিনতলা ভবন, জামালপুরে ১৫ শতাংশ জমি, চাঁপাইনবাবগঞ্জে সপ্তম স্ত্রী যোবীর নামে জমি ও আমের বাগান, গাজীপুরের আশুলিয়া ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকায় ২৫ বিঘা জমি এবং সরিষাবাড়িতে ১০০ বিঘা জমি রয়েছে। এছাড়া ময়মনসিংহ শহরে তোফাজ্জলের পাঁচটি বাড়ির মধ্যে তৃতীয় স্ত্রী বীথির নামে একটি, সপ্তম স্ত্রী যোবীর নামে একটি, দুই মেয়ের নামে দুটি এবং ছেলের নামে একটি বাড়ি রয়েছে। এখন পর্যন্ত তিনি সাতটি বিয়ে করেছেন। এর মধ্যে তিন স্ত্রী তাকে তালাক দিয়ে চলে গেছেন। ফাইল চুরি, অর্থ আত্মসাৎ ও অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ গৃহীত হয়েছে। তবে এখনও তালিকাভুক্ত হয়নি। প্রাথমিকভাবে অভিযোগের বিষয়গুলো যাচাই-বাছাই করা হবে। এরপর দুদকের এখতিয়ারভুক্ত মনে হলে একজন অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হবে। ওই কর্মকর্তা পরবর্তীতে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।